• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৯ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

দালালদের দখলে মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল

  রিয়াদ হোসাইন, জেলা প্রতিনিধি,মুন্সীগঞ্জ

২৯ জুন ২০১৯, ১২:০৬
হাসপাতাল
মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের ভেতরের দৃশ্য ( ছবি : দৈনিক অধিকার)

মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের ভেতরে-বাইরে দীর্ঘ দিন ধরে বেপরোয়াভাবে চষে বেড়াচ্ছে বিভিন্ন ক্লিনিক ও ডাগায়নস্টিক সেন্টারের নিযুক্ত দালালদের একটি সক্রিয় সিন্ডিকেট। ব্যাঙের ছাতার মতো শহরের বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা প্রায় ২০টি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিকরাই রোগী ভাগিয়ে নেওয়ার জন্য দাললদের মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে নিয়োগ দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

এসব দালালদের কমিশন হিসেবে বেতন দেয় বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিকরা। কিন্তু তারা দায়িত্ব পালন করেন মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের বিভিন্ন ডাক্তারদের রুমে। এক একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারের একাধিক দালাল রয়েছে। একজন থাকে ঘোরা ফেরার মধ্যে। আরেকজন থাকে কর্তব্যরত ডাক্তারদের রুমে। অন্যজন ব্যস্ত থাকে রোগীদের নিয়ে নির্ধারিত ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষা নিরীক্ষা করানোর কাজে। এভাবেই প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত জেনারেল হাসপাতাল জুড়ে চলে অর্ধশতাধিক দালালের রোগী নেওয়ার কার্যক্রম।

বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দালালদের সরাসরি প্রশ্রয় দিচ্ছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এসব দালালদের পুষে রাখেন কর্তব্যরত ডাক্তাররা। ডাক্তারাই রোগীদের অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা দিয়ে দালালদের হাতে তুলে দেয় বাইরে তার নিযুক্ত ডায়াগনস্টিক সেন্টারের পরীক্ষা করতে যাওয়ার জন্য। হাসপাতালে যেসব পরীক্ষা হয় সেগুলোও বাইরে করায় শুধুমাত্র কমিশন পাওয়ার লোভে। এতে করে বেপরোয়া দালালরা রোগীদের নিয়ে টানা-হেঁচড়া শুরু করে এবং তাদের ভুল বুঝিয়ে নির্ধারিত ল্যাবে নিয়ে পরীক্ষা করায়।

সরেজমিনে অনুসন্ধান করে দেখা যায়, সকাল ৯টা থেকেই ডাক্তারদের রুমের সামনে দায়িত্ব পালন করছে বিভিন্ন ক্লিনিকের দালালরা। রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে আরেক গ্রুপ। রোগী দেখা নিয়ে চলে ডাক্তারদের ব্যস্ততা। ডাক্তার রুমে দাঁড়িয়ে থাকা দালালকে ইশারা করেন আবার কখনো বলেন ওর সঙ্গে গিয়ে পরীক্ষাগুলো করে নিয়ে আসেন। তখন রোগীরা মনে করেন লোকটা হয়তো ডাক্তারের লোক বা সরকারি কর্মচারী। ফলে সরল বিশ্বাসে রোগীরা দালালদের মাধ্যমে ডায়াগনস্টিকসেন্টারে গিয়ে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

এতে আঙুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে ডায়াগনস্টিক ল্যাব মালিক ও কমিশন লোভী ডাক্তাররা। এছাড়া বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের দৌরাত্ম্য চোখে পড়ার মতো। কোম্পানির প্রতিনিধিরা ডাক্তারদের বিভিন্ন অনৈতিক সুবিধা দিয়ে ব্যবস্থাপত্রে তাদের ওষুধ কোম্পানির ওষুধ কৌশলে লিখিয়ে নিচ্ছেন।

অনুসন্ধানকালে দেখা গেছে, দালালদের কর্মতৎপরতা। নারী-রোগীর হাতে টিকেট দেখা মাত্রই টেনে নিয়ে যাচ্ছেন পরা নারী দালালরা। গ্রাম থেকে আসা রোগীরা যখন জানতে চায় পরীক্ষা করাব, রুমটা কোথায়? তখনই দালালরা কৌশলে রোগীকে ভুল বুঝিয়ে বলে এখানে পরীক্ষা করালে ভালো হবে না। মেশিন নষ্ট, সরকারি পরীক্ষা ভালো হবে না। আমার সঙ্গে চলেন কমের মধ্যে করিয়ে দিব। এভাবে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত রোগীদের নিয়ে টানাটানি করেন প্রায় অর্ধশতাধিক দালাল।

হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী মাহমুদা বেগম বলেন, হাসপাতালের ডাক্তাররাই বিভিন্ন ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দালালদের আশ্রয় দিচ্ছে। প্রকাশ্যে প্রতিটি রুমে ক্লিনিকের দালাল মেয়েরা সিরিয়াল ম্যানেজ করার অজুহাতে দাঁড়িয়ে থাকে। ডাক্তার রোগীর পরীক্ষা লেখার সঙ্গে সঙ্গে রোগীর হাত থেকে স্লিপ টেনে নিয়ে ভুল বুঝিয়ে বাইরে পরীক্ষা করতে নিয়ে যায়। আমার মায়ের কাগজসহ আমার মাকে একজন দালাল বাইরে নিয়ে গিয়ে ১৫শ টাকার পরীক্ষা করিয়েছে। এখন ওষুধ কেনার টাকা নেই।

দালালের খপ্পরে পড়া আরেক রোগী সুরুজ মিয়া বলেন, কয়েকজন দালাল আমাকে জোর করে বাইরে নিয়ে যায়। আমি বলছি, আমার কাছে টাকা নেই পরে এসে পরীক্ষা করাব। তবুও তারা আমাকে নিয়ে বলে যা আছে জমা দিয়ে করে যান পরে পুরো টাকা দিয়ে রিপোর্ট নিয়েন। এখন ১২শ দিয়ে রিপোর্ট নিয়ে এলাম। ডাক্তার আমার রিপোর্টগুলো দেখে বলল যা লিখছি তাই খাবেন। পরীক্ষায় কী ধরা পড়ল তার উত্তর না দিয়েই বলেন, কোনো সমস্যা নেই। ওষুধ খান ভালো হয়ে যাবেন।

মুন্সীগঞ্জ জেলা ক্লিনিট ও ডায়াগনস্টিক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন সভাপতি আয়নাল হক স্বপন বলেন, শুধু ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের নয় বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরাও ডাক্তারদের অফিস চলাকালীন হাসপাতালে প্রবেশ করা ঠিক না। জরুরি ভিত্তিতে এদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। তাহলে স্বল্প খরচে রোগীরা হাসপাতালেই পরীক্ষা নিরীক্ষা করাতে পারবে। তাতে সুচিকিৎসা নিশ্চিত হবে।

জেলা ক্লিনিট ও ডায়াগনস্টিক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আক্কাস আলী বলেন, হাসপাতালে আমার কোনো দালাল নেই। আমি সব সময় দালালদের বিরুদ্ধে। সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে দালাল থাকা মানেই বদনাম আর রোগীদের ঠকানো।

এ ব্যাপারে সিভিল সার্জন ডা. মো. ফজলে রাব্বি বলেন, দালালদের নিয়ন্ত্রণের জন্য হাসপাতালে সিসি টিভি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। সিসিটিভির ফুটেজ পর্যালোচনা করে দালালদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাছাড়া আমাদের ভ্রাম্যামাণ আদালতের কার্যক্রম চলমান আছে। ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা সাপ্তাহে দুই দিন ভিজিট করতে পারবে দুপুর ১২টার পর থেকে। এছাড়া জরুরি বিষয় ছাড়া কোনো সময় তারা হাসপাতালে প্রবেশ করতে পারবেন না।

হাসপাতালের ভেতরে-বাইরে রয়েছে দালাল সিন্ডিকেট। এদের ঐক্যও বেশ মজবুত। আর তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেন খোদ হাসপাতালের ডাক্তার ও স্টাফরা। অনেকটা সর্ষের মধ্যে ভূত। সাধারণ রোগীদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে, দালালদের প্রশ্রয় প্রদানকারীদের চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও স্বজনদের।

ওডি/ এসএএফইউ

আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড