• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৮ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

ঝড়ে ভাঙল গাছ, তৈরি হলো তুফান পীরের মাজার

  অধিকার ডেস্ক    ২৪ মে ২০১৯, ০৬:২৪

তুফান পীরের মাজার
পঞ্চগড়ের ঝড়ে ভেঙে পড়া গামার গাছ। (ছবি : সংগৃহীত)

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত সংলগ্ন জেলা পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলায় ঝড়ে পড়ে যাওয়া একটি গামার গাছকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা হয়েছে তুফান পীরের মাজার। যেখানে কাগজে লিখে দেওয়া হয়েছে নিয়ত করলে ফল মিলবে। আর এতেই অন্ধ বিশ্বাসের সঙ্গে মানত করতে শুরু করেছেন অনেকে।

মাজারে জ্বলতে শুরু করেছে আগরবাতি, মোমবাতি। আর টাকা-পয়সা, আগরবাতি, গোলাপ জল পড়ছে প্রতিনিয়ত। এ যেন আধুনিক বাংলা সাহিত্যের কথাশিল্পী সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লালসালুরই একবিংশ শতকের এক নতুন সংস্করণ।

গত ১৭ মে ভোরবেলায় উপজেলার সোনাহার মল্লিকাদহ ইউনিয়নের গজপুরী গ্রামে ঝড়ো বাতাসে সেই এলাকার সাবেক গ্রাম সরকার তোফাজ্জল হোসেনের দুটি বড় আকৃতির গামার গাছ পড়ে যায়। গাছটি স্থানীয়ভাবে পিঠালি গাছ নামে পরিচিত। গাছ মূলত পাশের সড়কের ওপর পড়লে পথটি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। পরে গাছের মালিক তাৎক্ষণিক গাছটি স্থানীয় কাঠ ব্যবসায়ী বাবুল হোসেনের কাছে বিক্রি করে দেন এবং দ্রুত কাঠুরিয়া দিয়ে গাছটি কেটে ফেলার নির্দেশ দেন।

আর এতেই কাঠুরিয়ারা এসে প্রথমে সড়কের ওপরে থাকা গাছের ডালপালা ছাঁটিয়ে দেন। ডালপালা কাটার পর গোড়ালির ভর বেশি হওয়ায় গাছটি নিজে থেকেই আবারও ধীরে ধীরে আগের মতো দাঁড়িয়ে যেতে শুরু করে। এলাকাবাসীর মতে এই গাছটি ৫/৬ বছর আগেও আরও একবার ঠিক একইভাবে পড়ে গিয়ে পুনরায় উঠে যায়। মূলত গোঁড়ালির মাটির ভরের কারণে গাছটি সে বার উঠে গেলেও স্থানীয় একটি চক্র গাছের অলৌকিক ক্ষমতা আছে বলে গুজব ছড়িয়ে দেয়।

যে কারণে কাঠুরিয়ারা জীবন বাঁচাতে গাছ কাটা বন্ধ করে বাড়ি চলে যায়। আর এই কথা দশ কান পর্যন্ত পৌঁছাতেই রাতারাতি এলাকার বাসিন্দা মোবারক হোসেনের ছেলে ইসমাইল হোসেন লালসালু এনে তা মাজারের আদলে ঘেরাও করে তুফান পীরের মাজার হিসেবে ঘোষণা করে দেন। একই সঙ্গে তিনি নিজেকে কথিত সেই মাজারটির মুরিদ ও খাদেম বলেও দাবি করতে শুরু করেন। পরবর্তীতে সে কাজে তার সঙ্গে যোগ হয় গ্রামের আরও কিছু মানুষ।

স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মামুন শাহ প্রথমে তার ফেসবুকে ‘দুইশ বছরের আগের পীরের সন্ধান, ওপরে পড়া গাছকে বার বার জীবন্ত করে’ শিরোনাম দিয়ে প্রচারণা শুরু করেন। মূলত এরপরই আর দশটি মাজারের মতই ওই গামার গাছের প্রাঙ্গণ হয়ে উঠে তুফান পীরের মাজার।

সেখানে লেখা হয় নিয়ত করলে ফল মিলবে। আর এরপরই জেলার দূর দূরান্ত থেকে মানুষরা মাজার পরিদর্শনে আসতে শুরু করে। টাকা পয়সা দান দক্ষিণা করার পাশাপাশি মাজারে মোমবাতি, আগরবাতি জ্বালানো হয়। এছাড়া কেও দুধ ঢেলে মানত করে যাচ্ছেন বলেও দাবি স্থানীয়দের।

স্থানীয়দের মতে, ওই স্থানটিতে আগে কোনো মাজার ছিল না। তাছাড়া এখানে কোনো কবরও ছিল না। কিছু সংখ্যক লোক এখন সেটিকেই মাজার বানানোর চেষ্টা করছে। মাজারের প্রতি দুর্বল মানুষরা প্রতিদিন ছুটে আসছে এখানে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেই এলাকার এক হিন্দু গৃহবধূ বলেন, ‘আমি গাছের পাশেই কাজ করছিলাম। গাছটি নিজে থেকেই উঠে গেলে ইসমাইল আমার কাছে লাল কাপড় চায়। তখন আমি তা না দেওয়ায় সে কোথা থেকে যেন একটা লাল কাপড় এনে ঘেরা দিলে আর একটা বস্তা বিছিয়ে দিল। তারপর থেকেই এখানে টাকা পয়সা পড়তে শুরু করেছে।’

এ দিকে প্রত্যক্ষদর্শী কাঠুরিয়া জাকিরুল ইসলাম বলেন, ‘গাছটির গোড়ালিতে অনেক মাটি ছিল। আমরা ডালগুলো কেটে দেওয়ার পরেই গাছটি আবার দাঁড়িয়ে যায়। এরপর ভয়ে আমরা চলে যাই। পরে এসে দেখি লাল কাপড় দিয়ে ঘেরা দিয়ে তুফান পীরের মাজার করা হয়েছে। মানুষ দূর দূরান্ত থেকে এসে মানত করতে শুরু করেছে, তারা নাকি টাকা পয়সাও দিচ্ছে।’

এলাকাটির প্রবীণ বাসিন্দা ওমর আলী বলেন, ‘আমি এখানে ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বসবাস করেছি। কখনো শুনিনি এখানে মাজার আছে। গাছ পড়ে দাঁড়িয়েছে গোড়ালিতে ভার বেশি ছিল তাই। কিন্তু এখন মাজার বানিয়ে ফেলেছে। অনেকে টাকা পয়সাও দান করতেছে।’

গাছের মালিক তোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘আমি তো গাছটি বিক্রি করে দিয়েছি। কিন্তু কাঠুরিয়ারা ভয়ে কাটছে না। এখানে কে লালসালু দিয়ে মাজার করেছে আমি তাও বলতে পারছি না। তবে এখানে মাজার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হলে আমরা তা মেনে নেব না।’

অপর দিকে সোনাহার ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মামুন শাহ বলেন, ‘কিছু দুষ্ট ছেলের কাজ এটা। তবে কিছু মানুষ এসব বিশ্বাস করে। এখানে যেন মাজার হতে না পারে আমরা সেটাই চেষ্টা করব।’

যদিও মাজারের কথিত খাদেম ইসমাইল তুফান পীরের মাজার ঘোষণায় তার জড়িত থাকার বিষয়টি পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন।

দেবীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রত্যয় হাসান বলেন, ‘তুফান পীরের মাজার নাম দিয়ে একটি গাছকে কেন্দ্র করে স্থানীয় কিছু কুসংস্কারাচ্ছন্ন লোক ব্যবসায়িক কিংবা অন্ধ বিশ্বাসে মাজারের রূপ দেয়ার চেষ্টা করছে। এ বিষয়ে আমরা পুলিশ প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গেও কথা বলেছি।’

উপজেলা এই নির্বাহী কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘আমরা প্রথমে স্থানীয়দের সচেতন করে কথিত মাজার প্রতিষ্ঠা থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করব। তবে তারপরও যদি তারা সরে না আসে তাহলে শক্তি প্রয়োগ করে হলেও মাজার প্রতিষ্ঠা বন্ধ করা হবে।’

ওডি/কেএইচআর

আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড