• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৯ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঐতিহাসিক পানাম নগরী

  নজরুল ইসলাম শুভ, সোনারগাঁও

০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১২:০০
পানাম নগরী
ঐতিহাসিক পানাম নগরী (ছবি : দৈনিক অধিকার)

প্রাচ্যের রহস্য নগরী হিসেবে পরিচিত ঐতিহাসিক সোনারগাঁওয়ের পানাম নগরী এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। সংস্কারের অভাবে এ নগরীর কয়েক শত বছরের পুরনো ভবনগুলো রয়েছে হুমকির মুখে। বহুদিন যাবত ভবনগুলোর সংস্কার কাজ না হওয়ায় এগুলোর ইট সুরকি ও নকশা খসে পড়তে শুরু করেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ নগরীর প্রয়োজনীয় সংস্কার কাজ করতে সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে।

বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ১৬১০ সালের পূর্ব পর্যন্ত সোনারগাঁও ছিল স্বাধীন সুলতানী আমল। সে সময় সোনারগাঁও ছিল বাংলার অন্যতম রাজধানী। সুলতানী আমলের পর থেকে ধীরে ধীরে পানাম নগরী গড়ে উঠতে শুরু করে। মূলত উনিশ শতকের গোঁড়ার দিকে ধনাঢ্য হিন্দু জমিদারদের মাধ্যমে পানাম নগরীর গোড়াপত্তন ঘটে। এ নগরীটি পূর্ব দক্ষিণে ৬শ মিটার দীর্ঘ ও পাঁচ মিটার প্রশস্ত। এখানকার ভবনগুলো একতলা থেকে তিনতলা বিশিষ্ট। প্রতিটি ভবনেই ইউরোপীয় স্থাপত্য রীতির সঙ্গে মোঘল স্থাপত্য রীতির মিশ্রণ লক্ষ্য করা যায়।

জানা যায়, পৃথিবীর ১০০টি বিলুপ্তপ্রায় ঐতিহাসিক শহরের মধ্যে পানাম নগরী একটি। ওয়ার্ল্ড মনুমেন্ট ফান্ড ২০০৬ সালে পানাম নগরীকে বিশ্বের ধ্বংসপ্রায় ১০০টি ঐতিহাসিক স্থাপনার তালিকায় স্থান দিয়েছেন। ২০০১ সালে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর পানাম নগরীকে আংশিক অবৈধ দখলদারমুক্ত করে প্রথমবারের মতো সংস্কারের উদ্যোগ নেয়।

সে সময় সংস্কারের নামে পানাম নগরীর ৯টি ভবনের মূল সৌন্দর্য নষ্ট করার অভিযোগ ওঠে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের বিরুদ্ধে। যেনতেনভাবে চুন সুরকির প্রলেপ দেওয়া হয় এ ভবনগুলোতে। ফলে এ সংস্কার কাজ বন্ধের জন্য প্রতিবাদ জানায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞ দল ও স্থানীয় সুশীল সমাজ। তীব্র প্রতিবাদের মুখে বন্ধ হয়ে যায় বিতর্কিত এ সংস্কার কাজ। ২০০৯ সালে স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে পানাম নগরীকে সম্পূর্ণভাবে দখলমুক্ত করা হয়। বর্তমানে এ নগরীকে টিকেটের আওতায় আনা হয়েছে। এখানে প্রবেশ করতে হলে জনপ্রতি ১৫ টাকার টিকেট সংগ্রহ করতে হয়। বিদেশী পর্যটকদের জন্য প্রবেশ মূল্য ১০০ টাকা এবং সার্কভুক্ত দেশের নাগরিকদের জন্য প্রবেশ মূল্য ৫০টাকা।

এ দিকে, পানাম নগরী টিকেটের আওতায় আসার পর থেকে পর্যটকদের সুবিধার্থে নগরীর দক্ষিণ দিকের ৩৮ নম্বর ভবনটিতে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন একটি খাবারের দোকান স্থাপন করেছে। দোকানে একাধিক ফ্রিজ বসানো হয়েছে পাশাপাশি ভবনের অভ্যন্তরে গ্রাহকদের জন্য টেবিল চেয়ারও বসানো হয়েছে।

লেখক ও সাংবাদিক বাবুল মোশাররফ বলেন, ‘আমি ছোটবেলায় পানাম নগরীতে শতাধিক ভবন দেখেছি। অযত্ন আর অবহেলায় বিগত চল্লিশ পঞ্চাশ বছরে এসব ভবনের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র বায়ান্নটিতে। ভবনগুলোর দ্রুত সংস্কার প্রয়োজন। না হলে অচিরেই হারিয়ে যাবে ঐতিহাসিক পানাম নগরী। তবে সংস্কারের নামে যেন ভবনগুলোর আদি রূপ নষ্ট না হয় সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে।

ইতিহাস গবেষক শামসুদ্দোহা চৌধুরী বলেন, প্রয়োজনীয় সংস্কারের অভাবে ইতোমধ্যেই এ নগরীর প্রায় ২০টি ভবন সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বাকিগুলোও রয়েছে হুমকির মুখে। সামান্য ভূমিকম্পই এ নগরী ধ্বংসের জন্য যথেষ্ট। পানাম নগরীর আদি সৌন্দর্য ঠিক রেখে অচিরেই এটি সংস্কার ও সংরক্ষণ করা জরুরি। এ নগরী দেশি বিদেশি পর্যটকদের কাছে অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান। বর্তমানে এ নগরীর প্রতিটি ভবনের প্রবেশদ্বার বন্ধ থাকার কারণে এখানে আগত দর্শনার্থীরা ভবনগুলোর অভ্যন্তরের মূল সৌন্দর্য উপভোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সংস্কারের মাধ্যমে দ্রুত এ নগরীর প্রাচীন জৌলুস ফিরিয়ে আনতে পারলে পানাম নগরীতে পর্যটকসংখ্যা বাড়বে। পাশাপাশি সরকারের রাজস্ব আয়ও বৃদ্ধি পাবে।

পানাম নগরীর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ভাণ্ডার রক্ষক মো. জাহাঙ্গির হোসেন জানান, পানাম নগরে বর্তমানে ছোট বড় মোট ৫২টি প্রাচীন ভবন টিকে আছে। সারিবদ্ধ অবস্থায় এ নগরীর উত্তরে ৩১টি ও দক্ষিণে ২১টি প্রাচীন ভবন রয়েছে। পানাম নগরের ১০টি ভবন সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ। সামান্য ভূমিকম্প কিংবা একটানা বৃষ্টিতে এ ভবনগুলো ধসে পড়তে পারে। দর্শনার্থীদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোসহ বাকি ভবনগুলোতেও কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ভবনগুলোর প্রবেশদ্বার আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে। প্রতিটি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে সাইনবোর্ড লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আলতাফ হোসেন জানান, পানাম নগরী সংস্কারের জন্য বিপুল অর্থের প্রয়োজন। তাই এ সংস্কারের ব্যাপারে দক্ষিণ কোরিয়া ভিত্তিক একটি বহুজাতিক কোম্পানির সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। সংস্কারের জন্য ওই কোম্পানির সঙ্গে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের একটি চুক্তি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এ ব্যাপারে ইয়াংওয়ান করপোরেশন নামের ওই কোম্পানির চেয়ারম্যান ও কোরিয়া ইপিজেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মি. কিহাক সাং পানাম নগরী পরিদর্শনও করেছেন। আমরা চাইছি ধাপে ধাপে পানাম নগরীর সংস্কারকাজ সম্পন্ন করতে।

কবে নাগাদ এ সংস্কারকাজ শুরু হতে পারে এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা সঠিক বলা যাচ্ছে না। আমরা চেষ্টা করছি দ্রুত সংস্কারকাজ কাজ শুরু করতে, দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কি হয়।’

প্রত্নতাত্ত্বিক ভবনের অভ্যন্তরে খাবারের দোকান স্থাপন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের হুমকি কি না এ প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, এ খাবারের দোকান পর্যটন করপোরেশনের পক্ষ থেকে করা হয়েছে। ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনার ভেতর খাবারের দোকান রয়েছে। এখানে বসে খেলে কোনো সমস্যা নেই। তবে এসব স্থাপনার ভেতর রান্না করা যাবে না এবং কোনো নকশা নষ্ট করা যাবে না।

ওডি/আইএইচএন

আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড