রফিকুল ইসলাম, বরিশাল
সাত বছর পূর্বে বরিশাল নগরীর বুক চিরে গড়ে উঠেছিল স্বপ্নের ফোর লেন। দীর্ঘ ৪ কিলোমিটারের এ মহাসড়কটি নিয়ে সাধারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষাও ছিল বেশ। এজন্য বরিশাল সিটি করপোরেশনের (বিসিসি) তৎকালীন পরিষদ ব্যয় করেছে প্রায় ২৫ কোটি টাকা। কিন্তু সেই ফোর লেনই এখন নগরবাসীর গলার কাটায় পরিণত হয়েছে।
অপরিকল্পিত এ সড়কের জন্য প্রতিনিয়তই ঝরছে একের পর এক প্রাণ। এছাড়া ফোর লেনের দুই পাশের লেন যে যেভাবে পেড়েছে দখল করে রেখেছে। এ দিকে, দীর্ঘ কয়েক বছর যাবত সংস্কার না হওয়ায় ফোর লেনে চলাচলও যেন দুরূহ হয়ে পড়েছে। ফলে ক্ষোভ বাড়ছে সাধারণের মাঝে। বিস্ময়কর ঘটনা হল এমন পরিস্থিতিতেও সড়কটির দায় কেউই নিতে চাচ্ছেন না।
বরিশাল নগর উন্নয়ন অধিদপ্তরের সিনিয়র প্লানার আসাদুজ্জামান বলেন, নগরীর মধ্য থেকে ফোর লেন মাস্টার প্লান বহির্ভূত। তাদের পরিকল্পনা ছিল নগরীর বাইরে গড়িয়ারপাড় থেকে হাইওয়ে যাবে। কিন্তু যখন এ সড়কটি করা হয় তখন পরিকল্পনায় ভুল ছিল। ফোর লেনে এভাবে ডিভাইডার হয় না। এ দিকে, সড়ক ও জনপথ বিভাগ এই সড়কেই নতুন করে (পদ্মা সেতু হয়ে পায়রা বন্দর) ফোর লেন করবে বলে শোনা যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০১১-১২ অর্থ বছরে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের আমতলার মোড় থেকে কাশিপুর সুরভী পেট্রোল পাম্প পর্যন্ত প্রায় ৪ কিলোমিটার সড়ক ফোর লেনে উন্নীত করা হয়। এ প্রকল্পে ব্যয় হয়েছিল ২৫ কোটি টাকা। সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র শওকত হোসেন হিরন তার অনুসারী একজন আওয়ামী লীগ নেতাকে ওই কাজের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। অভিযোগ রয়েছে কোনো একটি ফান্ডের অর্থ ব্যয় করার জন্য সে সময়ে লোক দেখানো ফোর লেন করা হয়। এর মাঝখানে ডিভাইডার আর কিছু ফুলগাছ রোপণ ছাড়া দৃশ্যমান কোনো কাজই করা হয়নি বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।
এ দিকে, সিটি করপোরেশন ও সওজ এর তথ্যমতে, ফোর লেন সড়ক নির্মাণের সাত বছর অতিবাহিত হলেও এটির কোনো সংস্কার করা হয়নি। যে কারণে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে সড়কটি। এর দুইপাশ বেদখল হয়ে আছে বিভিন্ন যানবাহন, দোকানপাট, নির্মাণ সামগ্রী আর ব্যক্তিমালিকানাধীন বিভিন্ন স্থাপনার মাধ্যমে। প্রায়শই আবার ফোর লেন দখল করে সভা সমাবেশও করা হয়। এছাড়া সংস্কারের অভাবে অধিকাংশ জায়গাই ভেঙে গেছে সড়কটির।
সোমবার (২১ অক্টোবর) সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ফোর লেনের কালু খাঁ সড়ক সংলগ্ন সিন্ডবি ১ নম্বর পুল (দরগাবাড়ি সংলগ্ন), সদর উপজেলা পরিষদের বিপরীতে, টিটিসির সামনের অংশ, টেক্সটাইল কলেজের সামনের অংশ, সুরভী পাম্প এলাকা এবং কলেজ রোডের সংযোগ মুখের সড়কটির বিভিন্ন অংশ খানাখন্দে ভরে গেছে। এ সময় উপজেলা পরিষদের বিপরীতে দেখা যায় একের পর এক গাড়ি ঝুঁকি নিয়ে চলছে।
একই কারণে চালকদেরও ক্ষুব্ধ হতে দেখা গেল। নগরীর টেম্পু মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আহমেদ শাহরিয়ার বাবু বলেন, ফোর লেনের বর্ধিত অংশ যান চলাচলের জন্য মোটেই উপযুক্ত নয়। প্রায়শই ঘটছে দুর্ঘটনা। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের বার বার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। তবুও যেন সড়কটি দেখার কেউ নেই।
সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের বরিশাল জেলার সাধারণ সম্পাদক কাজী এনায়েত হোসেন শিবলু বলেন, ফোর লেন নির্মাণে অর্থ বিনিয়োগ করা হয়েছে। কিন্তু জনগণের সুফল আসেনি। অপরকিল্পিতভাবে লোক দেখানো ফোর লেন হয়েছে। যার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় টাকা তসরুপ হয়েছে। গত কয়েক দিনে একের পর এক সড়ক দুর্ঘটনায় এই সড়কেই অনেক প্রাণ ঝরে গেছে। তিনি এসব মৃত্যুকে অস্বাভাবিক দাবি করে বলেন, অপরিকল্পিত ফোর লেনে এক ধরনের হত্যাযজ্ঞ চলছে। এর দায় কাউকে না কাইকে নিতেই হবে।
এ ব্যাপারে ফোর লেন সংলগ্ন বাসিন্দা ও বরিশাল শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যফ্রন্টের আহবায়ক অধ্যক্ষ মহসিন উল ইসলাম হাবুল জানান, ফোর লেন এখন নগরবাসীর জন্য গলার কাটায় পরিণত হয়েছে। তিনি প্রতিদিন এই সড়ক থেকেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করেন। অথচ এর বর্ধিত অংশ চলাচলের অযোগ্য। তিনি বলেন, মূল সড়কে উঠতে গেলেই ঘটছে দুর্ঘটনা। গত কয়েক সপ্তাহে তার বাড়ির সামনে দুইজন প্রাণ হারিয়েছে। এর দায় তো এড়ানো যাবে না।
অধ্যাপক হাবুল আক্ষেপ করে বলেন, প্রকল্পের ২৫ কোটি টাকা জনগণের কাজে আসেনি, লুটপাট হয়েছে। এসব বিষয় খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
সড়কটির ভয়াবহতা নিয়ে বলতে গেলে, গত মঙ্গলবার (১৫ অক্টোবর) বৈদ্যপাড়া সড়কের মুখে বিআরটিসির ডাবল ডেকারের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে দুইজন টেম্পুযাত্রী নিহত হয়েছেন। এছাড়া গত শনিবার (১৯ অক্টোবর) সাগরদী এলাকায় ট্রাকের সঙ্গে মাহিন্দ্রার সংঘর্ষে প্রাণ যায় মা-ছেলের। এর আগে চৌমাথা ও সদর উপজেলা চত্বরের সামনে দুর্ঘটনায় তাজা দুইটি প্রাণ ঝড়ে যায়। কি কারণে এভাবে দুর্ঘটনা ঘটছে এবং একই সঙ্গে গলার কাটায় পরিণত হচ্ছে এ ফোর লেন কিংবা এর ভবিষ্যৎ নিয়ে সকলেরই ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা রয়েছে।
এ ব্যাপারে বরিশাল সিটি করপোরেশনের (বিসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইসরাইল হোসেন জানান, নগরীর জনগণের জন্যই ফোর লেন করেছিলেন তৎকালীন মেয়র। এখন এটি কিভাবে সংস্কার করা যায় এজন্য সড়ক ও জনপথ বিভাগে (সওজ) সঙ্গে আলোচনা করা হবে।
একইভাবে বরিশাল সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) নির্বাহী প্রকৌশলী গোলাম মোস্তফা বলেন, ফোর লেন করার সময়ে সওজের অনুমতি নেয়নি সিটি করপোরেশন। এখন এই সড়কটি মহাসড়কের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ফোর লেনে উন্নীত হবে। তাই ফোর লেন সংস্কার করার কোনো চিন্তা-ভাবনা নেই। এটি নির্মাণে কোনো দায়ও নেই তাদের।
এ ব্যাপারে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের (বিএমপি) পরিদর্শক মো. সামসুল আলম বলেন, ফোর লেন নির্মাণ হয়েছে পরিকল্পনাহীনভাবে। নথুল্লাবাদ থেকে আমতলা মোড় পর্যন্ত সড়কটিতে ৪৮টি পকেট মুখ রাখা হয়েছে। বর্তমানে তারা এগুলো বন্ধ করে দিয়েছেন। পাশাপাশি মহাসড়কে যানবাহন নিয়ন্ত্রণে কুইক রেসপন্স টিম ইউনিট খোলা হয়েছে। এছাড়া মহাসড়কের বর্ধিত অংশ সংস্কার করে দেওয়ার জন্যও বলা হয়েছে। এ সময় তিনি বলেন, বর্ধিত অংশ বেহাল হওয়ায় মাঝে মধ্যেই পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে মূল মহাসড়কে উঠে আসে তিন চাকার যানবাহন। যে কারণে প্রায়শই বাড়ছে দুর্ঘটনায় প্রাণহানীর সংখ্যা।
ওডি/আইএইচএন
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড