• মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৪ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

নুসরাত হত্যায় আ. লীগ নেতা রুহুল আমিনের আয়নাবাজি

  অধিকার ডেস্ক    ২১ এপ্রিল ২০১৯, ১৩:১৯

নুসরাত জাহান রাফি হত্যা
বামে আটক রুহুল আমিন ও ডানে হত্যাকাণ্ডের শিকার নুসরাত (ফাইল ফটো)

মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় অধ্যক্ষ সিরাজের মূল আশ্রয়দাতা স্থানীয় উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির সহ-সভাপতি (সদ্য বিলুপ্ত) রুহুল আমিনের জড়িত থাকার বিষয় নিয়েও বার বার ইঙ্গিত উঠছে। তবে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণে একের পর এক আয়নাবাজি করেন রুহুল আমিন।

প্রথমে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণে স্থানীয়দের অভিযোগকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে নুসরাতের জানাজায় অংশ নেন রুহুল আমিন। সেদিন জানাজায় তাকে দেখে অবাক হয়েছিলেন স্থানীয়রা। তার আচরণও ছিল সন্দেহজনক। শুধু জানাজায় অংশগ্রহণই নয়, ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা যখন নুসরাতের বাড়িতে তার পরিবারকে দেখতে যান, সেদিনও ছিলেন রুহুল আমিন। করেন কবর জিয়ারত। নুসরাতের বাড়িতে যান ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন হাজারীসহ দলের নেতা-কর্মীরা। এসময় সঙ্গে ছিলেন রুহুল আমিনও। এর পরের দিন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার আবদুল মান্নান নুসরাতের বাড়িতে তার স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে গেলে সেদিনও ফেনী জেলা প্রশাসনের কর্মকতাদের সঙ্গে দেখা যায় তাকে।

তবে তার রহস্যজনক কর্মকাণ্ডেই হয়ত তার মূল চেহারাটা ধরতে পেরেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক প্রটোকল অফিসার ও ফেনী ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি আলা উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম। তিনি নুসরাতের জানাজায় দেওয়া বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘আসামিরা খুব বেশি দূরে নয়, এ জানাজার মাঠেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছেন। নুসরাত হত্যাকাণ্ডের আসামিরা যদি ৪০ হাত মাটির নিচেও থাকে, তাদের সেখান থেকে বের করে বিচারের আওতায় নিয়ে আসা হবে।’

গত শুক্রবার (২০ এপ্রিল) রুহুল আমিনকে গ্রেফতারের পর শনিবার (২১ এপ্রিল) পাঁচদিনের রিমান্ডের পর ফেনীর সচেতন মহল এবং সোনাগাজীর স্থানীয়দের ধারণা আরও পাকাপোক্ত হয়। এ ঘটনায় ইন্ধন ছিল আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমিনের। যেহেতু মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজের খুঁটির জোরে ছিলেন এ রুহুল আমিন। স্থানীয়রা বলছেন, রুহুল আমিন এ ধরনের ‘চাতুর্য’ করে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন, তিনি এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হয়নি। তার দিকে সন্দেহের তীর পাকাপোক্ত হয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনেরও (পিবিআই)। এর ফলশ্রুতিতেই গ্রেফতার হন রুহুল আমিন।

শনিবার বিকালে তাকে ফেনীর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শরাফ উদ্দিন আহমেদের আদালতে তুলে সাতদিনের রিমান্ড আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও পিবিআই-এর পরিদর্শক শাহ আলম। আদালত তার পাঁচদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এ হত্যাকাণ্ডে গ্রেফতার হওয়া এজাহারের আসামি নূর উদ্দিন ও শাহাদাত হোসেন শামীম আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে উঠে আসে রুহুল আমিনের নাম। কিলিং অপারেশনের পর কিলাররা যখন রুহুল আমিনকে ফোন করেন, তখন রুহুল আমিন বলেন, আমি জানি তোমরা চলে যাও।

নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান বলেন, গত ২৭ মার্চ তার বোন নুসরাত শ্লীলতাহানির অভিযোগ নিয়ে যাওয়ার পর সিরাজ তার মাকে গালিগালাজ করেছিলেন। সে সময় মাদ্রাসার পরিচালনা কমিটির সহ-সভাপতি রুহুল আমিনও উপস্থিত ছিলেন। তিনি থাকাবস্থায় অধ্যক্ষ এমন আচরণ করছিলেন। তার নির্লিপ্ততায় তখনও আমরা অবাক হয়েছিলাম। নুসরাতের ছোট ভাই রাশেদুল হাসান রায়হান বলেন, গত ২৭ মার্চের ঘটনার পর মাদ্রাসার ব্যবস্থাপনা কমিটি বিচারে দ্রুত পদক্ষেপ নিলে, আমার বোনের এমন মর্মান্তিক মৃত্যু হতো না। তাৎক্ষণিকভাবে যদি অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হতো, তবে ঘটনা এতো মর্মান্তিক পরিণতিতে যেতো না। এ বক্তব্যেও অভিযোগের তীর রুহুল আমিনের দিকে ছিল।

এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সিরাজের সঙ্গে রুহুল আমিনের ঘনিষ্ঠতার কথা সোনাগাজীর সবার মুখে মুখে। সিরাজই রুহুল আমিনকে কমিটিতে নেন। তবে নুসরাতের ঘটনা আলোচিত হতে থাকলে ভোল পাল্টিয়ে সিরাজের বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু করেন রুহুল আমিন। নুসরাতের কবর জিয়ারত করতে যান জেলা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। সেখানেও দেখা যাচ্ছে রুহুল আমিনকে। তার দিকে অভিযোগের ব্যাপারে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হলে তিনি বলেন, সাংবাদিকরা আমার বিরুদ্ধে লেখাতে আমার উপকার হয়েছে। আগে আমি গুছিয়ে কথা বলতে পারতাম না। এখন আমি মিডিয়ার সামনে গুছিয়ে অনেকক্ষণ কথা বলতে পারছি। এ বক্তব্যে তার দাম্ভিকমা প্রকাশ পেয়েছে বলেও মনে করছে স্থানীয়রা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নুসরাত হত্যা মামলার প্রধান আসামি সিরাজের খুঁটির জোর এ রুহুল আমিন। অধ্যক্ষ সিরাজ জামায়াতে ইসলামী থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পর খোলস পাল্টে হয়েছেন আওয়ামী লীগের সমর্থক। সুবিধা পেতে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতিকে নিয়েছেন পরিচালনা কমিটিতে। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, নুসরাত জাহান রাফিকে শ্লীলতাহানির অভিযোগে ধরা পড়লেও এর আগে এমন অনেক অভিযোগ ধামাচাপা দিয়েছেন তিনি। রুহুল আমিনের ভরসায় সিরাজের ঘনিষ্ঠ সহযোগিরা রাফির পরিবারকে হুমকি দিয়ে সফল না হয়ে তার শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয়।

স্থানীয়দের থেকে আরও জানা যায়, যে লোকটি (রুহুল আমিন) প্রাইমারি স্কুলের গণ্ডি পেরুতে পারেননি তিনি এখন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকায় দেশে কিছু করতে না পেরে একসময় পেটের তাগিদে সৌদি আরব চলে যান। সেখানে ট্যাক্সি চালিয়ে অর্থ উপার্জন করতেন। কোনো রকমে চলতো তার সংসার। আর এখন তিনি কোটিপতি। বিতর্কিত এ আওয়ামী লীগ নেতা ও সোনাগাজী সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির (সদ্য বাতিলকৃত) সহ-সভাপতি ছিলেন। রাজনীতিতে প্রবেশ জাতীয় পার্টির হাত ধরে। অল্পদিনে তিনি দল পরিবর্তন করে উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতির পদ দখল করেন।

এই রুহুল আমিনের বিরুদ্ধে রয়েছে আরও অসংখ্য অভিযোগ। তার গ্রেফতারের পর মুখ খুলছেন স্থানীয়রা। তারা বলছেন, সভাপতির অনুপস্থিতিতে রুহুল আমিন বাগিয়ে নেন দলের উপজেলা শীর্ষ পদ। চাঁদাবাজি, বালু মহালের নিয়ন্ত্রণসহ অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। বিভিন্ন সময়ে দলের নেতা-কর্মীরাও তার রোষানলের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ আছে।

সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা ফয়জুল কবির বলেন, ‘কাগজে-কলমে আমিই উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। আমিতো রিজাইন করিনি। আমাকে বাদ দিয়ে কোনো চিঠিও দেওয়া হয়নি। সাবেক সংসদ সদস্য রহিম উল্লাহকে সিনিয়র সহ-সভাপতি করা হয়েছিল। এরপর তার এবং জেলা কমিটির লোকজনের দাপটে প্রথমে আমি সক্রিয় হতে পারিনি। পরে রুহুল আমিন কিভাবে সভাপতি হয়েছেন তা আমার জানা নেই।

রুহুল আমিনের ব্যাপারে আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুর রহমান বিকম বলেন, ‘নুসরাতের মৃত্যুর ঘটনায় আমরা শোকাহত। এর সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠায় এরই মধ্যে সোনাগাজী পৌর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ও কাউন্সিলর মুকছুদ আলমকে বহিষ্কার করা হয়েছে। রুহুল আমিনের ব্যাপারেও অনেকে বলছেন। প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

উল্লেখ্য, নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় গত শুক্রবার (১৯ এপ্রিল) উপজেলার তাকিয়া বাজার থেকে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমিনকে আটক করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। পিবিআই ও আদালতের সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, গত রোববার গভীর রাতে মামলার আসামি নুর উদ্দিন ও শাহাদাত হোসেন শামীমের জবানবন্দিতে এ ঘটনায় রুহুল আমিনের সম্পৃক্ততার বিষয়টি জানা যায়। জবানবন্দিতে ১৩ থেকে ১৪ জনের নাম উল্লেখ থাকলেও এ ঘটনায় নামে-বেনামে প্রায় ২৫ থেকে ২৬ জন জড়িত।

আদালত সূত্র জানায়, জবানবন্দিতে দুই আসামি পুরো ঘটনার বর্ণনা দেয়। এতে মোট ২৫ থেকে ২৬ জনের সম্পৃক্ততার কথা ওঠে আসে। সবার নাম বলতে পারেনি তারা। এর সঙ্গে বাইরে থেকে যুক্ত অনেককে চিনতেন না তারা। ঘটনার পর শাহাদাত হোসেন শামীম মোবাইল ফোনে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির সহসভাপতি রুহুল আমিনকে ফোনে ‘কাজ হয়ে যাবার’ ম্যাসেজ জানায়। এ সময় রুহুল বলেন, ‘আমি জানি। তোমরা সরে যাও।’ নির্দেশ পাওয়ার পর আরো দুই একদিন তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে। এরপর নুরু ময়মনসিংহের ভালুকা ও শামীম মুক্তাগাছায় চলে যায়। একই সঙ্গে শুরু হয় একে আত্মহত্যা বলে প্রচারের চেষ্টা। এটি সমন্বয় করেন ওসি মোয়াজ্জেম ও রুহুল।

ওডি/এআর

অপরাধের সূত্রপাত কিংবা ভোগান্তির কথা জানাতে সরাসরি দৈনিক অধিকারকে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড