• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩২ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

যে কারণে নিউইয়র্কে এত বাংলাদেশি করোনায় আক্রান্ত

  ইব্রাহীম চৌধুরী ও শাহ আহমদ, নিউইয়র্ক

০৮ এপ্রিল ২০২০, ১৪:৫৯
করোনা ভাইরাস
করোনা ভাইরাস (ছবি : সংগৃহীত)

করোনা ভাইরাসে আমেরিকার পরিস্থিতি সবচেয়ে নাজুক। আমেরিকার মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা নিউইয়র্কের। লকডাউনের পর নিউইয়র্কের হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা কিছুটা কমেছে। তবে বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল।

করোনার ছোবলে নিউইয়র্কে অভিবাসীদের মধ্যে বাংলাদেশিরাই বেশি আক্রান্ত হয়েছেন। বহু জাতিগোষ্ঠীর নিউইয়র্ক নগরীতে প্রতিদিন দেশের মানুষের মৃত্যুর খবর আসছে।

৭ এপ্রিল মায়নুল হক জুয়েল ও আকমল হোসেনসহ আমেরিকায় ৮৪ জন বাংলাদেশির মৃত্যুর হিসাব পাওয়া গেছে। নিউইয়র্কসহ আমেরিকার কোথাও সরকারিভাবে এই তথ্য প্রকাশ হয়নি। কমিউনিটি যোগাযোগের মাধ্যমে বাংলাদেশিদের মৃত্যুর সংখ্যা পাওয়া যাচ্ছে। এ সংখ্যা কিছুটা এদিক-সেদিক হতে পারে।

করোনায় এত প্রবাসীর আক্রান্ত ও মারা যাওয়ার ঘটনা বাংলাদেশি মানুষের ব্যাপকভাবে আতঙ্কগ্রস্ত করে ফেলেছে। এই ভাইরাসের কারণে কেন এত বাংলাদেশির মৃত্যু, তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছে প্রথম আলো উত্তর আমেরিকা।

এত আক্রান্ত হওয়া ও মৃত্যুর পেছনে অভিবাসী হিসেবে বাংলাদেশিদের কর্মজীবন, সচেতনতার অভাব, এমনকি ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনাচরণ দায়ী বলে মনে করা হচ্ছে।

জীবিকার তাগিদে বাইরে যাওয়া বা একসঙ্গে জমায়েত হয়ে বাজার, আড্ডা ও রাজনীতির কথাবার্তা নিয়ে বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রম বাংলাদেশি কমিউনিটিতে অন্যদের চেয়ে বেশি লক্ষ করা গেছে। লকডাউন জারির আগে নিউইয়র্কে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার খবরে সবাই যখন আতঙ্কিত, তখনো প্রবাসীরা কোনো ধরনের সচেতনতা, প্রচার বা প্রস্তুতিতে যোগ দেননি।

নিউইয়র্কে বাংলাদেশি সংগঠন আছে কয়েক শ। সংগঠনগুলোর অনেকে করোনার প্রাদুর্ভাবের সময়ও একসঙ্গে নির্বাচনী প্রচার থেকে শুরু করে চায়ের আড্ডায়, রেস্তোরাঁয় বসে সভা-সমাবেশ করেছেন। ফলে এখন অনেকেই ভুলের মাশুল দিচ্ছেন বলে মনে করা হচ্ছে। অনেকে নিজের জীবন ঝুঁকিতে ফেলেছেন। অনেকে হারিয়েছেন স্বজন।

এশিয়ার অন্যান্য দেশ যেমন ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা এমনকি চীনা প্রবাসীদের আক্রান্ত হওয়া ও মারা যাওয়ার হার বাংলাদেশিদের চেয়ে অনেক কম। এর অন্যতম কারণ শিক্ষা ও উন্নত জীবনধারায় বাংলাদেশি প্রবাসীরা অনেকটা পিছিয়ে। এ ছাড়া বাংলাদেশি প্রবাসীদের বেশির ভাগ এখনো ভারত ও পাকিস্তানের প্রবাসীদের মতো ভালো চাকরি বা উন্নত জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারেননি।

বেশির ভাগ প্রবাসী ক্যাব, রেস্টুরেন্ট, ডেলিভারি এসব চাকরি করেন। এমনকি দিন শেষে কাজ করে চায়ের আড্ডা ও ঘরে গাদাগাদি করে থাকার বিষয়টিকে একটি কারণ হিসেবে মনে করা হচ্ছে।

নিউইয়র্কে বসবাসরত একাধিক বাংলাদেশি চিকিৎসক ও সমাজভাবনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি এমনই অভিমত প্রকাশ করেছেন। প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার পক্ষ থেকে এ বিষয় নিয়ে কথা হয় নিউইয়র্কের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশি আমেরিকান চিকিৎসক ফেরদৌস খন্দকারের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমেরিকায় করোনাভাইরাস পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুতিতে বিলম্ব ছিল। এর ভয়াবহতার সাবধানবাণী আমাদের কমিউনিটির কাছে অনেক আগে পৌঁছেনি। ভাইরাসটির আক্রমণে আমাদের লোকজন শুরুতে আক্রান্ত হওয়ার কারণ, নিউইয়র্কে বাংলাদেশিদের বড় অংশ সামনের সারিতে কাজ করা কর্মজীবী। এর মধ্যে ক্যাবচালক, হোটেল-রেস্তোরাঁর কর্মী, গ্যাসস্টেশনের কর্মীরাও রয়েছেন।

দেখা যাচ্ছে, ২৫ থেকে ৬০ বছরের নিচের বয়সের বাংলাদেশিরা শুরুতেই আক্রান্ত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে অনেকের মৃত্যু হয়েছে।

একই এলাকায় বসবাসরত ভারতীয় বা অন্যান্য উপমহাদেশীয় অভিবাসী কর্মজীবীরা অনেকটা পরবর্তী ধাপে কাজ করছেন বেশি সংখ্যায়।

ভাইরাসের প্রথম আক্রমণের শিকার বাংলাদেশি কর্মজীবীদের মাধ্যমে পরিবারের লোকজন আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন। প্রবাসেও আমাদের অনেক পরিবারই একান্নবর্তী। অনেকেই একই বাসায় সন্তান, মা-বাবা, শ্বশুর-শাশুড়ি নিয়ে থাকেন। চলমান সংকটে এ বিষয়টিকেও বাংলাদেশিদের বেশি আক্রান্ত হওয়ার একটা কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। লকডাউন শুরু হওয়ার পর নিজেদের ঘরে অনেকের পক্ষে পৃথক থাকা সম্ভব হয়নি। অনেক লোকজনের বাস এক ঘরে। রান্নাঘর থেকে বাথরুম তাঁদের শেয়ার করতে হয়।

নিউইয়র্কে বাংলাদেশি প্রায় তিন শতাধিক চিকিৎসকসহ পাঁচ শতাধিক স্বাস্থ্যসেবী (নার্স, ইএমএস) সামনের সারির কর্মজীবী। তাঁরাও আক্রান্ত হয়েছেন একদম শুরুর দিকে। নিউইয়র্কের পুলিশে, ট্রাফিকে কাজ করা বাংলাদেশিরাও করোনার প্রথম ধাপের আক্রমণের শিকার হয়েছেন।

ফেরদৌস বলেন, এখন অনেকেই আরেক দফা আক্রান্তের শিকার হচ্ছেন, নিজেদের কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ না করার কারণে। কখনো বাধ্য হয়ে বা কম সতর্ক অবস্থায় গ্রোসারি কিনতে গিয়ে বা গ্যাসস্টেশনে গিয়ে আক্রান্ত হচ্ছেন।

ফেরদৌস জানান, তাঁর এক রোগী টানা ১২ দিন নিজেকে বিচ্ছিন্ন রেখে একবারের জন্য টুথপেস্ট কিনতে বেরিয়েছিলেন। সেখান থেকে ফেরার পরই অসুস্থ হয়ে পড়েন।

নিউইয়র্কে তরুণ বাংলাদেশি চিকিৎসক রায়হান সিদ্দিকী বলেন, ‘আমাদের লোকজনের খাদ্যাভ্যাস মোটেই স্বাস্থ্যকর নয়। হোটেল-রেস্তোরাঁয় দল বেঁধে পেঁয়াজি, ফুচকা, চানাভাজি, পরোটা, সমুচা খেতে গিয়ে অনেকের মধ্যে এই ভাইরাস ছড়িয়েছে। নিয়মিত ব্যায়াম না করা, অতিরিক্ত চাপের জীবন, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না রাখা, ধূমপানসহ নানা ব্যাপারে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন নিয়ে আমাদের লোকজনের সচেতনতার অভাব প্রকট।

এসব কারণে শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতাও অনেকের চেয়ে বাংলাদেশিদের দুর্বল বলে এই চিকিৎসকেরা মনে করেন। বাংলাদেশিদের মধ্যে ডায়াবেটিসের হার সবচেয়ে বেশি। অনেকেই এখানকার পরিবার, বাংলাদেশের পরিবার, স্বজন নিয়ে চাপের জীবন যাপন করেন। এটাকেও একটা বড় কারণ হিসেবে দেখছেন এসব চিকিৎসক।

নিউইয়র্ক প্রেসপেটেরিয়ান হাসপাতালের পরিচালক তরুণ বাংলাদেশি আমেরিকান চিকিৎসক নাসিম চৌধুরী বলেন, ‘যাঁরা ভালো হয়ে বাসায় যাচ্ছেন, তাঁরাও অন্যদের আক্রান্ত করতে পারেন। বাংলাদেশিদের মধ্যে যাঁরা সুস্থ হয়ে বাসা থেকে ঘরে ফিরছেন, তাঁরা যেন অন্তত দুই সপ্তাহ ঘরের অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকেন। অনেকজনের বসবাসের পরিবারে এ কাজটি কঠিন হলেও তা না করলে আমাদের আরও মূল্য দিতে হবে।’

নাসিম চৌধুরী বলেন, হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন নামের ওষুধ করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। আমেরিকার ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এই ওষুধটি এখনো অনুমোদন করেনি। নাসিম চৌধুরী বলেন, নিউইয়র্কের এয়ারপোর্টে আসা যাত্রীদের শুধু তাপমাত্রা দেখা হলেও করোনাভাইরাস শনাক্ত করার জন্য কোনো টেস্ট নেই। এ কারণে বাইরের দেশ থেকে ভাইরাসটি সহজেই আমেরিকায় প্রবেশ করেছে। এবং ছড়িয়ে পড়েছে আমাদের ক্যাবচালক বা সামনের সারির কর্মজীবীদের মাধ্যমে।

নিউইয়র্কে অনেক দিন ধরে আছেন সাংবাদিক মাহবুবুর রহমান। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে এ বিষয়ে তিনি বলেন, সাংস্কৃতিক দিক থেকে আমরা প্রবাসেও একসঙ্গে বসবাসকে এত দিন ইতিবাচক হিসেবে দেখেছি। ব্যয়বহুল নিউইয়র্কে অনেক প্রবাসী বাধ্য হয়েই একই ঘরে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে একই রুমে অনেকজনের বসবাস করতে হয়। প্রবীণ এই সাংবাদিক বলেন, ‘আমাদের কমিউনিটির অনেকে জমিয়ে আড্ডা দেয়, এটা-ওটা খায়, স্বাস্থ্যসমস্যাকে গুরুত্ব দেয় না। এগুলো চলমান সংকটের কারণ হতে পারে।

নিউইয়র্ক নগরের হাসপাতালে কর্মরত প্রযুক্তিবিদ ইশতেহাক চৌধুরী বলেন, প্রবাসেও আমাদের কমিউনিটির জীবনাচরণ অনেক ক্ষেত্রেই স্বাস্থ্যসম্মত নয়। দল বেঁধে আড্ডা দেওয়া, একই গ্রোসারিতে-রেস্টুরেন্টে ভিড় করাসহ স্বাস্থ্য সতর্কবাণীকে গুরুত্বের সঙ্গে না নেওয়াকে আজকের বাস্তবতার জন্য দায়ী বলে তিনি মনে করেন।

শুরুর দিকে অনেকেই আক্রান্ত হয়েছেন ক্যাব চালাতে গিয়ে, নগদ অর্থের লেনদেন থেকে আক্রান্ত কোনো যাত্রীর সংস্পর্শে এসে। এখন নিউইর্ক নগর থেকে ক্যাবচালকদের বলা হয়েছে, নগদ অর্থ পরিহার করার জন্য। যাত্রীদের সার চার্জসহ ভাড়া ক্রেডিট কার্ডেই দিতে হচ্ছে। আমাদের গ্রোসারি স্টোরগুলো থেকে বেশি আক্রান্তের ঘটনা ঘটেছে। নগদ লেনদেন, অপরিচ্ছন্ন ট্রলিসহ শুরুতে সতর্ক না হয়ে গ্রোসারি করা বা হোটেল-রেস্তোরাঁয় আড্ডা দেওয়ার মাশুল গুনতে হচ্ছে এখন আমাদের। নগদ অর্থের জন্য অপরিচ্ছন্ন এটিএম মেশিনে হাত দেওয়া এবং পরে হাত সেনিটাইজেশন করার সতর্কতা শুরুতে সঠিকভাবে মানা হয়নি। এখন মেইল এলেও সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে। এক দিন পর হাতে গ্লাভস পরে মেইল খোলার জন্য পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

নিউইয়র্ক নগরের মেয়র জানান, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ওপর করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব নিয়ে তাঁরা তথ্য সংগ্রহ করছেন। এসব তথ্য সামেনের দিনগুলোতে আরও সতর্ক হওয়ার জন্য কাজে লাগবে বলেছেন মেয়র বিল ডি ব্লাজিও।

ওডি

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড