• মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৬ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

নুসরাত ইস্যুতে সক্রিয় ভূমিকায় ক্ষুদ্ধ হয়ে

ফেনী ছাড়ার আগে সাংবাদিকদের মামলায় জড়িয়ে গেলেন এসপি জাহাঙ্গীর

  এস এম ইউসুফ আলী, ফেনী

২৭ জুলাই ২০১৯, ১৮:২৬
নুসরাত ইস্যু
নুসরাত ইস্যুতে সাংবাদিকদের সক্রিয় ভূমিকা (ফাইল ফটো)

বহুল আলোচিত ফেনীর মাদরাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনাকে শুরু থেকেই ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন আত্মহত্যা বলে অপপ্রচার করেন। আর তার পক্ষে অবস্থান নেন পুলিশ সুপার এসএম জাহাঙ্গীর আলম সরকার। শুধু তাই নয়, বর্বরোচিত এ ঘটনায় দায়েরকৃত মামলাতেও অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলাসহ কয়েকজনকে আসামি না করতে চেষ্টা করেন এসপি-ওসি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কঠোর নির্দেশনা এবং সাংবাদিকদের দৃঢ় অবস্থানের কারণে ক্রমেই ঘটনার জট খুলতে থাকে। একপর্যায়ে মামলাটি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনে (পিবিআই) হস্তান্তর করা হলে ঘটনায় জড়িতরা গ্রেফতার হয়।

অন্যদিকে পুলিশ সদর দপ্তরের তদন্তে দোষী সাব্যস্ত হয়ে বরখাস্ত হন ওসি মোয়াজ্জেম। কর্তব্যে অবহেলার দায়ে প্রত্যাহার হয়ে সদর দপ্তরে সংযুক্ত হন এসপি জাহাঙ্গীর সরকার। আরো দুই পুলিশ সদস্যকেও প্রত্যাহার করে পার্বত্য অঞ্চলে সংযুক্ত করা হয়। এতে গণমাধ্যমের ওপর ক্ষিপ্ত হন এসপি-ওসি।

মোবাইল ফোনে ধারণকৃত নুসরাতের জবানবন্দি ভিডিও ফুটেজটি চুরির অভিযোগ এনে ১৪ এপ্রিল সময় টিভির ফেনী ব্যুরোর রিপোর্টার আতিয়ার হাওলাদার সজলের বিরুদ্ধে থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন ওসি মোয়াজ্জেম। পরে মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধেও সজল পাল্টা ডায়েরি করেন। এদিকে বেআইনীভাবে নুসরাত রাফির জবানবন্দি ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগে আইসিটি আইনে ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন। ওই মামলায় কারাগারে রয়েছেন ওসি মোয়াজ্জেম।

অপরদিকে আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডে রহস্য উদঘাটনে সক্রিয় ভূমিকা রাখায় প্রত্যাহার হওয়া পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলম সরকারের রোষানলে পড়েন ফেনীতে কর্মরত সাংবাদিকরা। কর্তব্যকাজে অবহেলার অভিযোগে ফেনী ছাড়ার আগে তিনি সাংবাদিকদের হেনস্থা করতে ছক আঁকেন। বিভিন্ন থানার ওসিদের ডেকে কয়েকজন সাংবাদিককে মামলায় ফাঁসিয়ে দিতে নির্দেশ দেন। এমনকি সমঝোতা হওয়া মামলায়ও চার্জশিট দিতে বাধ্য করেন। এজাহারে নাম না থাকা সতত্ত্বেও সাংবাদিকদের চার্জশিটে নাম অন্তর্ভূক্ত করতে সংশ্লিষ্ট থানার ওসিদের এসিআর আটকে রাখেন ফেনীর সাবেক বিতর্কিত পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর সরকার।

জেলা পুলিশের বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, এসপি জাহাঙ্গীর ফেনী ছাড়ার আগেই কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তাকে নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। এ সময় তিনি এ ঘটনায় তাকে নিয়ে গণমাধ্যমের ভূমিকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। কয়েকজন সাংবাদিকের নাম সংবলিত একটি তালিকা সংশ্লিষ্ট থানার ওসিদের ধরিয়ে দেন। বিভিন্ন তদন্তাধীন মামলায় সাংবাদিকদের নাম চার্জশীটে অন্তভূক্ত করার নির্দেশ দেন। কয়েকজন ওসি কৌশলে এড়িয়ে গেলেও অন্যরা এসিআরের ভয়ে আদালতে চার্জশীট দাখিলে বাধ্য হন। ১২ মে সন্ধ্যায় তার বদলি আদেশ আসার পর তিনি রাতে জরুরি ভিত্তিতে ওসিদের ডেকে চাপ প্রয়োগ করে কয়েকটি চার্জশিট তৈরি করান। পরদিন তা দাখিলে বাধ্য করেন বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ওসি জানান। এমনকি বিষয়টি গোপন রাখতেও কোর্ট পরিদর্শকসহ অন্যদের নির্দেশ দেন তিনি।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ইতোমধ্যে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ফেনী মডেল থানায় ৩, সোনাগাজী মডেল থানায় ২, দাগনভূঞা থানায় ২ ও ছাগলনাইয়া থানায় ২টি মামলার চার্জশিট আদালতে জমা হয়েছে বলে জানা গেছে। এসব মামলার অধিকাংশই বাদী পুলিশ।

প্রাপ্ত তথ্যে আরও জানা গেছে, জমা দেয়া চার্জশিটে সাংবাদিকদের মধ্যে দৈনিক ফেনীর সময় ও সাপ্তাহিক আলোকিত ফেনী সম্পাদক মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন, বাংলানিউজ স্টাফ রিপোর্টার ও সাপ্তাহিক হকার্স এর বার্তা সম্পাদক সোলায়মান হাজারী ডালিম, দৈনিক অধিকার প্রতিনিধি ও অনলাইন পোর্টাল ফেনী রিপোর্টের সম্পাদক এস এম ইউসুফ আলী এবং দৈনিক সময়ের আলো প্রতিনিধি ও দৈনিক স্টার লাইনের স্টাফ রিপোর্টার মাঈন উদ্দিন পাটোয়ারির নাম রয়েছে।

তদন্তকারি সূত্র জানায়, মামলার এজাহারে এদের কারোর নাম না থাকলেও বাধ্য হয়ে চার্জশিটে তাদের অন্তর্ভূক্ত করা হয়।

সংশ্লিষ্টরা জানান, উল্লেখিতদের নামে ফেনীর কোন থানায় ইতোপূর্বে সাধারণ ডায়েরিও ছিলো না। বিতর্কিত এসপি জাহাঙ্গীর সরকারের রোষানলে পড়ে একসপ্তাহের মধ্যে তারা প্রায় ১০টি মামলার চার্জশিটে আসামি হন। বিষয়টি জানাজানি হলে ফেনীতে কর্মরত সাংবাদিক ও সচেতন মহলে ক্ষোভ-অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে।

সাংবাদিক এস এম ইউসুফ আলী জানান, ‘ফেনীতে নানা অপরাধের অন্তরালে পুলিশের শক্তিশালী সিন্ডিকেট’ শিরোনামে ২৩ এপ্রিল দৈনিক অধিকার এ অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে কিছু পুলিশ কর্মকর্তা তাকে ‘কথিত গায়েবী’ মামলায় জড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেন। পরে জানতে পারেন তাকে তদন্তাধীন ৮-১০টি মামলায় চার্জশিটে জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

নুসরাত রাফির বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশ সুপারের অবহেলার চিত্র নিয়ে শিল্পী আবু হাসানের আঁকা কার্টুন দৈনিক ফেনীর সময় এ ২৫ এপ্রিল প্রকাশিত হয়। এ ঘটনায় পুলিশ সুপাার ক্ষুব্ধ হন। এছাড়াও আঞ্চলিক এ দৈনিকটিতে আলোচিত ওই ঘটনায় এসপি-ওসির কর্তব্যে অবহেলার নানা চিত্র উঠে আসে।

পত্রিকাটির সম্পাদক মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন জানান, এতে ক্ষুব্ধ হয়েই পুলিশ সুপার তাকে মামলায় জড়িয়ে দেন।

এছাড়াও ছাগলনাইয়ায় কর্মরত দুই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে আইসিটি আইনে দায়েরকৃত মামলা বাদীর সঙ্গে সমঝোতা হওয়া সত্ত্বেও তাদের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দেওয়া হয়।

যুগান্তর ছাগলনাইয়া প্রতিনিধি নুরুজ্জামান সুমন ও অনলাইন পোর্টাল ছাগলনাইয়া ডট কম সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির লিটন জানান, প্রতিহিংসাবশত এসপি জাহাঙ্গীর আলম সরকারের নির্দেশে ওসি (তদন্ত) সুদীপ রায় তাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেন।

ইতোমধ্যে ঘটনাটি জানাজানি হওয়ার পর সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ নবাগত পুলিশ সুপার খোন্দকার নুরুন্নবীর সঙ্গে সাক্ষাত করে বিষয়টি অবহিত করেছেন। তিনি সাংবাদিকদের আশ্বস্ত করেছেন, নতুন করে আর কোনো মামলায় সাংবাদিকদের জড়ানো হবে না। এর আগে জমা দেওয়া চার্জশিট নিয়ে তার কিছু করার নেই বলেও তিনি জানান।

প্রবীণ সাংবাদিক ও বাসস প্রতিনিধি আবুল কাশেম চৌধুরী বলেন, এ ধরনের ঘটনা নজিরবিহীন। জেলায় কর্মরত সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যমূলকভাবে মামলায় জড়িয়ে হয়রানি করার দায়ে তিনি বিতর্কিত পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর সরকারের শাস্তি দাবি করেন।

সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক ফেনী জেলা শাখা সভাপতি এডভোকেট লক্ষণ বণিক বলেন, যেখানে এসপি-ওসি এ বিভৎস ঘটনাটিকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা করেছিল সেখানে সাংবাদিকদের আপ্রাণ চেষ্টায় প্রকৃত তথ্য বেরিয়ে আসে। এমনকি পুলিশের তদন্তেও পুলিশ সুপার ও ওসির কর্তব্যে অবহেলা ও বিতর্কিত ভূমিকার বিষয়টি প্রমাণিত হয়। এরপরও প্রতিহিংসাবশত সাংবাদিকদের তদন্তাধীন মামলায় চার্জশিটে জড়িয়ে হয়রানি করা খুবই ন্যাক্কারজনক ঘটনা। তিনি এসব মামলায় সাংবাদিকদের অব্যাহতির দাবি জানান।

সোনাগাজী প্রেস ক্লাব সভাপতি শেখ আবদুল হান্নান বলেন, নুসরাত রাফি ইস্যুতে শুরু থেকে পুলিশ সুপার ও ওসি বিতর্কিত ভূমিকায় অবর্তীর্ণ হয়। প্রধানমন্ত্রীর কঠোর নির্দেশনা ও সাংবাদিকদের সাহসী ভূমিকায় আলোচিত এ ঘটনার রহস্য উদঘাটিত হয়। উদ্দেশ্যমূলকভাবে সাংবাদিকদের হয়রানীর তীব্র নিন্দা জানান তিনি।

প্রসঙ্গত, চলতি বছরের ২৭ মার্চ অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার হাতে যৌন নিপীড়নের শিকার হন সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফি। ওইদিনই স্থানীয় জনতা অধ্যক্ষকে ধরে পুলিশে সোপর্দ করেন। এ ঘটনায় রাফির মা শিরীন আক্তার বাদী হয়ে থানায় অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। মামলা প্রত্যাহার করতে হুমকি-ধমকি দেন অধ্যক্ষের অনুসারীরা। একপর্যায়ে ৬ এপ্রিল পরীক্ষার পূর্ব মুহূর্তে মাদরাসার ছাদে ডেকে নিয়ে নুসরাত রাফির শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। পুলিশ তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে প্রেরণ করে। ১০ এপ্রিল চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ণ ইউনিটে তার মৃত্যু হয়।

এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই পরিদর্শক মো. শাহ আলম আদালতে মোট ১৬ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র জমা দেন। গত ২৭ জুন মামলার বাদী ও প্রথম সাক্ষী নুসরাত রাফির বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমানের সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। ইতিমধ্যে ৫১ জনের সাক্ষ্য ও জেরা এ পর্যন্ত সম্পন্ন হয়েছে।

ওডি/এসএ

আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড