• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৬ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

শিকলে বাঁধা অন্ধকার গর্তে ৪ বছর জীবন কাটাচ্ছে কাদের 

  সেলিম হায়দার, তালা প্রতিনিধি, সাতক্ষীরা

০১ আগস্ট ২০১৯, ২২:১০
প্রতিবন্ধী আব্দুল কাদের
মানসিক প্রতিবন্ধী আব্দুল কাদের ( ছবি : দৈনিক অধিকার )

আব্দুল কাদের একজন মানসিক প্রতিবন্ধী। বয়স ৫৩ বছর। সাতক্ষীরার তালা উপজেলার খেশরা ইউনিয়নের শাহাজাতপুর গ্রামেই তার বাড়ি। জেলার পাইকগাছার আর.কে.বি.কে হরিশচন্দ্র কলেজিয়েট ইনস্টিটিউট থেকে ১৯৮২ সালে মাধ্যমিক আর ১৯৮৫ সালে উপজেলার কপিলমুনি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। এরপর একই কলেজে স্নাতকে অধ্যায়ন অবস্থায় আকস্মিকভাবে মস্তিষ্ক বিকৃত হয়ে পড়েন।

পারিবারিক সূত্র জানায়, সাতক্ষীরার তালা উপজেলার খেশরা ইউনিয়নের শাহাজাতপুর গ্রামে শওকত আলী মোড়লের ৩ ছেলে ও ৩ মেয়ের মধ্যে এমএম আব্দুল কাদের সবার বড়। প্রথম থেকেই তাদের পারিবারিক স্বচ্ছলতা ভালো না থাকলেও শওকতের বিদ্যানুরাগী মনোভাব সন্তানদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হতে অনুপ্রাণিত করে। সে লক্ষে এগিয়েও যাচ্ছিলেন তারা। বড় ছেলে আব্দুল কাদেরকে পাইকগাছার আর.কে.বি.কে হরিশচন্দ্র কলেজিয়েটে ইনস্টিটিউটে ভর্তি করেন। সেখান থেকে ১৯৮২ সালে মাধ্যমিক পাস করার পর ভর্তি করান কপিলমুনি কলেজে। সেখান থেকে ১৯৮৫ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর স্নাতকে ভর্তি হন একই কলেজে। তবে ভাগ্য বিড়ম্বিত আব্দুল কাদেরকে আর এগুতে দেয়নি নির্মম নিয়তি।

জমি-জমা সংক্রান্ত পারিবারিক বিরোধ আকস্মিকভাবে থমকে দেয় তার গতিময় জীবন। যার জের ধরে তারই এক চাচাতো ভাই তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে তাল গাছের কাঠ দিয়ে নির্মম নির্যাতন করে। এতে সে প্রাণে বেঁচে গেলেও চরমভাবে মস্তিষ্কের বিকৃতি ঘটে তার। এরপর সর্বস্ব বিক্রি করে চিকিৎসা সেবায় প্রাণে বেঁচে গেলেও আর ভালো হয়ে উঠেনি আব্দুল কাদের। বন্ধ হয়ে যায় তার পড়া-লেখা। এরপর কিছু দিন অন্তর অন্তর আকস্মিক মাথায় গণ্ডগোল দেখা দেয়। স্থানীয় চিকিৎসায় আবার ভালো হয়ে ওঠে কাদের।

পরে এলাকাবাসীর পরামর্শে পারিবারিকভাবে বিয়ে দেওয়া হয় তাছলিমা নামে এক মেয়ের সঙ্গে। দাম্পত্য জীবনে ফাতেমা (বিবাহিত) নামে এক মেয়ে রয়েছে তার। তবে মেয়ের জন্মের কিছুদিন পর তাছলিমার মৃত্যু ঘটে। একাকিত্বে ফের পাগলের মতো হয়ে যায় কাদের। এরপর ফের তাকে জুলেখা নামে এক মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়। নতুন করে দাম্পত্য জীবনে তাদের দু কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। যার একজন আসমা খাতুন (বিবাহিত) ও অপর জন ফাইম খাতুন (৪)।

আব্দুর কাদেরর দাম্পত্য জীবন শুরু হলেও সুখের হয়নি। ছোট মেয়ে ফাইমার জন্মের পরেই একেবারেই বিগড়ে যান কাদের। স্বজনদের ধরে মারধর, ভাঙচুর ও প্রতিবেশীদের ক্ষতি করতে থাকেন তিনি। এক পর্যায়ে পরিবারের সদস্যরা বাধ্য হয়ে তাকে প্রথমে বারান্দায় হাতে-পায়ে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা শুরু করেন। তবে, সারাক্ষণ উচ্চস্বরে চিৎকার ও অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করায় বিরক্ত হয়ে পরিবারের লোকজন বাড়ি থেকে প্রায় ৩শ ফুট দূরে বাগানের মধ্যে গাছে বেঁধে রাখেন। বাবা-মা ও স্ত্রী-সন্তানদের ফেলে এখন তার ঠাঁই হয়েছে বাড়ির পাশের বাগানের মধ্যে অন্ধকার গর্তে। রাত-দিন ঝড়-বৃষ্টিতে এক হাত ও পায়ে শিকলে বাঁধা পড়েছে তার গদ্যময় নিঃসঙ্গ জীবন।

আব্দুল কাদেরের খবর পেয়ে বুধবার (৩০ জুলাই) বিকালে সরেজমিনে ঘটনাস্থলে গেলে চিরাচরিত স্বভাবেই দেখা যায় তাকে। তবে কথোপকথনে মোটেও মস্তিষ্ক বিকৃত বলে মনে হয়নি। প্রথম দেখাতেই সাংবাদিকদের দেখে সালাম দেন তিনি। এরপর একে একে তার জীবনের সব ঘটনার নির্ভুল বর্ণনা দিতে থাকেন। কখনো পুরনোকে মনে করে আবেগ আপ্লুত হতে দেখা যায়। এ সময় তিনি তার শৈশব-কৈশোরের সব স্মৃতির রোমন্থন করতে থাকেন।

তবে তাকে করা সব প্রশ্নের উত্তর দেন মধুর কণ্ঠে। কথার ফাঁকে ফাঁকে নিজের শিকলে বাঁধা জীবন থেকে ক্ষণিকের জন্য হলেও মুক্তির আকুতি জানান তিনি।

আব্দুল কাদের বলেন, আপনারা জানেন? আমি আমার ৪ বছরের মেয়ে ফাইমাকে কখনো কোলে নেয়নি, আদর করা হয়নি কখনো তাকে। আমাকে দূর থেকে দেখেও ভয়ে পালিয়ে যায় বলে ফের কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।

এক পর্যায়ে তার সরল স্বীকারোক্তির নির্ভুলতা যাচাই করতে তার ঠিকানা জানতে চাইলে তিনি মুখে বলার পাশাপাশি খাতা-কলম চান লিখে দিতে। এরপর নির্ভুল ইংরেজিতে লিখেন তার বায়োডাটা। তবে কেন একজন সুস্থ-সবল মানুষকে ৪ বছর এভাবেই বেঁধে রাখা? এমন প্রশ্ন করতেই স্বজনদের কাদেরের মা ও স্ত্রীর মধ্যে শুরু হয় চোখাচোখি, কানাকানিসহ নানা ইশারা। যেন কিছু একটা গোপন করতে চাচ্ছে তারা। তবে কেন তাদের এই গোপনীয়তা? নাকি নিরবতা।

একপর্যায়ে কাদেরের মা রহিমা বেগম (৭০) ছেলের ওপর ঘটে যাওয়া নানা নির্যাতনের বর্ণনা শুরু করলে স্ত্রী জুলেখা তাতে বাধ সাধেন। যেন তাদের চোখে-মুখে তখন অন্য রকম এক ভীতি কাজ করছিল। কিছু একটা গোপন করতে চাচ্ছেন তারা। তবে কথোপকথনের একপর্যায়ে মৃতপ্রায় কাদেরের একেবারে মৃত্যুর শঙ্কাটি বার বার সামনে এসে দাঁড়ায়।

এ ব্যাপারে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান প্রভাষক রাজিব হোসেন রাজু বলেন, এমন অবস্থায় একজন মানুষ তার ইউনিয়নে নির্মম জীবন-যাপন করছেন তা তার জানা ছিল না। সম্প্রতি স্থানীয় এক ফায়ার সার্ভিস কর্মী শেখ আরিফুর রহমান আজগরের সহযোগিতায় দেখতে যান তাকে। তাৎক্ষণিক কাদেরকে সহযোগিতাও করেছেন তিনি। তবে আব্দুল কাদেরের জন্য ভবিষ্যতে কিছু করার ইচ্ছে পোষণও করেন ইউপি চেয়ারম্যান।

ওডি/এসএএফ

আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড