ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি
ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলায় মুঠোফোনে কথার বলার অভিযোগে শিক্ষিকার দ্বারা লাঞ্ছিত হওয়ার পর আশা মনি (১২) নামে এক মাদ্রাসাছাত্রী আত্মহত্যার চেষ্টা করে। পরে ওই মাদ্রাসাছাত্রী আত্মহত্যা চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে এখন মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
রবিবার (১৫ সেপ্টেম্বর) সকালে এমনই অভিযোগ করেন ওই শিক্ষার্থীর মা সাহেরা বেগম (৪৫)।
ভুক্তভোগী আশা মনি ছোট সিংগিয়া গ্রামের লতিফর রহমানের মেয়ে। সে লাহিড়ী ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসার সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী। উপজেলার চাড়োল ইউনিয়নের ছোট সিংগিয়া গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।
অভিযুক্ত ফিরোজা বেগম লাহিড়ী ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসায় সহকারী শিক্ষিকা হিসেবে কর্মরত আছেন।
এ দিকে, ঘটনার ছয় মাসের মাথায় বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আশা মনির কাছ থেকে মুঠোফোনটি উদ্ধার করে বালিয়াডাঙ্গী থানায় হস্তান্তর করেছেন। এ সময় একটি সাধারণ ডায়েরিও করেছেন মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ বলে জানান ওসি মোসাব্বেরুল হক।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কৃষক লতিফর রহমানের চার মেয়ের মধ্যে আশা মনি ছিল সবার ছোট। অভাবের সংসারে ছোট মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়ে একটি চাকরি করানোর ইচ্ছা ছিল বাবা-মার। আশা মনি এখন মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এলাকার মানুষজনও বিষয়টি নিয়ে খুবই মর্মাহত।
শিক্ষার্থীর মা সাহেরা বেগম অভিযোগ করেন, চলতি বছরের ১০ মার্চ সকালে প্রতিদিনের ন্যায় আমার মেয়ে আশা মনি মাদ্রাসায় যায়। বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে মাদ্রাসা থেকে মন খারাপ করে আশা মনি বাড়িতে চলে আসে।
কিছুক্ষণ পর মাদ্রাসা থেকে মুঠোফোনের মাধ্যমে জানানো হয়, আমার মেয়ে মাদ্রাসার হলরুমে লুকিয়ে ফোনে কথা বলছিল। এ সময় বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা ফিরোজা বেগম তার কাছ থেকে ফোনটি জব্দ করেন।
সাহেরা বেগম বলেন, মেয়ে বাড়িতে এলে তাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হয়। সে জানায় তার বান্ধবীর মুঠোফোন নিয়ে সময় পার করছিল। এ সময় শিক্ষিকা ফিরোজা বেগম তাকে ফোনসহ ধরে এবং থাপ্পড় মারেন।
তিনি বলেন, বিষয়গুলো জানার পর মেয়েকে নিয়ে বাড়ির পাশে গরুর জন্য ঘাস কাটতে যায়। ঘাস কাটার এক পর্যায়ে পানি খাওয়ার কথা বলে আশা মনি বাড়ি চলে আসে। বাড়ি ফিরে দেখি সে ঘরের মধ্যে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে ফাঁস দিয়েছে। তার এ অবস্থা দেখা মাত্র চিৎকার করলে আশপাশের লোকজন ছুটে এসে আশা মনিকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করে। পরে তাকে ঠাকুরগাঁও আধুনিক সদর হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়। সেখানে তার অবস্থা খারাপ হলে তাকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চার দিন চিকিৎসা দেওয়ার পর বাড়িতে আনা হয়। শিক্ষকের দ্বারা লাঞ্ছিত হওয়ায় মেয়েটি দুঃখ পেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে বলে অভিযোগ মাদ্রাসা ছাত্রীর মায়ের।
বাবা লতিফর রহমান বলেন, আশা মনিকে থাপ্পড় মারার অভিযোগ নিয়ে মাদ্রাসায় গিয়েছিলাম। বিষয়টি নিয়ে মাদ্রাসায় মীমাংসার কথা থাকলেও পরবর্তীতে এটি নিয়ে কেউ আর সাড়া দেয়নি। টাকা পয়সার অভাবে মামলাও করতে পারছি না। তিনি এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার চেয়েছেন।
আশা মনির সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হলে সে খাতায় লিখে অভিযোগ করেন মাদ্রাসার শিক্ষক ফিরোজা বেগম তাকে মারপিট করেছে। এ লাঞ্ছনা সহ্য করতে না পেরে সে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিল।
আশা মনির সহপাঠী নারগিস আক্তার বলেন, প্রতিদিন আশা মনি ও আমি মাদ্রাসায় যায়। সেদিন ফোনের ঝামেলা নিয়ে আশা মনিকে থাপ্পড় দেয় শিক্ষিকা ফিরোজা বেগম। বাড়িতে ফিরে আশা মনি আত্মহত্যার চেষ্টা করে।
স্থানীয় বাসিন্দা কহিনুর বেগম ও সেলিনা আক্তার বলেন, শিক্ষিকার লাঞ্ছনা সইতে না পেরে আশা মনি আত্মহত্যার চেষ্টা করে। আজ মেয়েটি মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে। এ দায় কে নেবে? একজন শিক্ষকের আচরণ এমন হতে পারে না।
দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. রফিকুল ইসলাম মুঠোফোনে বলেন, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হওয়ার কারণে হয়তো আশা মনি গলায় ফাঁস দিয়েছিল। তারপরও সে বেঁচে গেলেও তার মাথার কোষগুলোতে রক্ত চলাচলের নালিগুলো অকেজো হয়ে গেছে। এ কারণে সে এখন অনেকটাই মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে। তার চিকিৎসা চলছে। সুস্থ হতে সময় লাগবে।
অভিযুক্ত মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষিকা ফিরোজা বেগমের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, আশা মনিকে মোবাইলে কথার বলার সময় ধরা হয়। তারপর বিষয়টি তার পরিবারকে জানানো হয়।
থাপ্পড় মারা হয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি আশা মনিকে কোনো থাপ্পড় মারিনি।
মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ফজলে রাব্বী মো. নুরুল ইসলাম বলেন, ম্যানেজিং কমিটির সিদ্ধান্ত মতে গত ৪ সেপ্টেম্বর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে এবং আশা মনির ফোনটি থানায় জমা দেওয়া হয়েছে।
শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ ধরনের কাজ আমার শিক্ষক কখনোই করতে পারে না।
ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ আলী দৈনিক অধিকারকে বলেন, কিছুদিন আগে আমাকে মাদ্রাসা থেকে বিষয়টি জানানো হয়। তারপর ম্যানেজিং কমিটির সিদ্ধান্ত মতে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করে এবং মোবাইল ফোনটি থানায় জমা দেয়। আমরা শুনেছি মেয়েটা খারাপ। সব বিষয়গুলো বিবেচনা করে মেয়েটিকে মাদ্রাসা থেকে টিসি দিয়ে বের করে দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে বালিয়াডাঙ্গী থানার ওসি মোসাব্বেরুল হক দৈনিক অধিকারকে বলেন, মাদ্রাসা থেকে একটি সাধারণ ডায়েরি হয়েছে এবং একটি ফোন জমা দিয়েছে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ। শিক্ষার্থীকে থাপ্পড় মারা হয়েছে জানি সেটা আপনার কাছ থেকে জানলাম। বিষয়টি খোঁজখবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
ওডি/এএসএল
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড