• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৮ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

বেসরকারি চিকিৎসা খাতে অনিয়ম রুখবে কে?

  রাজু আহমেদ, রাজশাহী

১৭ জুলাই ২০১৯, ১২:১৮
রাজশাহী
এইড প্লাস ডায়াগনস্টিক সেন্টার সিলগালা করা হলে ইউনিল্যাব ডায়াগনস্টিক সেন্টার নামে একই ভবনে গড়ে ওঠে নতুন প্রতিষ্ঠান।

গেল মে মাসে অভিযান পরিচালনা করে রাজশাহী নগরীর লক্ষিপুর ডিবি অফিসের পূর্বে অবস্থিত এইড প্লাস ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে জরিমানা আদায়ের পাশাপাশি বন্ধ করে দেয়া হয় প্রতিষ্ঠানটি। অভিযোগ স্বাস্থ্য সেবার নামে নানা অনিয়ম ও প্রতিষ্ঠানের নামে লাইসেন্স না থাকা। এইদিন একই অভিযোগে বন্ধ করে দেয়া হয় সাদ ডায়াগনস্টিক সেন্টার। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন রাজশাহী জেলা ম্যাজিস্ট্রেট।

এরপর গত সোমবার (১৫ জুলাই) দুপুরে এইড প্লাস ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সেই ভবনটিতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে ‘ইউনিল্যাব ডায়াগনস্টিক সেন্টার’ নামে খুলে বসা হয়েছে নতুন ব্যবসা। এই প্রতিষ্ঠানটিরও নেই লাইসেন্স।

স্থানীয়রা জানায়, এইড প্লাসকে জরিমানা করায় বাজারে বদনাম হয়েছে। আর তাই সেই কর্তৃপক্ষের একটি অংশ নাম পাল্টে একই স্থানে খুলে বসেছে একই ধরনের ব্যবসা।

একই দিন লক্ষিপুর মোড়ে কথা হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে আসা কৃষক রবিউল ইসলামের সাথে। তিনি রাজশাহীতে এসেছেন স্ত্রী শাহনাজের পেটের চিকিৎসা করাতে। কয়েক মাস ধরেই তিনি লক্ষিপুর ক্লিনিক পাড়ায় ছুটোছুটি করছেন। গেল মাসে একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ডাক্তার দেখিয়ে পেটের আলট্রাসনোসহ অন্যান্য টেস্ট করান। তবে সেই ডাক্তারের চিকিৎসায় রোগের উপশম না হওয়ায়, ডাক্তার পরিবর্তনের মনস্থির করেন।

তিনি পূর্বের টেস্টের সকল কাগজপত্র ও প্রেসক্রিপশন নিয়ে নতুন একটি ডায়াগনস্টিকে যান। সেখানে ডাক্তার তাকে আবারও নতুনভাবে আলট্রাসনোসহ আনুষঙ্গিক একই টেস্টগুলো করতে বলেন। আর্থিক দুশ্চিন্তায় তিনি ডাক্তারকে ভয় নিয়ে জিজ্ঞেস করেন, কয়দিন আগেই তো ওর আলট্রা করালাম, আবার নতুন করে আলট্রা! আগের রিপোর্টে হবে না স্যার? উত্তরে ডাক্তার সাফ জানিয়ে দেন, ‘ওই ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মেশিন ঠিক নাই। আরও অনেক সমস্যা আছে। তাই নতুন রিপোর্টের বিকল্প নাই’।

রাজশাহীতে চিকিৎসা সেবা নিতে আসা রোগীদের বড় একটি অংশেরই অভিযোগ চিকিৎসক পরিবর্তন করলে বা কথায় কথায় নতুন করে একই টেস্ট করতে বলা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ডায়াগনস্টিক ভেদে টেস্টগুলোতে ভিন্ন ভিন্ন রিপোর্ট আসে। সঠিক রিপোর্ট দিতে না পারলেও এই পদ্ধতিতে ডায়াগনস্টিকগুলোর ব্যবসা থেমে নেই। আর এভাবেই শারীরিক ও আর্থিক উভয় ভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সেবা নিতে আসা অসহায় রোগীরা।

চিকিৎসা খাতে সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, রাজশাহীতে অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সংখ্যা। তবে সংখ্যা বাড়লেও সেবাধর্মী এই প্রতিষ্ঠানগুলোর চিকিৎসা সেবার মান ও টেস্টগুলোর রিপোর্টের যথার্থতা নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন। আর বেসরকারি চিকিৎসা খাতের প্রকাশ্য এই বহুমাত্রিক অনিয়ম দেখেও নিশ্চুপ রয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগের তদারকি কর্মকর্তারা। আর এর জন্য তারা দায়ী করছেন কর্মকর্তাদের দুর্নীতিকে।

স্বাস্থ্য বিভাগের নীতিমালা অনুসারে, প্রতি ১০ বেডের ক্লিনিকের জন্য অন্তত একজন চিকিৎসক ও দুইজন নার্স থাকতে হবে। তবে স্থানীয় অধিকাংশ ক্লিনিকগুলোতেই নেই প্রয়োজনীয় সংখ্যক সেই জনবল। ফলে এই ক্লিনিকগুলোতে রোগীরা স্বাস্থ্য সেবা নিতে আসলেও তাদের ঝুঁকি রয়েই যাচ্ছে।

রাজশাহী সিভিল সার্জন অফিসের দেয়া তথ্য মতে, রাজশাহী সিটিতে অনুমোদিত (লাইসেন্স প্রাপ্ত) ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিকের সংখ্যা মোট ১৩৯টি। এর মধ্যে সিটি করপোরেশন এলাকায় ক্লিনিক ৫০টি ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার ৮৯টি। আর রাজশাহীর ৯টি উপজেলায় অনুমোদিত ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক রয়েছে মোট ৯২টি। যার মধ্যে ক্লিনিক রয়েছে ৪৬টি ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার ৪৬টি।

প্রতিষ্ঠানটির হিসেবে, এই সিটি করপোরেশন এলাকায় অনুমোদহীন (লাইসেন্স বিহীন) ক্লিনিক রয়েছে ৬ থেকে ১০টি এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে ১৮টি। উপজেলাসমূহে অনুমোদনহীন ক্লিনিক রয়েছে ১১টি ও ডায়াগনস্টিক রয়েছে ২০ থেকে ৩৬টি।

তবে বাস্তবে অনুমোদনহীন ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিকের সংখ্যা আরও বেশি রয়েছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। শুধুমাত্র সিটি এলাকার লক্ষিপুর মোড় থেকে ঝাউতলা ও আশপাশের এলাকাতেই রয়েছে প্রায় চারশ থেকে পাঁচশটির মতো ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। আর অবৈধ উপায়ে ক্লিনিকগুলো গড়ে উঠলেও রাজশাহী স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে না। বরং তাদের আশকারা দিয়ে সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে।

বলা হচ্ছে, রাজশাহীতে এই প্রাইভেট ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিকগুলো বিপুল সংখ্যক রোগীদের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতে ভূমিকা রাখছে।

এ দিকে এবছর জুলাই পর্যন্ত নতুন লাইসেন্সসহ পুরাতনগুলোর নবায়নের জন্য রাজশাহী সিটি ও উপজেলা মিলিয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে আবেদন জমা পড়েছে মোট ৩১৮টি। এছাড়া ব্লাড ব্যাংকের জন্য আবেদন পড়েছে ৬টি। ৩০ জুলাই আবেদনের শেষ তারিখ থাকলেও আবেদন ফি কয়েকশগুণ বৃদ্ধি করে তা আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় বেধে দেয়া হয়েছে।

তবে অভিযোগ রয়েছে, লাইসেন্সতো পরের কথা, আবেদনের আগেই ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো তাদের ব্যবসার পসরা সাজিয়ে বসে। চাকচিক্যময় অফিসে ব্যবসা পুরোদমে সাজিয়ে বসলেও সেখানে থাকেনা প্রয়োজনীয় জনবলসহ আধুনিক যন্ত্রপাতি। আর এর সবই হয় স্থানীয় সিভিল সার্জেন অফিসের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে রাজি খুশির মাধ্যমে।

রাজশাহীতে ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিকদের ১১২ সদস্যের একটি সংগঠন রয়েছে। বাংলাদেশ ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন রাজশাহী নামে সংগঠনটির সভাপতি ডা. এএসএম মান্নান জানান, তারাও নিয়ম শৃঙ্খলার মধ্যে থেকে সকলের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে চান। তবে সরকারি কিছু নিয়ম নীতি রয়েছে যা দেশের প্রেক্ষাপটে কিছুটা অসম্ভব। দেশে পর্যাপ্ত ডাক্তার ও নার্সের অভাব রয়েছে।

তিনি অভিযোগ করে বলেন, রাজশাহীতে যেগুলো অনুমোদনহীন ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে, সিভিল সার্জেন বিভাগের সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করে তারা বাজারে টিকে আছে। নতুন প্রতিষ্ঠান অনুমোদনের বিষয়ে তিনি আরও জানান, নতুন প্রতিষ্ঠানের আবেদনের প্রেক্ষিতে সিভিল সার্জেন সেগুলো পরিদর্শন করেন ও তাকে রাজি খুশি করতে পারলে, তিনি ভালো বললেই মেলে লাইসেন্স।

রাজশাহী জেলার সিভিল সার্জন ডা. কাজী মিজানুর রহমান জানান, অনিয়ম আছে এমন বেশ কিছু ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে আমরা চিহ্নিত করেছি। খুব শীঘ্রই রাজশাহীর স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালককে সাথে নিয়ে অভিযানে নামা হবে।

তিনি সিভিল সার্জেন বিভাগের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রেক্ষিতে বলেন, নির্দিষ্ট নিয়ম নীতি পূরণ ও জনবল দেখানোর প্রেক্ষিতেই লাইসেন্স দেয়া হয়। আবেদন সম্পূর্ণ অনলাইনে করতে হয়। এখানে অনিয়ম করার সুযোগ নেই। সরকার যে নিয়ম করছে তাতে আগামীতে ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর অনিয়ম প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। একজন ডাক্তার বা নার্স দুই জাগায় কাজ করতে পারবে না। চিকিৎসক নার্সদের কে কোথায় কাজ করছে তার তথ্য অনলাইনেই থাকবে।

ওডি/আরবি

আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড