• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৮ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

নার্সারিতে ভাগ্য বদল নুর উদ্দিনের

  রাকিব হোসেন আপ্র

০২ এপ্রিল ২০১৯, ১৩:২৮
মোহাম্মদ নুর উদ্দিন
মায়ের দোয়া আল আমিন নার্সারির মালিক মোহাম্মদ নুর উদ্দিন (ছবি : দৈনিক অধিকার)

এক সময় অন্যের নার্সারি থেকে গাছের চারা কিনে ভ্যানে করে বিভিন্ন হাটবাজারে বিক্রি করতাম। এখন আমার নার্সারি আছে। নার্সারির আয় দিয়ে ভালোভাবেই চলছে আমার সংসার। তাছাড়া আরও অনেকের কর্মসংস্থান করে দিতে পেরে আমি আনন্দিত। হাসিমুখে ধীরে ধীরে কথাগুলো বলছিলেন লক্ষ্মীপুরের চন্দ্রগঞ্জ থানা ভবন সংলগ্ন ‘মায়ের দোয়া আল আমিন’ নার্সারির মালিক মোহাম্মদ নুর উদ্দিন।

প্রায় তিন একর জমি জুড়ে নুর উদ্দিনের নার্সারি। বর্তমানে প্রায় ২৫ লাখ টাকা মূল্যের চারা গাছ রয়েছে এ নার্সারিতে। এর মধ্যে রয়েছে শতাধিক প্রজাতির ফলদ, বনজ, ঔষধি, শাক সবজি ও ফুল গাছের চারা। নার্সারির আয় দিয়ে ভালোভাবেই চলছে নুর উদ্দিনের সংসার। এখানে নিয়মিত কাজ করে ১০ থেকে ১২ জন শ্রমিক জীবিকা নির্বাহ করছেন। প্রতিমাসে শ্রমিকদের মজুরি ও অন্যান্য খরচ বাদ দিয়ে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা আয় হয় বলে জানিয়েছেন নুর উদ্দিন। বাৎসরিক হিসাবে লাভের পরিমাণ প্রায় ৫ থেকে ৬ লাখ টাকার মতো। তবে জমির ইজারা বাবদ প্রতিবছর ১ লাখ ২০ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হয় তাকে।

নুর উদ্দিনের নার্সারিতে প্রায়ই দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা পর্যবেক্ষণে আসেন। যারা বিভিন্ন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন। চট্টগ্রাম, বরিশাল, বগুড়া ও ঠাকুরগাঁওসহ বিভিন্ন জেলা থেকে নার্সারির জন্য বীজ, গাছের চারা ও কলম সংগ্রহ করেন নুর উদ্দিন। আবার নিজের নার্সারি থেকেও তিনি বিভিন্ন জেলায় চারাগাছ ও কলম সরবরাহ করে থাকেন। তবে সারা বছরই জেলার বিভিন্ন হাট-বাজারে বীজ, চারাগাছ ও কলমের চাহিদা মিটে এ নার্সারি থেকে। সর্বনিম্ন ১০ টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত মূল্যের চারাগাছ ও কলম রয়েছে এখানে। এ নার্সারিতে মাসিক বিক্রির পরিমাণ প্রায় ৫ লাখ টাকা।

জেলা সদরের দত্তপাড়া ইউনিয়নের তোতারখিল গ্রামের বাসিন্দা নুর উদ্দিন। স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্বে ডায়েরিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে তার বাবা শরাফত আলী মারা যান। তখন নুর উদ্দিনের বয়স ছিল ১ বছর ৯ মাস। একমাত্র সন্তানকে কোলে পিঠে করে বড় করেন মা জীবন নেছা। কিন্তু চরম অভাব অনটনের কারণে ছেলেকে পড়ালেখার সুযোগ করে দিতে পারেননি তিনি। কিশোর বয়সেই কাজে লেগে যান নুর উদ্দিন। চায়ের দোকান থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের কাজ করেন তিনি। বেশ কিছু দিন রাজধানী ঢাকার সদরঘাট এলাকায় জুতার ব্যবসাও করেন। ১৯৮৮ সালের বন্যায় তার ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ওই সময় এলাকায় ফিরে আসেন তিনি। অনির্বাণ ক্লাব নামে স্থানীয় একটি সামাজিক সংগঠনের সাথে জড়িত হন নুর উদ্দিন।

একদিন ওই ক্লাবের আঙ্গিনায় লাগানোর জন্য পার্শ্ববতী একটি নার্সারিতে গিয়ে দুটি গাছের চারা ক্রয় করেন নুর উদ্দিন। সেই থেকে গাছ ও নার্সারির সঙ্গে মিশে যান তিনি। স্বপ্ন দেখেন নার্সারি করার। নিজের কাছে গচ্ছিত থাকা মাত্র পাঁচশত টাকা নিয়ে তিনি গাছের চারা কেনা-বেচা শুরু করেন। প্রথমে ভ্যান গাড়ি ভাড়া করে বিভিন্ন নার্সারি থেকে বীজ, চারাগাছ ও কলম ক্রয় করে হাটবাজারে বিক্রি করতে নুর উদ্দিন। ১৯৯৩ সালে ২ লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জে ৩৬ শতাংশ জমি ইজারা নিয়ে নার্সারি শুরু করেন তিনি। আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো প্রশিক্ষণ না থাকলেও দেখে দেখে নার্সারি ব্যবসার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন তিনি। এভাবেই ভাগ্য বদলে যায় নুর উদ্দিনের। ২০১০ সালে লক্ষ্মীপুর জেলার চন্দ্রগঞ্জ ইউনিয়নের বসুদুহিতা গ্রামে প্রায় ৩ একর জমি ইজারা নিয়ে ‘মায়ের দোয়া আল আমিন’ নামে আরো একটি নার্সারি দেন। এটাই এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় নার্সারি। এ নার্সারির পাশেই রয়েছে নবনির্মিত চন্দ্রগঞ্জ থানা ভবন।

নুর উদ্দিনের বয়স এখন প্রায় ৫৮ বছর। তার সংসারে রয়েছে স্ত্রী, ৪ মেয়ে ও ১ ছেলে। ছেলে আল আমিন পড়ছে স্থানীয় একটি স্কুলের নবম শ্রেণিতে। ছোট মেয়ে শাহীনুর আক্তার এ বছর এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। সেজো মেয়ে খালেদা আক্তার পড়ছে কলেজে। বড় দুই মেয়ে মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসে। শুধুমাত্র নার্সারির আয় দিয়েই ভালোভাবে চলছে নুর উদ্দিনের সংসার। তিনি দায়িত্ব পালন করছেন জেলা নার্সারি এসোসিয়েশনের সহসভাপতি পদে।

মায়ের দোয়া আল আমিন নার্সারির মালিক নুর উদ্দিন দৈনিক অধিকারকে বলেন, কৃষি অফিস থেকে একটি সেচের ড্রাম ছাড়া কখনো কোনো সহযোগিতা বা উপকরণ পাইনি। ২০১৭ সালে অধিক বৃষ্টিপাতের কারণে প্রায় ১৫ লাখ টাকার বীজ, চারাগাছ ও কলম নষ্ট হয়। এরপর জেলা প্রশাসকের নিকট সহযোগিতা চেয়ে আবেদন করি। কিন্তু বারবার চেষ্টা করেও কোনো সহযোগিতা পাই নি। অথচ নার্সারি একটি উৎপাদনমুখী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। যা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে রাষ্ট্রের কল্যাণে অবদান রাখছে।

বর্তমানে ব্র্যাক ব্যাংকে ১০ লাখ ও ব্র্যাক এনজিওতে ৫ লাখ টাকা ঋণ রয়েছে নুর উদ্দিনের। তাছাড়া আরো ৫ লাখ টাকা আত্মীয় স্বজনকে দেনা দিয়েছেন তিনি। এরই মধ্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর আয়োজিত ৭টি মেলায় অংশগ্রহণ করে উন্নত মানের বীজ, গাছের চারা ও কলম প্রদর্শনীতে ৬ বার পুরস্কার জিতেছেন নুর উদ্দিন।

ওডি/এসজেএ

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড