• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৯ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

বিলুপ্তপ্রায় অমৃত স্বাদের অমৃত সাগর

  মো. আল ফাহাদ

১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৯:২৬
অমৃত সাগর
অমৃত সাগর কলা (ছবি : দৈনিক অধিকার)

কলা নামক বারোমাসি ফলটির সঙ্গে যে জেলার নাম সম্পৃক্ত তা হলো নরসিংদী। জেলার সবচেয়ে বেশি কলা উৎপাদিত হয় মনোহরদীতে। ১৮ জাতের কলার প্রায় ১২ জাতই মনোহরদীতে উৎপাদিত হয়। আর যে কলার জন্য নরসিংদী তথা মনোহরদীর খ্যাতি দেশ-বিদেশে তা হলো অমৃত সাগর।

‘নরসিংদীর ব্রান্ড’ হিসেবে অমৃত সাগর কলার চাহিদা আকাশচুম্বী। রাষ্ট্রীয় অতিথিদের খাদ্য তালিকার শুরুতে এর স্থান অবধারিত। নরসিংদী সদর, পলাশ, ঘোড়াশাল, শিবপুর ও মনোহরদী উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় চাষ করা হয় এ কলা। অমৃত সাগর কলার সমকক্ষ কলা এ দেশে নয়, বিদেশেও বিরল। মাঝারী আকার ও হলুদ রঙের এ কলার স্বাদ ও গন্ধ অতুলনীয়।

অমৃত কলার সঙ্গে দুধের রয়েছে অপূর্ব রাসায়নিক মিল। অমৃত সাগর কলা পাকলে সারা বাগান সুগন্ধে ভরে যায়। এর সঙ্গে দুধের মিশ্রণ ঘটলে সারা ঘর মৌ-মৌ সু-গন্ধে উতলা হয়ে যায়। কৃষি বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, নরসিংদীর অমৃত সাগর কলার এই মিষ্টি গন্ধ ও মিষ্টি স্বাদ এর মাটির গুণেই হয়ে থাকে। নরসিংদীর এই কলা অন্য কোনো জেলা/ এলাকায় রোপণ করলে গাছ বড় হয়, কলাও ফলে, কিন্তু নরসিংদীর অমৃত সাগর কলার মতো গন্ধ ও স্বাদের হয় না। মাটির গুণগত বৈশিষ্ট্যের কারণেই এই কলা দেশ- বিদেশে সমাদৃত হয়েছে।

কলাতে রয়েছে আমিষ, ভিটামিন এবং খনিজ লবণ। একটি বড় মাপের কলা খেলে ১০০ ক্যালরির বেশি শক্তি পাওয়া যায়। কলার মধ্যে থাকা আয়রন রক্তে হিমোগ্লোবিন উৎপাদনে সহায়তা করে। ১টি কলাতে প্রায় ৫০০ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম থাকে। আর মানবদেহের জন্য ১৬০০ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম ২ থেকে ৩ টা কলা খেলেই পাওয়া যায়। ফলে স্ট্রোকের হাত থেকে বছরে বেঁচে যেতে পারে প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ।

যারা একবার নরসিংদীর অমৃত সাগর কলা খেয়েছে, তারা অন্য কোনো কলা খেয়ে সেই স্বাদ পায় নি। বাইরে থেকে নরসিংদীতে মেহমান এলে প্রথমে যেটা দাবি করে সেটা হলো সেটা হচ্ছে অমৃত সাগর কলা। মেজবানরা হন্যে হয়ে বাজারে বাজারে ঘুরে অমৃত সাগর কলা সংগ্রহ করে মেহমানদের আপ্যায়ন করেন।

একসময় নরসিংদীর অমৃত সাগর এতই জনপ্রিয় ছিল যে তা পরিবহনের জন্য বাংলাদেশ রেলওয়ের বিশেষ ট্রেন সার্ভিস চালু করেছিল, যে ট্রেনের নাম ছিল কলার গাড়ি। সন্ধ্যার পর কলার গাড়িতে তুলে এসব কলা রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হতো। কলাবেচা কেনার জন্য ব্রিটিশ আমল থেকে গড়ে উঠেছে হাট-বাজার। মনোহরদীর সাগরদী বাজারের নামকরণ সাগর কলা থেকে। এছাড়া, হাতিরদিয়া, চালাকচর, চরসিন্দুর, গজারিয়া, তালতলী, পারুলিয়া, কালির বাজার, শীলমান্দি,ফতেহপুর, শিবপুর, সিঅ্যান্ডবি বাজারে বিপুল সংখ্যক বাজারে কলা বেচা কেনা হতো।

নরসিংদীর অমৃত সাগর কলার ভূয়সী প্রশংসা করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, নরসিংদীর সাবেক উপ-পরিচালক কৃষিবিদ লতাফত হোসেন বলেন, ২০ বছর ধরে নরসিংদী এলাকায় চাকরির অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি নরসিংদী সদর উপজেলার শীলমান্দী, পলাশ উপজেলার চরনগরদী, চিনিশপুর, পারুলিয়া এবং মনোহরদীর একদুয়ারিয়া, দৌলতপুরে যে অমৃত সাগর উৎপাদিত হয় তা বিরল। এই কলা কেউ একবার খেলে, কেউ এর স্বাদ কখনো ভুলতে পারবে না।’

কলা

ফুড ব্যাগিং পদ্ধতিতে কলা চাষ (ছবি : দৈনিক অধিকার)

দেশের অনেক স্থানে এ জাতের কলার চাষ করা হলেও নরসিংদীর অমৃত সাগরের সমকক্ষ হতে পারছে না কেন? এ প্রশ্নের জবাবে একাধিক কৃষিবিদ বলেন, এ জাতের কলা চাষের জন্য যে ধরনের মাটি দরকার তা নরসিংদী ছাড়া অন্য কোথায়ও নেই। লালচে সমতল ও কিঞ্চিত উচুঁ জমিতে এ কলার চাষ করা হয় যেখানে সাধারণত পানি জমে না। এছাড়া কলা চাষিদের বংশ পরম্পরায় সঞ্চিত শত বছরের অভিজ্ঞতার পাশাপাশি জৈব ও অজৈব সার ব্যবহার করা হচ্ছে।’

একসময় অমৃত সাগর জাতের কলা নরসিংদীর কৃষকদের অর্থনীতির চালিকাশক্তি ছিল। অনেক পরিবার শুধু কলার চাষ করেই জীবিকা নির্বাহ করত।সেই স্বর্ণযুগ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। জৈবিক উপায়ে কলা চাষের ফুড ব্যাগিং পদ্ধতিও আবিষ্কার করা হয়েছে। সাধারণত কলাতে বিটল পোকা, পানামা রোগ, বানচিটপ ভাইরাস ও সিগাটোকা রোগের আক্রমণ হয়ে থাকে। বিটল পোকার আক্রমণে হলে কলা কালো দাগযুক্ত হয়। তাই কলার কাঁদি পলিথিন দিয়ে মুড়িয়ে বিষমুক্ত উপায়ে বিষমুক্ত উপায়ে কলা চাষ করা হচ্ছে। অনেক দেশে অধিক পরিমানে নীরোগ চারা উৎপাদনের জন্য টিস্যু কালচার পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে।

উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি ও রোগ- বালাইসহ নানা প্রতিকূলতায় নরসিংদীতে অমৃত সাগর কলার চাষ কমে গেছে। দিন দিন জেলায় কলার বাগান কমে ঠেকেছে হাতেগোনা কয়েকটিতে। বর্তমানে জেলার ২ হাজার ১৩৫ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন জাতের কলার চাষ হয়ে থাকে। এর মধ্যে বিদেশী নেপালি কলা, বারি-১ জাতের কলার চাষাবাদ করা হচ্ছে। আর মাত্র ৮০০ হেক্টর জমিতে চাষ করা হচ্ছে অমৃত সাগর।

দেশে আঞ্চলিক ফসলের ক্ষেত্রে (যেমন- ইক্ষু, ডাল, গম, ধান, আম ইত্যাদি) গবেষণা কেন্দ্র থাকলেও কলার জন্য নেই কোনো উচ্চ গবেষণা প্রতিষ্ঠান। তাই নরসিংদীর ব্রান্ডিং ফসল অমৃত সাগর কলা রক্ষায় কলা গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করা সময়ের দাবি।আদর্শ পদ্ধতিতে কলা চাষ, সঠিক ব্যবস্থাপনা ও মাটির গুণাগুণ ঠিক থাকলে অমৃত সাগর কলা তার হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাবে বলে আশাবাদী।

আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড