• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৮ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

লাশের সংখ্যা কত অঙ্কে পৌঁছলে আমরা সচেতন হবো?

  সম্পাদকীয় ডেস্ক

৩০ মার্চ ২০১৯, ১৬:৫৭
সম্পাদকীয়

আধুনিক সভ্যতার চরম উৎকর্ষের এ সময়ে দাঁড়িয়ে প্রগতিশীল মানুষেরা নিশ্চয়ই 'অভিশাপ' শব্দটিতে বিশ্বাস রাখেন না৷ রাখবেনই বা কেন! তবে সকল কুসংস্কারকে ছুড়ে ফেলে আধুনিকমনা সমাজ গঠনের এ সময়ে সত্যিই যদি অভিশাপ বলে কিছু থেকে থাকে, তাহলে সেটা 'বাংলাদেশের ওপর আগুনের অভিশাপ' ছাড়া আর কিছু হতে পারে না৷ 'অভিশাপ' শব্দটিতে অনেকের আপত্তি থাকতে পারে; তবে পরিসংখ্যান দেখলে একজন উত্তরাধুনিক মানুষও দ্বিধায় পড়ে যাবেন নিশ্চিত৷

তাজরীন ফ্যাশন, পুরান ঢাকার নিমতলীস্থ নবাব কাটরা, বসুন্ধরা সিটি, হাজারীবাগের বউবাজার বস্তি, গরিব অ্যান্ড গরিব গার্মেন্টস, হামীম গ্রুপ, স্মার্ট এক্সপোর্ট গার্মেন্টস লিমিটেডে, স্পেকট্রাম, টাম্পাকো ফয়েলস কারখানা, চুড়িহাট্টা, এফ আর টাওয়ার— এ নামগুলো ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের শিকার হবার কারণে৷ তবে এর বাইরেও সারাদেশে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার যে তথ্য পাওয়া যায়, তা রীতিমতো শিউরে ওঠার মতো৷ পরিসংখ্যান বলছে, গত ১০ বছরে সারাদেশে অন্তত ১ লক্ষ ৫০ হাজার ২১৫টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এসব অগ্নিকাণ্ডে ২ হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন৷ আহত হয়েছেন প্রায় ১৩ হাজার মানুষ। কেবল ২০১৮ সালেই ১৯ হাজার ৬৪২টিরও বেশি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এতে কমপক্ষে ১৩০ জন নিহত ও ৬৬৪ জন আহত হয়েছে বলে বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে৷ এসব অগ্নিকাণ্ডে কেবল গত বছরেই ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৪৩০ কোটি টাকা৷ গত ১০ বছরে এ ক্ষতির পরিমাণ প্রায় সোয়া চার হাজার কোটি টাকার মতো৷

বলা বাহুল্য, যে কোনো ধরনের দুর্ঘটনার চাইতে অগ্নিদুর্ঘটনায় প্রাণ ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয় সবচাইতে বেশি৷ বিশেষ করে ঢাকার মতো অতি ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলোতে অগ্নিকাণ্ড হতে সৃষ্ট ক্ষতি কমিয়ে আনা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে৷ দেশে প্রতিবছর যতগুলো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে, তার বেশিরভাগ ঘটে ঢাকা মহানগরীতে৷ এখানে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষয়ক্ষতিও হয় দেশের অন্যান্য এলাকা থেকে বেশি৷ চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি-মার্চে মাত্র পঁয়ত্রিশ দিনের ব্যবধানে দুটি বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১০৬ জন মানুষ৷ পুরো শহর যেন একটি সুপ্ত আগ্নেয়গিরি, একটি জ্বলজ্যান্ত মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছে৷

ঢাকা শহরের এসব অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা এবং এ থেকে অপ্রত্যাশিত মাত্রায় ক্ষয়ক্ষতি সৃষ্টির পেছনে কয়েকটি অতি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে৷ এর মধ্যে অন্যতম প্রধান কারণটি হলো ভবন তৈরির সময় বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড ২০০৬ এবং অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন ২০০৩ অমান্য করা। সর্বশেষ ঢাকার বনানীতে এফ আর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখা যায়, ১৮ তলার অনুমতি নিয়ে ২৩ তলা ভবনটি তৈরি করা হয়েছে৷

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স ২০১৮ সালের বাৎসরিক প্রতিবেদনে বলছে, দেশে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলোর ৩৯ শতাংশের কারণ বৈদ্যুতিক গোলযোগ৷ বৈদ্যুতিক কারণে অগ্নিকাণ্ডের পেছনেও নানাবিধ কারণ দায়ী৷ যেমন—অবৈধ বৈদ্যুতিক সংযোগ, নকল বা নিম্নমানের বৈদ্যুতিক তার ব্যবহার, অতি পুরাতন বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার, অদক্ষ ইলেক্ট্রিশিয়ান দিয়ে ওয়্যারিং করানো এবং বয়লার, জেনারেটর, ট্রান্সফরমার ইত্যাদি নানাবিধ ইলেকট্রো-মেকানিক্যাল যন্ত্রের যথেচ্ছ ব্যবহার৷

অগ্নিকাণ্ডের কোনো ঘটনার সূত্রপাত হওয়ার পর তার সমাধানে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব৷ কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এ ব্যাপারে আমাদের সক্ষমতার অভাব দৃশ্যমান হয়ে ওঠে৷ বিশেষত বহুতল ভবনগুলোতে যথেষ্ট মাত্রায় অগ্নি-নির্বাপণের অপর্যাপ্ত হওয়ায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যায়৷ আগুনের সূত্রপাত হবার পর দমকল বাহিনী ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর আগেই যাতে চূড়ান্ত ক্ষতি না হয়ে যায়, সে জন্য প্রতিটি ভবনেই অগ্নি-নির্বাপণের জোরদার ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন, যাতে অন্তত ১০-১৫ মিনিট পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা যায়৷ কিন্তু দুঃখজনকভাবে ঢাকা শহরের বেশিরভাগ বহুতল ভবনেই এ ব্যবস্থাটি অত্যন্ত নড়বড়ে৷ এগুলো যথাযথ তদারকির আওতায় আনা দরকার৷

এছাড়া, আমাদের দমকল বাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধির দিকেও আমাদের নজর দিতে হবে৷ বেশিরভাগ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাতেই দেখা যায়, দমকল বাহিনীর হাতে পর্যাপ্ত প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নেই৷ দমকল বাহিনীর সদস্যদের দক্ষতা বৃদ্ধিতেও আরও অধিক পরিমাণে কাজ করতে হবে৷ তবে কর্মীরা যত দক্ষই হোন, যথেষ্ট পরিমাণ লজিস্টিক সাপোর্ট না থাকলে তারা আদতে কিছুই করতে পারেন না৷ তাই দমকল বাহিনীর কার্যকারিতা বৃদ্ধিতে বহুমুখী ব্যবস্থা নিতে হবে৷ সেই সাথে, ঢাকা শহরের বহুতল ভবনগুলো যথাযথ নিয়ম মেনে তৈরি হয়েছে কি না, সে বিষয়ে নিয়মিত তদন্তের ব্যবস্থা করতে হবে এবং 'অবৈধ' ভবনগুলো চিহ্নিত করে ভবন-মালিকদের আইনের আওতায় আনতে হবে৷ পুরো শহরটি মৃত্যুপুরীতে পরিণত হবার আগেই এসব ব্যাপারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে নগরবাসীকে আগুনের 'অভিশাপ' থেকে মুক্ত করাই এ সময়ের সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ৷ এ পরীক্ষায় শতভাগ নম্বর নিয়ে আমাদের পাশ করতে হবে৷

ওডি /আরএইচএস

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড