ইমরান ভূইয়া আপন, গজারিয়া, মুন্সীগঞ্জ
অহেতুক হতাশ হওয়া মানুষদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হতে পারে শেখ মাসুম (বাবু)। মুন্সীগঞ্জ বজ্রযোগিনী জে কে উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র সে। পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলা, ছবি অঙ্কন, গান, কবিতা আবৃত্তি ও একক অভিনয়ে পারদর্শী এই কিশোর। তবে অন্য সবার মতো স্বাভাবিক নয় সে। জন্ম থেকেই তার দুটি হাত ও দুটি পা নেই।
প্রতিদিন বাবার কোলে কিংবা কাঁধে চড়ে স্কুলে যাওয়া-আসা করে সে। তবে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা হার মেনেছে তার প্রবল ইচ্ছা শক্তির কাছে। কাজেই থেমে নেই তার পড়াশোনা। জীবনের লক্ষ্য উচ্চশিক্ষিত সিআইডি অফিসার হওয়ার।
মাসুম মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার বজ্রযোগিনী ইউনিয়নের সুয়াপাড়া গ্রামের দরিদ্র কৃষক চান মিয়া শেখ ও গৃহিণী রাজিয়া সুলতানার ছেলে। চার ভাই বোনের মধ্যে মাসুম তৃতীয়। কষ্ট আর অভাবের সংসারে বড় ভাই অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা বন্ধ করে অনেক আগেই সংসারের হাল ধরেছেন। বড় বোন অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে হিসাববিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনা করছেন। আর মাসুম ও তার ছোট বোন একসঙ্গে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ছে।
মাসুমের মা রাজিয়া সুলতানা জানান, বাসায় পড়া শিখিয়ে প্রথম যখন ওকে স্কুলে ভর্তি করাতে নিয়ে গেলাম। তখন স্কুলের প্রধান শিক্ষক মাসুমকে ভর্তি করেননি। উল্টো রাগান্বিত হয়ে বলেন, পড়তে পারলেই হবে না। যার হাত নেই সে লেখবে কীভাবে? আর তার পড়াশোনা করে কী হবে?
উচ্চশিক্ষিত সিআইডি অফিসার হতে চাই (ছবি : দৈনিক অধিকার)
তিনি বলেন, সেদিন লিখতে না পারার কারণে মাসুমকে স্কুলে ভর্তি করাতে পারেননি। পরে বাসায় এসে চেষ্টার পর মাত্র ১৫ দিনে মাসুম থুতনি ও হাতের বাড়তি অংশ দিয়ে লিখতে শিখে যায়। এর পর মাসুমকে আবার স্কুলে ভর্তি করাতে নিয়ে গেলে এত অল্প সময়ে লিখতে পারায় শিক্ষক অবাক হয়ে তাকে ভর্তি করালেন। প্রথম প্রথম স্কুলের শিক্ষক ও সহপাঠীরা মাসুমকে স্কুলে পড়া নিয়ে ঠাট্টা করত।
অবাক করা বিষয় হলো- শারীরিক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও পড়াশোনা ছাড়াও বেশ কিছু প্রতিভার অধিকারী মাসুম। জেলা পর্যায়ে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় বঙ্গবন্ধুর ছবি নিখুঁতভাবে অঙ্কন করে প্রথম স্থান অধিকার করেছে। একক অভিনয় করেছে মঞ্চে। এছাড়াও গান, কবিতা আবৃত্তিসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে অনেক পুরস্কার ও সার্টিফিকেট অর্জন করেছে সে।
মাসুমের বড় বোন বলেন, পড়াশোনায় বেশ সে মেধাবী। পড়াশোনা ছাড়াও অভিনয়, গান, কবিতা আবৃত্তি ও বিশেষ করে চিত্রাঙ্কন একবার শিখিয়ে দিলে অতি দ্রুত তা আয়ত্ত করতে পারে। ওকে যদি ভালো কোনো আর্ট স্কুলে ভর্তি করানো যেত, তাহলে সে আরও অনেক ভালো করতো।
অবসর সময় বন্ধুদের সঙ্গে ক্রিকেট, ফুটবল, ব্যাডমিন্টন খেলে সময় কাটায় মাসুম। মুখ, হাত ও পায়ের বাড়তি অংশ দিয়ে চমৎকারভাবে খেলাধুলা আয়ত্ত করেছে সে। শুধু তাই নয়, অকেজো মোবাইল কিংবা ইলেকট্রনিক যন্ত্র নিজে নিজে খুলে মেরামতও করেছে বেশ কয়েকটি। নতুন কিছু আবিষ্কারে তার বেশ আগ্রহ। পছন্দের সাবজেক্ট বিজ্ঞান।
মাসুম বলেন, প্রথম দিকে সবাই আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করত, আমাকে নিন্দা করত। সবাই ভাবত, আমার হাত পা নাই বলে আমি কিছু করতে পারব না। কিন্তু বাবা-মা ও শিক্ষকদের সহায়তায় আমি পড়াশোনা শিখতে সক্ষম হচ্ছি। আমি উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে একজন সিআইডি অফিসার হতে চাই।
পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মাসুম (ছবি: দৈনিক অধিকার)
মাসুমের বাবা বলেন, আমি প্রতিদিন ছেলেকে কাঁধে করে স্কুলে নিয়ে যাই আবার ছুটি হলে নিয়ে আসি। এখন আমার বয়স হয়েছে, এটা আমার জন্য খুবই কষ্টকর। আমার একার পক্ষে সংসার চালানো কষ্টকর ছিল বলে বড় ছেলেকে লেখাপড়া না করিয়ে কাজে দিয়েছি। এখন ইচ্ছা আছে যতটা সম্ভব বাকি তিন ছেলে-মেয়েকে পড়াশোনা করাতে চাই। কিন্তু অভাবের সংসারে ওদের পড়াশোনা করানোর খরচ জোগাতে অনেক কষ্ট হয়ে যায়।
বিদেশে নিয়ে গিয়ে উন্নত চিকিৎসার মাধ্যমে যদি কৃত্রিম হাত ও পা লাগানো যেত তাহলে প্রতিভাবান মাসুম ফিরে পেত চলার মতো স্বাভাবিক জীবন। অন্যদিকে সরকারি বৃত্তির সহায়তা পেলে চালানো যেত মাসুমের পড়াশোনার খরচ। সরকারের কাছে সহায়তার জন্য এমনটাই আশা করছেন মাসুমের দরিদ্র পরিবার।
ওডি/ এফইউ
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড