অধিকার ডেস্ক ২১ মার্চ ২০১৯, ১৮:২৬
'প্রাথমিক শিক্ষার দীপ্তি উন্নত জীবনের ভিত্তি’— 'প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহ ২০১৯' এর স্লোগানটি যথার্থই বটে৷ উন্নত জীবনের ভিত গড়ে ওঠে মূলত প্রাথমিক শিক্ষাস্তর থেকেই৷ একটা সময় ছিল, বাবা-মায়েরা সন্তানকে শিক্ষকের কাছে দিয়ে আসতেন আর বলতেন যেন তার সন্তানকে তিনি 'মানুষ' করে দেন৷ একটা সময় এমনটা ছিল, এখন নেই৷ এখন বাবা-মা সন্তানকে শিক্ষকের হাতে তুলে দিয়ে এ-প্লাস অর্জন করতে চান৷ আমাদের চিন্তাচেতনার এ পরিবর্তন শিশুর ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে যে ভয়ানক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না৷ এ কথা অনস্বীকার্য যে এখন লেখাপড়া সম্পূর্ণরূপেই এ-প্লাসমুখী৷ এর পেছনে বহুলাংশে দায়ী আমাদের বাবা-মায়েরা৷ তাদের অতিমাত্রায় ফলমুখিতার দরুণ শিক্ষকেরা আর নীতি-নৈতিকতা শেখানোর ফুরসত পান না; কেননা যে কোনো মূল্যে শিক্ষার্থীর পরীক্ষার ফলাফল ভালো করানোটাই তাদের মৌলিক দায়িত্ব হয়ে উঠেছে৷
একটি শিশুর মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধ, মানবমুখী আদর্শ, সততা, বিনয় ইত্যাদি গুণাবলি তৈরি করার জন্য সবচাইতে উপযুক্ত সময় তার প্রাথমিক শিক্ষাস্তর৷ তাকে তৈরি করার দায়িত্বও প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং তার শিক্ষকদের৷ জীবনঘনিষ্ঠ নানান প্রাথমিক শিক্ষা, যেমন— কীভাবে খেতে হয়, খাওয়ার আগে ও পরে কী ধরনের আদব-কায়দা মেনে চলতে হয়, বন্ধুর সাথে কীভাবে মিশতে হয়, মা-বাবা ও শিক্ষকের সাথে কীভাবে আচরণ করতে হয়, রাস্তা পারাপারের সময় করণীয় কী, মানুষের বিপদে কীভাবে সাহায্য করতে হয়, পশুপাখি, ফুল ও গাছপালার সাথে কেমনভাবে আচরণ করতে হয়, বাসে-ট্রেনে চলাচলের সময় কীভাবে থাকতে হয় ইত্যাদি বিষয়ে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক শিক্ষাপ্রদান প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর প্রধান দায়িত্ব হওয়া উচিত৷ কিন্তু আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় এগুলো একেবারে অনুপস্থিতই বলা চলে৷ শিশুদের পাঠ্যবইভিত্তিক লেখাপড়ার ক্ষেত্রেও শিক্ষামানের দিক দিয়ে আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো এখনও অনেক পিছিয়ে৷
প্রাথমিক শিক্ষায় আমাদের উন্নতি কিছু যে নেই, তা অবশ্য বলা যাবে না৷ গত দশ বছরে প্রাথমিক শিক্ষায় অনেক ক্ষেত্রেই গুণগত উন্নয়ন হয়েছে৷ শিশুদের স্কুলমুখী করতে প্রাথমিক বিদ্যালয়কে সম্পূর্ণরূপে অবৈতনিক করা, ফ্রি টিফিনের ব্যবস্থা করা, বছরের প্রথম দিনেই বিনামূল্যে বই বিতরণ, মিড ডে মিল চালু করা ইত্যাদি নানান উদ্যোগ সরকারের পক্ষ থেকে গ্রহণ করা হয়েছে, যার ফলে দেশের প্রায় শতভাগ শিশুকে স্কুলে আনা সম্ভব হয়েছে৷
প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নের স্বার্থে ২০১৩ সালে ২৬ হাজার ১৯৩টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণের ঘোষণা দেয়া হয়। এছাড়া বিদ্যালয়বিহীন দেড় হাজার গ্রামে একটি করে নতুন প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছে সরকার৷ বর্তমানে জাতীয়করণসহ দেশে প্রায় ৬৫ হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এগুলো যে সরকারের বড় ধরনের সাফল্য— এতে কোনো সন্দেহ নেই৷ তবে এত এত ব্যবস্থা নিলেও প্রাথমিক শিক্ষাস্তরে শিক্ষার মান নিয়ে সন্তুষ্টির তেমন কোনো সুযোগ নেই৷
সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষার মান নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করা হয়৷ বিশ্বব্যাংক বলছে, বাংলাদেশের প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের যা শেখানো হচ্ছে তা অপর্যাপ্ত। পঞ্চম শ্রেণির ৭৫ ভাগ শিক্ষার্থী গণিত পারে না এবং তৃতীয় শ্রেণির ৬৫ শতাংশ শিক্ষার্থী বাংলা পড়তে পারে না বলে এ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়৷ কেবল তাই নয়, প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করতে আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের এগারো বছর পর্যন্ত সময় লাগছে। কিন্তু যে শিক্ষা দেয়া হচ্ছে তা মূলত সাড়ে ছয় বছরে পাওয়ার কথা। এ ক্ষেত্রে অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের শিশুরা সাড়ে চার বছর পিছিয়ে থাকছে৷
দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে এখনও প্রধান শিক্ষকের ২৫ হাজার পদ শূন্য পড়ে আছে৷ শিক্ষকের অপ্রতুলতাও রয়েছে ব্যাপক৷ দেশের প্রাথমিক শিক্ষাস্তরে বর্তমানে প্রায় দুই কোটি শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক আছেন তিন লাখের কিছু বেশি৷ হিসাবমতে, প্রতি ৫৩ জন শিক্ষার্থীর জন্য রয়েছেন একজন মাত্র শিক্ষক৷ শুধু তাই নয়, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণেও ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে৷ ইউনেস্কোর এশিয়া প্যাসিফিক রিজিওনাল ব্যুরো ফর এডুকেশন এক প্রতিবেদনে বলছে, যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকের অভাবেই বাংলাদেশে শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।
প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ সবচেয়ে পিছিয়ে আছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়৷ শিক্ষক-শিক্ষার্থীর দুর্বল অনুপাত ও শিক্ষকদের দক্ষতার অভাবই মূলত শিক্ষামান উন্নয়নের পথে বড় বাধা৷ তাই পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগের মাধ্যমে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:২৫ এ উন্নীত করতে হবে৷ সেই সাথে, যথাযথ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষকদের দক্ষতা উন্নয়নেও কাজ করতে হবে৷ সর্বোপরি, বিদ্যালয়গুলোকে রেজাল্টমুখী না করে শিক্ষামুখী করে গড়ে তোলার দিকে অধিক মনোযোগী হতে হবে৷ এ সকল বিষয় নিশ্চিত করা গেলেই প্রাথমিক শিক্ষাকে প্রকৃত অর্থেই উন্নত জীবনের ভিত্তিরূপে বিবেচনা করার সুযোগ সৃষ্টি হবে৷
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড