• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৭ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

দূর হোক শিক্ষাব্যবস্থায় বৈষম্য, পরিবর্তন আসুক গুণগত মানে

  মেহেরাবুল ইসলাম সৌদিপ

১৭ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৫:০৪
শিক্ষার্থী
মতামত প্রদানকারী শিক্ষার্থীরা (ছবি : দৈনিক অধিকার)

নেপোলিয়ন বলেছিলেন, "তুমি আমাকে শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাকে শিক্ষিত জাতি দেব।" শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষিত সমাজ ব্যতীত জীবনমানের উন্নয়ন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আমাদের দেশে শিক্ষার উন্নয়ন ঘটাতে পেরোতে হয়েছে অনেকটা পথ।

পাকিস্তান সরকারের গণবিরোধী, শিক্ষা সংকোচনমূলক শিক্ষানীতি চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে এবং একটি গণমুখী শিক্ষানীতি প্রবর্তনের দাবিতে ১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ছাত্র-জনতার ব্যাপক গণআন্দোলনের রক্তাক্ত স্মৃতিবিজড়িত দিনটি এখন "মহান শিক্ষা দিবস।"

শিক্ষার কালো ঘোর অমানিশা, অন্ধকার কেটে এসেছে আলোর পথযাত্রা। মহান শিক্ষা দিবস উপলক্ষে শিক্ষা, সুশিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কী ভাবছেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়ারা। তাদের মন্তব্য তুলে ধরেছে দৈনিক অধিকার-

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের শিক্ষার্থী ইমরান উদ্দিন। তিনি বলেন, শিক্ষাই জাতি ও রাষ্ট্রের অন্যতম স্তম্ভ। শিক্ষা ছাড়া জাতির অগ্রগতি কল্পনামাত্র। একটি জাতির উন্নতি, অগ্রগতি শিক্ষার ওপর নির্ভর করে। যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত সেই জাতি তত বেশি উন্নত।

মায়ের মুখ থেকে অ আ শিখা থেকে শুরু করে মৃত্যু অবধি শিক্ষার বিকল্প নেই। আমাদের পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক জীবন সবক্ষেত্রে শিক্ষা আমাদের অবিচ্ছেদ্য ভূমিকা পালন করে। কিন্তু আমাদের দেশের শিক্ষার ওপর অনেকেই আঘাত করেছে, নানানভাবে নির্যাতন বৈষম্য করেছে। আমাদের ভাষার ওপর আঘাত হেনেছে, শিক্ষার ওপর আঘাত হেনেছে, আমাদের অধিকারের ওপর আঘাত হেনেছে।

অতঃপর ১৯৭১ সালে নয় মাস যুদ্ধ করে পেয়েছি স্বাধীন দেশ। ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও শিক্ষা ক্ষেত্রে যুগোপযোগী পরিবর্তন আসেনি। আজকের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে এখনো বাংলাদেশে মৌলিক কোনো শিক্ষানীতি চালু নেই। বহুবিধ ধারায় শিক্ষানীতি চলছে এ দেশে। সুস্থ জাতি গড়ে তোলবার জন্য যে শিক্ষা প্রয়োজন। তা নেই বললেই চলে।

প্রযুক্তির যুগে একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নৈতিক, মানবিক জাতি গঠনে সহায়ক এমন শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতে হবে। যেখানে কোনো বৈষম্য থাকবে না। একটি বৈষম্যহীন বহুমুখী শিক্ষানীতি প্রণয়ন জরুরি। তবেই যারা শিক্ষার জন্য জীবন দিয়েছে, তাদের জীবন স্বার্থক হবে।

স্বাক্ষরতার হার বাড়লেও সুশিক্ষার হার বাড়েনি উল্লেখ করে, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ফারহানা ইয়াসমিন বলেন, ছোট্ট একটি ‘স্ব’ যার অর্থ হলো নিজের, স্বকীয় ইত্যাদি আর স্বাক্ষরতা শব্দের অর্থ হলো নিজের নাম নিজে লেখা। অর্থাৎ সাধারণভাবে যেসব ব্যক্তি নিজের নাম নিজে লিখতে পারে তারাই স্বাক্ষরতার মধ্যে পড়ে।

তবে ভালো বাংলায় বলা হয় যারা লিখতে জানে এবং পড়তে জানে তাদের সংখ্যার অনুপাতকে স্বাক্ষরতার হার বলে। বাংলাদেশের বিগত কয়েক দশকের তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায় হুড়হুড় করেই এই স্বাক্ষরতার হার বেড়ে চলেছে। একটি দেশের মেরুদণ্ড হলো শিক্ষা ব্যবস্থা। ঠিক যেমন একজন মানুষ তার মেরুদণ্ড ছাড়া সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না, একটি নৌকা মাঝি ছাড়া নির্দিষ্ট গন্তব্য স্থলে পৌছাতে পারে না, তেমন করে একটি জাতিও শিক্ষাব্যবস্থা ছাড়া উন্নতির শিখরে যেতে পারে না। বৈশ্বিক বিভীষিকাময় করোনা মহামারির কারণে ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত শিক্ষা ব্যবস্থা স্থবির হয়ে ছিল। তবে ইতোমধ্যে শিক্ষামন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী সব ব্যর্থতা জয় করে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হয়েছে। দীর্ঘ ছুটির মধ্যে থেকেও বাংলাদেশ কিন্তু স্বাক্ষরতার দিক দিয়ে পিছিয়ে নেই। স্বাক্ষরতার হার বাড়লেও সুশিক্ষার হার চরম অভাবে। এক্ষেত্রে স্বাক্ষরতার পাশাপাশি সুশিক্ষার দিকেও নজর রাখতে হবে।

শিক্ষা ছাড়া কোনো কিছুরই উন্নয়ন সম্ভব নয় বলে মনে করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী সুমাইয়া তামান্না মীম। তিনি বলেন একটি রাষ্ট্রের উন্নয়ন ঘটাতে চাইলে জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষা নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই। ইতিহাস ঘেঁটে আমরা জানতে পারি শিক্ষা খাতে পূর্ব বাংলার লোকদের জন্য খুবই কম অর্থ বরাদ্দ করা হতো। আবার বেশিরভাগ অর্থ চলে যেত পশ্চিম বাংলার শিক্ষাখাতে। সেই সূচনা থেকেই পূর্ব বাংলার মানুষজন বুঝতে পারে তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল এবং জনগোষ্ঠীকে অশিক্ষিত করার জন্যই পশ্চিম বাংলার দাপটশীল লোকদের ষড়যন্ত্র।

একটি দেশ বা রাষ্ট্রের উন্নয়ন ঘটাতে চাইলে অবশ্যই শিক্ষাখাতে নজর দিতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন, শিক্ষকদের মানসম্মত বেতনের ব্যবস্থা করা, অবকাঠামোগত উন্নয়নে তাদের ভূমিকাকে জনগণকে উপলব্ধি করতে সহায়তা করা, অধিক মেধাবী, পরিশ্রমী, নৈতিকতা সম্পন্ন, তথ্যপ্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ শিক্ষক নিয়োগ দিলেই জাতির অধঃপতন থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব।

নৈতিকতা শিক্ষার পাশাপাশি চর্চার যথাযথ ব্যবস্থা করা সংশ্লিষ্ট সকলের দায়িত্ব ও কর্তব্য। বাংলাদেশ শিক্ষা ব্যবস্থায় সরকারের উচিত প্রতিটি গ্রামে স্কুল-কলেজ স্থাপন করা এবং অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা যেন প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিশু কিশোররা তাদের এই মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়। তবেই আমাদের শিক্ষিত জাতিরা দেশ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নে কাজ করে আমাদের দেশকে আরও সমৃদ্ধশালী করতে পারবে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি সাহিত্য বিভাগের শিক্ষার্থী জাফরুল ইসলাম বলেন, দেশের শিক্ষিত শ্রেণী যেন আজ অবহেলিত, তাদের কোনো অধিকার নেই বেঁচে থাকার। তাইতো আত্মহত্যাও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাথে বেকার সমস্যাও যে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে সেটাও কিন্তু দেশের শিক্ষিত শ্রেণিরা বুঝতে পারছে।

কারণ শিক্ষিতদের শতকরা ৬৬ শতাংশ আজ বেকার। যেখানে একজন শিক্ষার্থীর ভাবনা থাকে পড়াশোনা শেষ করে সে তার অর্জিত জ্ঞান দিয়ে দেশের সেবা করবে, সেখানে তারা আজ বঞ্চিত হচ্ছে। বেকার নামক অভিশাপ থেকে আমাদের সমাজকে মুক্তি দিতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন এনে বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রসার ঘটানো অবশ্যই জরুরি। সুস্থ জাতি গড়ে তুলতে হলে শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করতে হবে।

তথ্য প্রযুক্তির যুগে নিজস্ব জাতীয় বাস্তবতা মিলিয়ে একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। করতে হবে গণমুখী শিক্ষানীতি যেখানে কোন বৈষম্য থাকবে না। তাহলেই বাস্তবায়িত হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অন্যথায় নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো থেকে সেশন জট দূরীকরণ করতে না পারলে অনেকের চাকরির বয়স পার হয়ে যাবে। সেশন জট দূরীকরণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। সুন্দর জীবন কাঠামো সাজাতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস সায়মা বলেন, একটি জাতি বিনির্মাণে শিক্ষা অনেক বড় ভূমিকা পালন করে। দুর্বল শিক্ষা ব্যবস্থা যে কোনো জাতিকে ধ্বংস করে দিতে পারে। এক সময়কার বটতলার শিক্ষা ব্যবস্থা সময়ের আবর্তনে ডিজিটাল রূপ ধারণ করলেও গুণগত মানে তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি।

আমাদের উন্নয়নশীল দেশকে উন্নত দেশের কাতারে দাঁড় করাতে আমাদের সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। সময়োপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ প্রদান, কারিকুলাম পুনর্বিন্যাসে আরও জোর দেয়া প্রয়োজন। করোনাকালে শিক্ষাক্ষেত্রে ইতিবাচক ও নেতিবাচক যেসব অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছে তার আলোকে প্রচলিত গতানুগতিক শিক্ষা কর্মসূচী থেকে সরে আসতে হবে যেন আমাদের শিক্ষার্থীরা নতুন বিশ্বে পারদর্শিতার সাথে তাল মিলিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে পারে।

তিনি আরও যুক্ত করেন, একসময় আমাদের দেশে শিক্ষার উন্নয়ন বলতে শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাঠামোগত উন্নয়ন বুঝানো হতো। কিন্তু, শিক্ষাক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের নানাবিধ উন্নয়ন কার্যক্রমে আমরা এ ধারণা থেকে এখন বেরিয়ে এসেছি। সুষ্ঠু শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করাই আমাদের অন্যতম লক্ষ্য হওয়া উচিত। পাশাপাশি শিক্ষার গুণগত মান পরিবর্তনে সমন্বিত ভাবে সবার এগিয়ে আসা জরুরি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী সিনথিয়া সুমির মতে শিক্ষা একজন শিক্ষার্থীর পরিবেশ থেকে শুরু করে সমাজ, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য ইত্যাদি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করার সুযোগ করে দেয়। শিক্ষা মানুষকে সংবেদনশীল, নৈতিক গুণাবলির অধিকারী, সৃষ্টিশীল এবং আরও বিভিন্ন গুণে গুণান্বিত করে তোলে। তবে এর জন্য থাকা চাই সুশিক্ষা।

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরও আমরা কতটুকু বৈষম্যহীন শিক্ষা নীতি বা সুশিক্ষা পেয়েছি তা নিয়ে সবার মনে প্রশ্ন থেকেই যায়। বর্তমান সরকারের যুগান্তকারী পদক্ষেপ শিক্ষাক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি এনে দিলেও শিক্ষকরা করে ক্লাস বর্জন আর শিক্ষার্থীরা করে মিটিং, মিছিল, আন্দোলন। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন রাষ্ট্রের অঙ্গীকারই ছিল গণমুখী শিক্ষাব্যবস্থা, সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা, এমনকি বিজ্ঞানভিত্তিক ও বৈষম্যহীন শিক্ষাব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা।

একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার জন্য ও সুশিক্ষা নিশ্চিতের জন্য দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরও যুগোপযোগী করা একান্ত অপরিহার্য। বর্তমান শিক্ষক সমাজকে বৈষম্যহীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম এগিয়ে আসতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থায় সকল বৈষম্য দূর করতে হবে, তবেই সুশিক্ষা নিশ্চিত হবে।

ওডি/নিমি

আপনার ক্যাম্পাসের নানা ঘটনা, আয়োজন/ অসন্তোষ সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড