• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৮ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

প্রমত্তা নদীগুলো আজ কেবলই ছবি

  শাকিল মুরাদ, শেরপুর

১৯ মার্চ ২০১৯, ১৬:৩০
শেরপুর
নদী এখন চাষের জমি

নদী মাতৃক আমাদের বাংলাদেশ। আর নদী মাতৃক বাংলাদেশের মধ্য শেরপুর জেলাও অন্যতম। এ জেলায় অন্তত দেড় ডজন নদী ছিল। পাট ও ধান উৎপাদনকে কেন্দ্র করে ব্যবসা বাণিজ্যে শেরপুরের সমৃদ্ধি ছিল বেশ। রেলপথ বিহীন শেরপুরের সড়ক পথে যোগাযোগ ছিল একেবারেই সীমিত। শেরপুরের ব্যবসা বাণিজ্যের যাতায়াত ও যোগাযোগ হতো নদী পথ দিয়ে।

ইতিহাস বলে শেরপুরের নদী পথে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যও সম্পাদিত হতো। হাজারও মানুষের জীবিকার অন্যতম মাধ্যম ছিল এই নদী। জেলার সেই নদীগুলো আজ অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। নাব্যতা হারিয়ে বিলীন হয়ে গেছে শেরপুরের অনেক নদী, খাল-বিল। নদীর বুক চিরে চলছে আবাদ ফসল। নির্মান করা হয়েছে ঘর বাড়িসহ নানা প্রতিষ্ঠান। কালের বিবর্তনে জেলার বেশ কয়েকটি প্রধান নদীর নামেরও পরিবর্তন হয়ে গেছে।

এক সময়ের মৃগী নদীতে ছিলো টলটলে জল। শহরের মানুষ প্রশান্তির স্থান ছিলো এই মৃগী নদীতে। শহরের মানুষের নির্মল বিশুদ্ধ বায়ু সেবনের তীর্থ স্থান বলে খ্যাত এই নদীটি এখন আধুনিক পৌর শহরের বর্জ্যরে আস্তানা। শহরের বিশাল ড্রেন নামিয়ে দেওয়া হয়েছে মৃগী নদীর বুকে। বিলিন হয়েছে নদীর সুস্বাধু মিঠা পানির মাছ। পানির র্দূগন্ধে মৃগী নদী এখন রোগীতে পরিণত হয়েছে।

স্থানীয় মোরুব্বিদের কাছে এক কালের সেই নদী গুলো আজ কেবলি ছবি। শেরপুরের প্রায় দেড় শত বছর আগের ইতিহাসে ১৬টি প্রধান নদী ও ৯টি ক্ষুদ্র নদীর কথা উল্লেখ রয়েছে। প্রাচীণ ঐতিহাসিক গ্রন্থে যে ১৬টি প্রধান নদীর নাম উল্লেখিত আছে সেগুলো হচ্ছে- ব্রহ্মপুত্র, মালিঝি, সোমেশ্বরি, মৃগী, নেত্রবতী, মহাঋষি, থলঙ্গ, ভোগবতী, খারুয়া, দর্শা, ভুরাঘাট, বলেশ্বরি, সুতী, মরাখড়িয়া, বৃদ্ধ ভোগবতী ও খড়িয়া

আরও পড়ুন : (ঘুরে আসুন শেরপুরের সীমান্ত সড়কে)

এগুলোর মধ্যে মরা বা আধামরা হয়ে ৮টি নদী এখনও কালের সাক্ষি হয়ে কোন রকম বেঁচে রয়েছে। অন্য ৮টি নদী এখন শুধুই ইতিহাস। যে ৮টি নদী কোন রকমে টিকে রয়েছে তারমধ্যে ব্রহ্মপুত্র, মৃগী, সোমেশ্বরি ও মালিঝি পূর্ব নামেই এখনো পরিচিত। আর যে ৪টি নদীর নাম পরিবর্তন হয়েছে সেগুলো হলো- ভোগবতী থেকে ভোগাই, মহাঋষি থেকে মহারশি, থলঙ্গ থেকে চেল্লাখালি এবং নেত্রবতী থেকে নেতাই নদী। অন্য নদীগুলোর বিলুপ্তি ঘটেছে।

অপর দিকে ‘দশানি’ নামে নতুন একটি নদীর সৃষ্টি হয়েছে। শেরপুরের এক সময়ের বিখ্যাত নেতাই নদী নেতাই খালে রূপান্তরিত হয় পরবর্তিতে একেবারেই হারিয়ে গেছে। নতুন প্রজন্ম এই নদীর নামও এখন আর জানেনা। অথচ এই নেতাই সাবেক শেরপুর পরগণার মধ্যে ৪৩ মাইল দীর্ঘ নদ বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়।

এছাড়া মৃগী নদীর দৈর্ঘ্য ২৯ মাইল, ব্রহ্মপুত্র নদ সাড়ে ১০ মাইল, মালিঝি সাড়ে ৩৫ মাইল, চেল্লাখালি ১২ মাইল, সোমেশ্বরি সাড়ে ১৮ মাইল, মহারশি ১৫ মাইল এবং ভোগাইনদী ১৬ মাইল দীর্ঘ ছিলো। এখন নদী গুলো পরিমাপ করার অবস্থায় আর নেই। আর নকলার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া সূতি নদীকে ঘিরে বৃটিশে চন্দ্রকোণায় গড়ে উঠেছিল বিশাল বন্দর। আর আজ সেই সূতি এখন প্রভাবশালিদের মৎস খামারে পরিণত হয়েছে।

হিমালয়ের মানস সরোবর থেকে ব্রহ্মপুত্র নদটি চীন ও ভারত হয়ে বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করে জামালপুর ও সিরাজগঞ্জ হয়ে শেরপুর জামালপুর সীমা রেখায় প্রবাহমান হয়েছে। শেরপুর জামালপুর অংশের এই ব্রহ্মপুত্র, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ নাম ধারন করেছে। এই ব্রহ্মপুত্র নদ শেরপুর-জামালপুর জেলার বিশাল চরা লের আর্শিবাদ ছিল। কালের পরিক্রমায় আজ নদীটি ছোট একটি খালের মত হয়ে গেছে; কিন্তু প্রতি বর্ষা মৌসুমে অভিশাপ হয়ে দাড়ায়। বর্ষাকালে পুরুষ এই ব্রহ্মপুত্র নদ আগ্রাসী রূপ ধারণ করে চরা লকে বন্যায় ভাসিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে।

আরও পড়ুন : (শেরপুরের ‘রং মহল’কে গোল্ডেন হেরিটেজ হিসেবে রাখার দাবি)

ভারতের মেঘালয় রাজ্যের তুরাপাহাড় থেকে কংস নদীর জন্ম হয়ে শেরপুরের হাতিবাগার এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ভারতে এর নাম কংস হলেও শেরপুরের নালিতাবাড়ীর হাতিবাগার এসে এ নদীর নাম হয়েছে ভোগাই। নালিতাবাড়ীর ৫ কিলোমিটার ভাটিতে আসিন দীটি দিংঘানা , চেল্লাখালি, মহাররি, মালিঝি ইত্যাদি বাহারি নামে উপনদীর নাম ধারন করে আবার ভোগাই নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। এই ভোগাই নদীটি ময়মনসিংহের ফুলপুরের খড়িয়া নদীর সাথে মিশে গেছে। খরিয়া নদীটি আবার ব্রহ্মপুত্র নদের সাথে মিশেছে।

দীর্ঘদিনের দখল আর নানা উৎপাতে বাহারি নামের এই নদী গুলো আজ বিলিন হয়ে গেছে। অথচ বিশাল পাহার ঘেরা ভারতের মেঘালয়ের পাহাড়ি ঢলের পানি ধারন করত এই নদীগুলো। নদী শেষ হলেও মেঘালয়ের পাহাড়ি ঢল এখন ভোগাই, চেল্লাখালি, সোমেশ্বরি, মহারশির নদীর দুকূলে রৌদ্র মূর্তিতে আবর্তিত হয়। বর্ষায় প্রতি বছর পাহাড়ি ঢলের সাথে নেমে আসা বালি-পলিতে ভরাট হয়ে পড়েছে নদ-নদীগুলোর আশপাশ। খননের অভাবে জেলার প্রায় সব নদীতেই পানির সংকট। পানি না থাকায় নদীর ওপর দিয়ে হেঁটে চলাচল করে পথচারিরা। এছাড়া পাহাড়ি ঢলের সাথে উজান থেকে আসা বালির আস্তর পড়ে ভাটির দিকের শতশত একর ফসলি জমি অনাবাদি হয়ে পড়ছে।

অপরদিকে অপরিকল্পিত এবং অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের প্রতিযোগিতা নদী গুলোকে প্রতিদিন করছে শ্রীহীন। এই অঞ্চলে একমাত্র ব্রহ্মপুত্র নদ ছাড়া সবগুলো নদীর উৎপত্তিস্থল প্রতিবেশী ভারত। ভারত থেকে গারো পাহাড় হয়ে শেরপুর দিয়ে মিশে গেছে অন্যান্য নদীতে।

শেরপুরের ইতিহাসের বিখ্যাত গ্রন্থ আকবরগ্রন্থ ‘নাগ বংশের ইতিবৃত্ত’ ও ‘শেরপুর টাউনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’বইসূত্রে জানা যায়, ১৮৮৫, ১৮৯৭ এবং ১৯১৮ সালে এই অঞ্চল জুড়ে প্রবল ভূমিকম্প হয়। এর ফলে শেরপুরের বেশ কিছু নদ-নদী, খাল-বিল সমূহের গতি পরিবর্তিন ও ভরাট হয়ে যায়।

এছাড়া গত শতাব্দির পাশের দশকে গারো পাহাড় এলাকায় নির্বিচারে বনভূমি ধ্বংস এবং পাহাড়ি টিলা খুঁড়ে পাথর উত্তোলন শুরু হয়। এর ফলে উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানির সাথে পাথর তোলা আগলা বনভূমির মাটি, বালি-পলিতে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যেতে শুরু করে। আধুনিক নগরের বর্জ্য পলিথিনের জায়গা হয় এসব নদী বক্ষে।

আরও পড়ুন : (নতুন প্রজন্ম মনে রাখবে মুক্তিযোদ্ধা জহুরুল হক মুন্সির কথা)

তাছাড়া উন্নয়ন ও উৎপাদন বাড়াতে ব্রহ্মপুত্র, মহারশি, সোমেশ্বরি, ভোগাই, চেল্লাখালি নদীর স্থানে স্থানে অপরিকল্পিত বাঁধ, সুইস গেট নির্মাণের ফলে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাঁধা প্রাপ্ত হয়। ফলে আস্তে আস্তে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে চর জেগে উঠে। কিন্তু নদী খননের কার্যকর কোন উদ্যোগ-আয়োজন না থাকায় নাব্যতা হারিয়ে নদীগুলো আজ প্রবাহহীন। জেগে ওঠা চর চলে যায় প্রভাবশালীদের হাতে। নদীর বুকে চলে চাষাবাদ, গড়ে ওঠে বসত বাড়ী।

নানা বিবর্তন পরিবর্তন প্রাকৃতিক অপ্রাকৃতিক ও জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে নাব্যতা হারানো নদীগুলো এখন পরিণত হয়েছে সামান্য জলাধারে। নদী তার প্রাকৃতিক গতি হারানোর ফলে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ও জলজ প্রাণি। এই নদী গুলোকে বাচাঁতে বিভিন্ন সংগঠন একাধিক বার দাবি জনালেও এখন পর্যন্ত দৃশ্যত কিছুই হয়নি।

বিশিষ্ঠ জনদের দাবী, নদী সম্পর্কে সচেতনতা তৈরী ও নদী সুরক্ষায় সংগঠিত হওয়া জরুরী। মিলিত উদ্যোগ ও সক্ষমতা আমাদের নদী বাঁচাতে সহায়তা করবে। নদী রক্ষা আইনের মাধ্যমে নদীর পুনঃখদল ও খনন করে নদী প্রাকৃতিক কাছে ফিরিয়ে দিতে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে। আর নদী বাচাঁতে না পারলে পরিবেশ দূষণের বিপর্যয় থেকে আমাদের কেউ রক্ষা করতে পারবে না।

শেরপুর জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডর উপ-সহকারি প্রকৌশলি মো. আব্দুল হান্নান জানান, সরকার ইতিমধ্যে জেলা প্রশাসনকে সম্পৃক্ত করে নদী খাল দখল মুক্ত করতে কমিটি করেছে। সরকারের ডেল্টা বহুমুখি প্রকল্পের মাধ্যমে ২০২১ সালের মধ্যে সকল নদী খাল দখল মুক্ত ও পুন:খনন শেষ করবে। তবে ২০২০ সালের মধ্যে শেরপুরের বিখ্যাত মৃগী নদী, মালিঝি নদী ও ভৌলি বিল দখল মুক্ত ও পুন:খননের ব্যবস্থা করা হবে।

আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড