• মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৬ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

ফেনীতে নানা অপরাধের অন্তরালে পুলিশের শক্তিশালী সিন্ডিকেট

  এস এম ইউসুফ আলী, ফেনী

২১ এপ্রিল ২০১৯, ১৪:০৭
পুলিশ
ফেনী জেলা পুলিশ (ছবি : সম্পাদিত)

ফেনীতে নানা অপরাধের অন্তরালে কাজ করছে দীর্ঘদিন ঘুরেফিরে এ জেলায় অবস্থান করা পুলিশের শক্তিশালী সিন্ডিকেট। যদিও এরই মধ্যে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ধারণা পেয়ে গেছে। ফলে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে ফেনী জেলা পুলিশকে। সম্প্রতি সোনাগাজীর মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির ওপর বর্বরতার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এবং বিভিন্ন সময়ের নানা অভিযোগ ও বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে ফেনী জেলা পুলিশে ব্যাপক রদবদল করার পরিকল্পনা করছে পুলিশ সদর দফতর।

সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, ফেনীর পুলিশ সুপার (এসপি) এসএম জাহাঙ্গীর আলম সরকার ও একাধিক থানার ওসিসহ দীর্ঘদিন ধরে ঘুরেফিরে ফেনীতে অবস্থান করা বেশ কিছু কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার বা অন্যত্র বদলি করা হতে পারে। পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কথায় এমন ইঙ্গিতই পাওয়া গেছে। এ ছাড়া গত কয়েকদিন ধরে ফেনী শহর এবং সোনাগাজী, দাগনভুঞা ছাগলনাইয়াসহ জেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলেও জানা গেছে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের বিরুদ্ধে নানা ক্ষোভ ও অভিযোগের কথা।

এসপি এসএম জাহাঙ্গীর আলম সরকার

স্থানীয়দের অভিযোগ, বছরের পর বছর ঘুরেফিরে এই একই জেলায় বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করে আসা বেশ কিছু পুলিশ কর্মকর্তা এখানে নানা অনিয়ম ও অপকর্মের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছে।

দীর্ঘদিন ধরে একই জেলায় অবস্থান করার ফলে ওইসব পুলিশ কর্মকর্তার মধ্যেও এক ধরনের ‘সিন্ডিকেট’ গড়ে উঠেছে। প্রভাবশালী বলয় তৈরি করা ফেনীর ওইসব পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে রয়েছে দায়িত্ব বা কর্তব্যে অবহেলা, অসহায় মানুষদের হয়রানি, মামলা, আটকসহ নানাভাবে হুমকি দিয়ে ঘুষ-দুর্নীতি করার মতো গুরুতর অভিযোগ।

এসব নিয়ে মুখ খুললেও পুনরায় বিপদে পড়তে হয় ভুক্তভোগী বা সাধারণ মানুষদের। এ অবস্থায় নুসরাতের ওপর নৃশংসতার ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে তদন্ত করতে বৃহস্পতিবার বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।

স্থানীয়রা জানান, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের স্থানীয় প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গেও মিলেমিশে ফেনী পুলিশের এক শ্রেণির কর্মকর্তা বা সদস্য নানা অনিয়ম ও অপকর্মে জড়াচ্ছেন।

সোনাগাজীতে নুসরাতের ওপর বর্বরতার ঘটনায় রাজনৈতিক সিন্ডিকেটে জড়িয়ে গিয়ে সেখানকার তৎকালীন ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন আসামিদের পক্ষে ভূমিকা পালন করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এমনকি ওসি মোয়াজ্জেমের পক্ষ নিয়ে আবার পুলিশ সদর দফতরে নুসরাতের পরিবারকেই দোষারোপ করে লিখিত চিঠি দেন ফেনীর এসপি এসএম জাহাঙ্গীর আলম সরকার। অভিযোগ আছে, এভাবেই প্রায় সব ক্ষেত্রে সিন্ডিকেটের মতো করেই চলছে ফেনীর স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন।

সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম

সংবাদ মাধ্যমে উঠে আসা পুলিশ সদর দপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বক্তব্যে জানা যায়, নুসরাতের ওপর বর্বরতার ঘটনার পর ফেনী জেলায় নিয়োজিত পুলিশ কর্মকর্তা বা সদস্যদের বিরুদ্ধেও অবেহলা-গাফিলতি, ঘুষ-দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগ পেয়েছে সদর দফতর। ব্যক্তি কর্মকর্তার দায় কখনই পুলিশ বিভাগ নেবে না। সে কারণেই পুলিশ সদরের ডিআইজি (মিডিয়া ও প্ল্যানিং) এসএম রুহুল আমিনের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি টিম ফেনী পুলিশের নানা কর্মকাণ্ড ও সাধারণ মানুষের অভিযোগ নিয়ে গত দুদিন ধরে এ জেলায় তথ্যানুসন্ধানে এসে বিষয়টি তদন্ত করে গেছে। এই টিমের সুপারিশের ভিত্তিতেই যেসব পুলিশ কর্মকর্তা বা সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা মিলবে তাদের সেখান থেকে প্রত্যাহার বা বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ পুলিশ নানা ক্ষেত্রে প্রশংসনীয় কর্মকাণ্ড ও ভূমিকা পালন করে এলেও ফেনীর মতো কিছু স্থানের কতিপয় পুলিশ সদস্যের কারণে পুরো বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। এ বিষয়গুলো পুলিশ সদর দপ্তর গুরুত্ব দিয়ে দেখছে।

গত বৃহস্পতিবার বিকালে ফেনীতে অবস্থান করা পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (মিডিয়া) এসএম রুহুল আমিন স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, দুদিন ধরে তিনি ও তার টিম ফেনীর সোনাগাজীসহ বিভিন্ন এলাকায় কাজ করছেন। মূলত এখানকার পুলিশ কর্মকর্তা বা সদস্যদের নানা কর্মকাণ্ড, কর্তব্যে গাফিলতি বা অবহেলাসহ নানা অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করা হচ্ছে।

ডিআইও ১, পরিদর্শক শাহিনুজ্জামান (বা থেকে প্রথম)

এখান থেকে প্রাপ্ত তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য একটি সুপারিশমালা জমা দেওয়া হবে বলে জানান তিনি। স্থানীয়দের অভিযোগ, মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে শ্লীলতাহানি ও পরবর্তীতে নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনায় পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে অবহেলা বা গাফিলতি এবং আসামিদের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার মতো নানা অভিযোগ উঠেছে। নুসরাতের ঘটনা ছাড়াও ইতিপূর্বেও বেশ কিছু ঘটনায় স্থানীয় পুলিশ বিতর্কিত ভূমিকা পালন করেছে বলে জানা গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে ফেনী জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ওসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করা রাশেদ খান চৌধুরী এক যুগের বেশি সময় ধরে এই একই জেলায় ঘুরেফিরে নানা পদে দায়িত্ব পালন করছেন। ২০০৪ সালে ফেনী মডেল থানায় পিএসআই হিসেবে যোগদান করেছিলেন তিনি। এর কয়েক বছর পর পরিদর্শক পদে পদোন্নতি পেলে পাশ্ববর্তী নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ থানায় অল্প কিছুদিন ছিলেন। সেখান থেকে ফের চলে আসেন ফেনী মডেল থানার অপারেশন অফিসার হিসেবে। এরপর জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ওসি, সেখান থেকে জেলার ছাগলনাইয়া থানার ওসি, তারপর ফেনী মডেল থানার ওসি এবং সর্বশেষ বর্তমানে জেলা ডিবি পুলিশের ওসির দায়িত্ব পালন করছেন রাশেদ খান চৌধুরী।

ডিবি ওসি রাশেদ খান চৌধুরী

অন্যদিকে ফেনী মডেল থানার বর্তমান ওসি আবুল কালাম আজাদ প্রায় সাত বছর ধরে একই জেলায় কাজ করছেন। এর আগেও ২০০১ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকারের সময় তাদের আস্থাভাজন হিসেবে দীর্ঘদিন ওই জেলার দাগনভূঁইয়া থানায় এসআই পদে কাজ করেন তিনি। ২য় দফায় এবার ওসির দায়িত্ব পাওয়ার আগে ফেনী মডেল থানাতেই পরিদর্শক (তদন্ত) পদে নিয়োজিত ছিলেন। তার আগে জেলা ডিবি পুলিশের ওসি ও দাগনভূঞা থানার ওসির দায়িত্ব পালন করেন।

সোনাগাজী মডেল থানার বর্তমান পরিদর্শক (তদন্ত) কামাল হোসেনও কয়েক বছর ধরে এ জেলায় রয়েছেন। মাঝখানে অল্প কিছুদিন চাঁদপুরে থাকলেও ঘুরেফিরে ফেনীতেই চলে আসেন তিনি। প্রায় নয় বছর ধরে ফেনীতে বিভিন্ন পদে চাকরি করছেন জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ডিআইও-১ পরিদর্শক শাহিনুজ্জামানও। প্রথমে ফেনী মডেল থানায় এসআই হিসেবে যোগ দিলেও পদোন্নতির পরও ঘুরেফিরে একই জেলায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন। তবে মাঝখানে এক বছর জাতিসংঘ শান্তি মিশনে ছিলেন তিনি। এ রকম আরও অনেক পুলিশ কর্মকর্তা বা সদস্য আছেন যারা দীর্ঘদিন ধরেই ফেনী জেলায় চাকরি করছেন। এ ছাড়া নুসরাতের ঘটনার পর প্রত্যাহারকৃত সোনাগাজী থানার ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনও ফেনীতে ছিলেন প্রায় ছয় বছর। সোনগাজীর আগে ছাগলনাইয়া থানার ওসি এবং তার আগে ফেনী মডেল থানার ওসির দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

পরিদর্শক (তদন্ত) কামাল হোসেন

একই অবস্থা সদ্য হাইওয়ে পুলিশে বদলি হওয়া ফেনীর সাবেক সহকারী পুলিশ সুপার (বিশেষ শাখা) আমিনুল ইসলামেরও। বর্তমান সরকারের টানা ৩ বারের এ শাসনামল (মাঝখানে কিছু সময়) ছাড়া ফেনীতেই ছিলেন তিনি। ফেনী মডেল থানার ওসি হিসেবে এ জেলায় আগমন ঘটলেও গত ইউপি নির্বাচনের আগের নির্বাচনে বিতর্কিত ভূমিকার জন্য শাস্তিমূলক বদলি হওয়ার কিছুদিন পরই পুনরায় ফিরে আসেন ছাগলনাইয়া থানার ওসি হিসাবে।

এপর এএসপি হওয়ার পর গত একবছর আগে বদলির আদেশ পেয়েও তা উপেক্ষা করে ফেনী ছাড়েননি তিনি। জেলা পুলিশের এ শক্তিশালী সিন্ডিকেটের অন্যতম ভূমিকা পালন করত এ আমিনুল। কয়েকদিন আগে হাইওয়ে পুলিশে গিয়েও ফেনীর এ সিন্ডিকেটের সাথে নিজের সম্পৃক্ততা জিইয়ে রাখতে চাইছেন আমিনুল।

এএসপি আমিনুল

স্থানীয়দের তথ্যমতে, ফেনী জেলা পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তা পুলিশ সুপার (এসপি) এসএম জাহাঙ্গীর আলম সরকার অন্যদের মতো দীর্ঘদিন ধরে না থাকলেও পদমর্যাদাসহ নানা কারণে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে তার গভীর সখ্যতা গড়ে উঠেছে। অনেক সময় এসপি জাহাঙ্গীরকে ফেনীতে বিভিন্ন রাজনৈতিক সভা-সেমিনারে রাজনীতিকদের মতো বক্তব্য দিতেও শুনেছেন বাসিন্দারা। উভয় পক্ষের পারিবারিক আচার-অনুষ্ঠানে মেলামেশা চলছে চোখে পড়ার মত। এ কারণে রাজনৈতিক নেতাদের পছন্দ-অপছন্দের বাইরে তেমন কিছুই করতে চান না বলেও অভিযোগ করেন সাধারণ মানুষ। তবে এ ব্যাপারে কথা বলতে তার কার্যালয়ে দুদিন গিয়েও সাক্ষাৎ পাওয়া যায়নি। এমনকি সরকারি নম্বরে অনেকবার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি।

এসব অপকর্মে প্রশাসন ও প্রভাবশালীরা একাট্টা

অভিযোগ আছে, ফেনীর অলিখিত গডফাদার, যিনি দোর্দন্ত প্রতাপশালী, তার ছত্রছায়াতেই পুলিশ এবং জেলা-উপজেলা প্রশাসন সব কাজ করেন। কিন্তু জীবনের ভয়ে ওই গডফাদারের নাম কেউ মুখে আনেন না।

ফলে এখানে চলছে অন্যরকম এক শাসনব্যবস্থা। স্থানীয় পুলিশ-প্রশাসন, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালীরা মিলে মিশে নিজেদের মতো করে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। প্রভাবশালী এই ‘সিন্ডিকেটের’ ভয়ে-আতঙ্কে রয়েছে সাধারণ নিরীহ মানুষরা। ধর্ষণ, হত্যা, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও হামলা-মামলাসহ নানাভাবে নাজেহাল হয় এখানকার নাগরিক অধিকারবঞ্চিত সাধারণ মানুষ। কোনো কারণে কেউ অন্যায়ের প্রতিবাদ করলেই বিপদে পড়তে হয়, এমনকি প্রাণও যায়। যেমনটি হয়েছে ফেনীর সোনাগাজীতে মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির ক্ষেত্রেও। সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলেও জানা গেছে এসব ক্ষোভ ও অভিযোগের কথা।

স্থানীয়দের অভিযোগ, ফেনীতে ধারাবাহিকভাবে ঘটা নৃশংসতা, হানাহানি ও বর্বরতার নেপথ্যে বিচারহীনতা বা অভিযোগের যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়া। কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অপকর্মগুলোর নেপথ্যে ওই প্রভাবশালী সিন্ডিকেট ও পুলিশ একাকার হয়ে কাজ করে থাকে। ফলে কোনো অপরাধ বা অন্যায়ের বিরুদ্ধে ভুক্তভোগীরা প্রতিবাদ করলেও প্রতিকারের বদলে চরম হয়রানির শিকার হতে হয়।

স্থানীয়দের অভিযোগ, পুলিশের কিছু কর্মকর্তা, জেলা-উপজেলা প্রশাসনের কতিপয় কর্মকর্তা এবং রাজনৈতিক কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি মিলেমিশে দীর্ঘদিন ধরেই নানা অপকর্মে মদদ দিয়ে আসছে। স্থানীয় পুলিশ, প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা একসঙ্গে মিলে জেলার স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসাসহ সরকারি-বেসরকারি প্রায় সব ধরনের প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ, টেন্ডার ও আর্থিক বিষয়সহ সব কিছুই নিয়ন্ত্রণ করে আসছে।

এই শক্তিশালী সিন্ডিকেটের কারণে এসব প্রতিষ্ঠান ও কর্তাব্যক্তিদের নামে বিভিন্ন সময় আপত্তিকর অভিযোগ উঠলেও সেগুলো ধামাচাপা পড়ে যায়। মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির ঘটনা ছাড়াও এর আগে নিশাত নামে এক ছাত্রীর সঙ্গেও অসৌজন্যমূলক আচরণের অভিযোগ ওঠে সোনাগাজীর সেই আলোচিত ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে। অভিযোগ ওঠার পর কয়েকদিনের মধ্যেই সেটি ধামাচাপা দিয়ে দেয় শক্তিশালী এই সিন্ডিকেট।

একাধিক সূত্রে জানা গেছে, রাফীর ঘটনায় আপাতদৃষ্টিতে অধ্যক্ষ সিরাজের নির্দেশে তার অনুগত কয়েক ছাত্র ও শিক্ষক মিলে বর্বরতা চালালেও নেপথ্যে রয়েছে বড় পরিকল্পনা ও মদদদাতা। কেনোনা রাফী হত্যার ঘটনায় গ্রেফতারকৃত শাহাদাত হোসেন শামীম ইতোমধ্যেই আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে বলেছে, ঘটনার পরপরই সাইক্লোন শেল্টারের নিচে নেমে সে সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মাদ্রাসাটির ব্যবস্থাপনা কমিটির সহসভাপতি রুহুল আমিনকে ফোন করে। রাফিকে পোড়ানোর কথা শামীম জানালে রুহুল আমিন তাকে বলে, ‘আমি জানি, তোরা এখন পালিয়ে যা।’ এ ছাড়া এ সংক্রান্ত একটি কলরেকর্ডও পেয়েছে মামলার তদন্তকারী সংস্থা পিবিআই।

এরই মধ্যে পিবিআই রুহুল আমিনকে গ্রেফতারও করেছে। শনিবার (২০ এপ্রিল) তাকে আদালতে হাজির করে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। সোনাগাজীর মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাতকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার পেছনের অন্যতম কারিগর এই রুহুল আমিন। একসময় পেটের তাগিদে সৌদি আরব চলে যান। সেখানে ট্যাক্সি চালিয়ে অর্থ উপার্জন করতেন। কোন রকমে চলতো তার সংসার। আর এখন তিনি কোটিপতি। বিতর্কিত এই আওয়ামী লীগ নেতা ও সোনাগাজী সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির (সদ্য বাতিলকৃত) সহসভাপতি ছিলেন। রাজনীতিতে প্রবেশ জাতীয় পার্টির হাত ধরে। অল্পদিনে তিনি দল পরিবর্তন করে উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতির পদ দখল করেন।

এক পর্যায়ে সভাপতির অনুপস্থিতিতে বাগিয়ে নেন দলের উপজেলা শীর্ষ পদ। চাঁদাবাজি, বালু মহালের নিয়ন্ত্রণসহ অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। বিভিন্ন সময়ে দলের নেতা-কর্মীরাও তার রোষানলের শিকার হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। নুসরাত হত্যার ঘটনায় শুক্রবার বিকালে রুহুল আমিন গ্রেফতার হওয়ার পর মুখ খুলতে শুরু করেছে স্থানীয় লোকজন। উঠে আসছে তার অপকর্মের ইতিহাস। জানা যায় রুহুল আমিনের অঘোষিত রাজত্বের ফিরিস্তি। সোনাগাজী উপজেলার চরচান্দিয়া ইউনিয়নের উচিয়াঘোনা কেরানী বাড়ির কোরবান আলীর ছেলে রুহুল আমিন। পড়াশোনা করেছেন মাত্র তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত।

যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বড় ভাই আবুল কাশেম স্থানীয় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী আরেক ভাই আবু সুফিয়ানও আমেরিকায় যুবদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে জানান স্থানীয়রা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্র জানায়, এক সময় জাতীয় পার্টির সদস্য ছিলেন রুহুল আমিন। ১৯৯৭ সালে উপজেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ফয়েজুল কবিরের হাতে এক সমাবেশে ফুল দিয়ে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন।

২০০১ সালে চলে যান সৌদি আরব। সেখানে দীর্ঘ ৯ বছর ট্যাক্সি চালিয়ে অর্থ উপার্জন করেছেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসলে ফের সোনাগাজীতে ফিরে আসেন রুহুল আমিন। দেশে ফিরেই দলে সক্রিয় হতে তৎপরতা চালান। ২০১৩ সালে উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনের আগে কাউন্সিলর মনোনীত হন। অনেকটা আকস্মিকভাবে ২০১৫ সালে সোনাগাজী ছাবের পাইলট হাই স্কুলের পরিচালনা কমিটির সভাপতি মনোনীত হন।

এখান থেকেই শুরু হয় তার নানা অপকর্ম। ডালপালা বিস্তার শুরু করে ক্ষমতার প্রভাব বলয়। রুহুল আমিন উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি থাকা অবস্থায় দলের সভাপতি ফয়েজুল কবিরের উপরও চলে নানা নিপীড়ন। এসবের পেছনে কলকাঠি নাড়েন রুহুল আমিন। এক পর্যায়ে অতিষ্ঠ হয়ে ফয়েজুল কবির এলাকা ছেড়ে চট্টগ্রামে অবস্থান নেন। ২০১৮ সালের শুরুতে উপজেলা আওয়ামী লীগের এক সভায় সহসভাপতি রুহুল আমিনকে উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি করা হয়।

গত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তাকে দলের সভাপতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সোনাগাজী উপজেলায় আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ পদ পাওয়ার পর আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। রুহুল আমিন গড়ে তোলেন নিজস্ব বাহিনী। ছোট ফেনী নদীর সোনাগাজীর মুহুরী প্রকল্প অংশের একটি বালু মহল ও ছোট ফেনী নদীর সাহেবের ঘাট এলাকায় আরেকটি বড় বালু মহল দখলে নেন। বালু মহল দুটি থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে রুহুল আমিন চক্র। যদিও একসময় এ দুটি বালু মহল ছিল সদ্য সাবেক এমপি রহিম উল্লাহর লোকজনের নিয়ন্ত্রণে।

এ ব্যাপারে গতকাল শনিবার কান্নাজড়িত কণ্ঠে রহিম উল্লাহ বলেন, জেলা প্রশাসন থেকে ছয় একর জায়গা প্রায় ৩০ লাখ টাকা দিয়ে ইজারা নেয়ার পরও আমাকে জোর করে উচ্ছেদ করে দেয়া হয়। আমার বালু মহল দখলে নেয় রুহুল আমিন ও তার ক্যাডার বাহিনী। ওই বালু মহলে প্রায় ১ কোটি ৬০ লাখ টাকার বালু ছিল, সেগুলোও লুটে নেয় তারা। এসবের প্রতিবাদ করায় আমার ও পরিবারের সদস্যদের ওপর নানা সময়ে হামলা করা হয়েছে। আমার গাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল, বাড়ি ও জমিতে হামলা করা হয়।

সোনাগাজী, জিরো পয়েন্ট ও নানা জায়গায় হামলা হয়েছে। মানুষ এখনো সেসবের সাক্ষী। রুহুল আমিনের হামলা-নির্যাতনে আমি এখন এলাকা ছাড়া। এসবের প্রতিবাদ করতে গিয়ে আমার ভাই ও ভাতিজাকে হারাতে হয়েছে। প্রবাস জীবনের কষ্টের টাকায় সোনাগাজীতে প্রায় শত কোটি টাকার সম্পদ কিনেছি। ভয়ে এলাকায় যেতে পারি না। রুহুল আমিনের হামলা-নির্যাতনের বিষয়ে কখনো অভিযোগ করেছেন কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, বার বার দলের সর্বোচ্চ পর্যায়ে অভিযোগ করেছি। কিন্তু কেউ বিচার করে নাই। আমি এখন আর কারো কাছে বিচার চাই না।

সোনাগাজী উপজেলার পশ্চিম চরচান্দিয়া এলাকায় ছোট ফেনী নদীর উপর নির্মাণাধীন সাহেবের ঘাট ব্রীজ এলাকায় ইজারা এলাকার বাইরে বালু উত্তোলনের অভিযোগে গত বছরের ২৭ আগস্ট বিকালে ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিচারক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সোহেল পারভেজ ও উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) শাহরীন ফেরদৌসী অভিযান চালায়। সে সময় ভ্রাম্যমাণ আদালত চলাকালে ঘটনাস্থলে বালু উত্তোলনকারী কাউকে না পেয়ে ড্রেজার মেশিনটি ধ্বংস করা হয়। একটি ড্রেজার মেশিনের সংযোগ তার কেটে দেয়া হয় এবং ড্রেজার মেশিনের ইঞ্জিনে এক কেজি লবণ ও এক কেজি চিনি ঢেলে দিয়ে অকেজো করে দেন। ওই ঘটনার পরদিন স্থানীয় ইউএনও সোহেল পারভেজ ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) শাহরীন ফেরদৌসীর বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করে উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও বালু মহাল ইজারাদার মো. রুহুল আমিন।

বালু উত্তোলনের ড্রেজার মেশিনটি অকেজো করে দেয়ার অভিযোগ এনে আনুমানিক ২২ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে উল্লেখ করে ফেনীর সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ জাকির হোসাইনের আদালতে ১৬৪, ৪২৭ ও ৫০৬ ধারায় একটি মামলা দায়ের করেন। পরে আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্তের আদেশ দেয়। মামলার পর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের কাজে আদালতের হস্তক্ষেপ ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তাতের ঝড় উঠলে ফেনী-২ আসনের সংসদ সদস্যের হস্তক্ষেপে ও জেলা প্রশাসকের মধ্যস্ততায় মামলা প্রত্যাহার করে নেয় রুহুল আমিন।

এদিকে প্রভাবশালী অধ্যক্ষ সিরাজকে রাফির ঘটনা ছাড়াও বিভিন্ন ক্ষেত্রে রক্ষা করতে এবং রাফির হত্যাকাণ্ডকে আত্মহত্যা বলে চালাতে স্থানীয় পুলিশ, প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতা রুহুল আমিন প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে কাজ করেছেন বলে বিভিন্ন তদন্ত কমিটির পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে।

এমনকি এই রুহুল আমিনের পেছনেও রয়েছে জেলা আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রভাবশালী নেতার মদদ। এ হিসেবেও দেখা যায়, স্থানীয় পুলিশ-প্রশাসন ও প্রভাবশালীরা মিলেমিশেই সব কিছু চালিয়ে যাচ্ছেন ফেনীতে।

সোনাগাজীর আট নম্বর আমিরাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, টাকা আর তোষামোদিতে চলে ফেনীর স্থানীয় পুলিশ বা প্রশাসন। এটি একটি শক্তিশালী বলয়। যেখানে রাজনৈতিক, পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের পদস্থ লোকজন রয়েছে। এই প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় অধ্যক্ষ সিরাজের মতো অনেকেই নানা অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। কারও কিছু বলার উপায় নেই। প্রতিবাদ করলেই চারদিক থেকে বিপদ আসতে থাকে।

অপর দিকে পুলিশের বিরুদ্ধে স্থানীয়দের অভিযোগ, গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে এখানে ব্যাপক হারে গণগ্রেফতার বা আটক-বাণিজ্যের ঘটনা ঘটে। ওই সময় ফেনীর হার্ডওয়্যার ব্যবসায়ী সাখাওয়াত হোসেন ও আবদুর রহিমকে ফেনী সদর থানা পুলিশ থানায় তিনদিন আটকে রাখে। এরপর দেনদরবার করে ৩ লাখ টাকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয় সাখাওয়াত ও রহিমকে।

এ ছাড়া অভিযোগ রয়েছে, ‘স্থানীয় জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত’ কপিল উদ্দিন নামে এক যুবককে গ্রেফতারের পর তাকে ক্রসফায়ার দেয়ার হুমকি দিয়ে তার পরিবারের কাছে ১২ লাখ টাকা দাবি করে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ। পরবর্তী সময়ে দেনদরবারের মাধ্যমে পরিবারের কাছ থেকে ৮ লাখ টাকা নিয়ে কপিলকে কারাগারে পাঠানো হয়। দুই মাস আগে ভিআইওপি ব্যবসায়ী সন্দেহে এক ব্যক্তির কাছ থেকে ৫ লাখ নিয়ে তাকে ফেনী মডেল থানা থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এসব অভিযোগের ব্যাপারে ফেনী শহরে ওপেনসিক্রেট আলোচনাও হয়। তবে জড়িত কর্মকর্তাদের বিষয়ে সহসা কেউ মুখ খোলে না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এক সময়ের বিএনপি ও জামায়াত অধ্যুষিত ফেনীতে এখন প্রায় সবাই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাতার নিচে অবস্থান নিয়েছে। প্রকৃত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের চেয়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিএনপি-জামায়াত থেকে আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশ করা নেতাকর্মীদের প্রভাবই বেশি। তাদের সেই সুযোগ করে দিয়েছে জেলার নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের আওয়ামী লীগের একাধিক ক্ষমতাধর নেতা।

সংশ্লিষ্টদের তথ্য মতে, ফেনীর লোকজনের অন্যতম প্রধান আয়ের উৎস বৈদেশিক রেমিট্যান্স। অধিকাংশ পরিবার থেকেই কেউ না কেউ বিদেশে নানা কর্মে রয়েছে। ফলে বিদেশি টাকার প্রবাহও এখানে বেশি। এ কারণেই এখানে আধিপত্য নিয়ে কোন্দল, খুন-ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, হানাহানির ঘটনাও বেশি ঘটে। আর এসবের নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করে ফেনীর প্রভাবশালী চক্র।

সড়কে চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্ম চালিয়ে যাওয়ার জন্য জেলার বিভিন্ন থানার ওসিদের মদদে একটি চালু করা হয়েছে সমিতি । এছাড়া শহরে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও ওসিরা নিজস্ব টোকেন বানিয়ে তাদের চলাচলের লাইসেন্স চালু করেন।

জানা যায়, এক একটি উপজেলা শহরে অবৈধভাবে চলে প্রায় ৪০০-৫০০ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। প্রতিটি রিকশা থেকে দৈনিক ‘ওইসব সমিতি’ এর ব্যানারে দশ টাকা করে চাঁদা নেওয়া হয়। যার সিংহভাগ যায় ওসিদের পকেটে। এর বাইরে ভিন্ন কিছু ঘটলে থানায় এনে রিকশা আটকে রাখা হয়।

এ বিষয়ে সোনাগাজী পৌরসভার মেয়র অ্যাডভোকেট রফিকুল ইসলাম খোকন বলেন, ‘ওসি দশ টাকা করে চাঁদা নেওয়ায় তার সঙ্গে আমার মতবিরোধ হয়েছে। আমি সব ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। পরবর্তীতে তিনি আবারও তা চালু করেছিলেন।’

অটোরিকশা চালক মাঈনউদ্দিন ও জয়নাল আবদীন বলেন, ‘যখন মাগরিবের আজান দেয়, তখন ওসি মোয়াজ্জেমের জন্য টাকা তোলা শুরু হয়। ওসি মোয়াজ্জেম শুধু রিকশাচালক নয়, হইন্নি-পইন্নি কিছুই মানে না। সবার থেকেই টাকা খায়।’

রিকশাচালক মোশারফ হোসেন বলেন, প্রতিদিন ১০ টাকা করে চাঁদা দিচ্ছে। এসব চাঁদাবাজির জন্য ওসিদের নিজস্ব একটি টোকেনও রয়েছে। সেটি যার কাছে থাকবে তাকে প্রতিদিন ১০ টাকা করে চাঁদা দিতে হবে। আর যার কাছে থাকবে না তাকে রিকশা চালাতে দেওয়া হয় না।’

‘সোনাগাজী রিকশা শ্রমিক ও মালিক সমিতির’ সাধারণ সম্পাদক ও লাইনম্যান মো. মাসুদ বলেন, ‘অটোরিকশা থেকে যে টাকা তোলা হয় তা থানার ক্যাশিয়ারের মাধ্যমে ওসির কাছে পৌঁছে যায়। আমি শুধু টাকা তুলে জমা দেই।’

‘সোনাগাজী রিকশা শ্রমিক ও মালিক সমিতির’ ক্যাশিয়ার মো. ইসমাইল হোসেন জানান, এ ঘটনা পেপার-পত্রিকায় লেখালেখি হলে আমাদের রিকশা চালানো বন্ধ করে দিবে। তখন আমরা না খেয়ে থাকতে হবে। আমরা চাঁদা দিয়ে হলেও চাই রিকশা চালু থাকুক।

সে আরও জানান, যিনি লাইনম্যানের দায়িত্ব পালন করেন তাকে মাসে ৯ হাজার টাকা দিতে হয়। যিনি রেজিস্ট্রার লেখেন, তাকে ৬ হাজার টাকা দিতে হয়। সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক পায় মাসে দুই হাজার টাকা, ক্যাশিয়ার পায় এক হাজার পাঁচশ টাকা। এই কমিটির সভাপতি লিটন ও সাধারণ সম্পাদক মো. মাসুদ।

সোনাগাজী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি, তদন্ত) মো. কামাল হোসেন বলেন, ‘থানায় রিকশার চাঁদা জমা নেওয়ার জন্য কোনো ক্যাশিয়ার নেই। আগের ওসির চাঁদা তোলার বিষয়টি আমি জানি না।’

অন্যদিকে এ ঘটনায় সোনাগাজী থানার ওই সময়ের ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন রাফির ঘটনাটি আত্মহত্যার নাটক সাজানোর চেষ্টা করেন। আবার ওসির এই অপতৎপরতার পক্ষেই রাফির পরিবারকে দোষারোপ করে পুলিশ সদর দপ্তরে চিঠি দেন ফেনীর পুলিশ সুপার (এসপি) এসএম জাহাঙ্গীর আলম সরকার।

মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) পিকেএম এনামুল করিমের কাছে লিখিত অভিযোগ গেলেও তিনিও এ বিষয়ে কোনো সুরাহা করেননি। পাল্টা মামলার হুমকি দেন নুসরাতের মাকেই।

ন্যায়বিচার পেতে ফেনীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিএম- রাজস্ব) পিকে এনামুল করিমের কাছে গিয়েছিলেন নুসরাত জাহান রাফি ও তার মা শিরিন আক্তার। কিন্তু ন্যায়বিচারের পরিবর্তে সে সময় নুসরাতের বিরুদ্ধে ‘নাটক’ সাজানোর অভিযোগ করেন তিনি। এ ছাড়া নুসরাতের মৃত্যুর আগে তার মা শিরিন আক্তারকে হুমকি দিয়ে এডিএম বলেছিলেন, ‘আপনারা প্রিন্সিপাল সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে যে মামলা করেছেন, তা প্রমাণ করতে না পারলে আপনাদের বিরুদ্ধে প্রিন্সিপালের লোকজন ৫০ লাখ টাকার মানহানি মামলা করবে।’

জেলার সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার এমন কথায় মানসিকভাবে আরও ভেঙে পড়েন নুসরাত। শিরিন আক্তার আরও বলেন, ‘অধ্যক্ষের কক্ষে আমার সামনে নুসরাত অজ্ঞান হয়ে গেলে তার মুখে পানি ছুড়ে মেরেছিলেন সোনাগাজী থানার এসআই ইকবাল।’

অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলার লোকজনের দেয়া আগুনে পুড়ে নুসরাত জাহান রাফির মৃত্যুর পর গত ১৮ এপ্রিল তার মা পুলিশের কাছে দেয়া জবানবন্দিতে এসব তথ্য তুলে ধরেন। জবানবন্দিতে শিরিন আক্তার বলেন, ‘৪ এপ্রিল বেলা ১১টার দিকে আমি, আমার মেয়ে রাফি, ছেলে নোমান, মাদ্রাসা কমিটির সভাপতিসহ ফেনী জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিএম) পিকে এনামুল করিমের অফিসে গিয়ে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগটি জানাতে চাই। তখন এডিএম বলেন, এখন কেনো এসেছেন? আপনারা তো মামলা করে ফেলেছেন। মামলা করার আগে আসতেন, তা হলে দেখতাম কী করা যায়। এখন মামলায় যা হবে তা-ই হবে।

তখন রাফি এডিএমকে বলেন, আপনি আমার বাবার মতো। আপনি আমার কথাগুলো শোনেন। রাফি মাদ্রাসার প্রিন্সিপালের বিরুদ্ধে তার অভিযোগটি জানানোর চেষ্টা করেন এডিএমকে। তখন এডিএম বলেন, প্রিন্সিপাল তো খারাপ, তা সবাই জানে। তুমি তার কাছে গেছ কেনো? উত্তরে রাফি বলেন, আমি তো ইচ্ছা করে যাইনি। পিয়নকে দিয়ে প্রিন্সিপাল আমাকে ডেকে নিয়ে গেছেন। তখন এডিএম বলেন, গেছই যখন, তখন হজম করতে পারলে না কেন? তোমার বাবাকে মাদ্রাসায় বসানোর জন্য এ রকম নাটক সাজিয়েছো?’

এদিকে জবানবন্দিতে দেওয়া নুসরাতের মায়ের এসব তথ্য অস্বীকার করে এডিএম এনামুল করিম গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় সাংবাদিকদের বলেন, ‘ছি! আমি এসব কিছু বলিনি। আমি তো মামলা করায় তাদের ধন্যবাদ দিয়েছিলাম। তারা যেন বিচার পান, সে কথা বলেছিলাম।’

এডিএম ছাড়াও নুসরাতের মা শিরিন আক্তারের জবানবন্দিতে উঠে এসেছে অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলার পক্ষ নিয়ে সোনাগাজী থানার এসআই ইকবাল হোসেনের কর্মকাণ্ডের কথা।

ওডি/এআর/আরবি

অপরাধের সূত্রপাত কিংবা ভোগান্তির কথা জানাতে সরাসরি দৈনিক অধিকারকে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড