শাকিল মুরাদ
শেষ কবে খালি পায়ে শিশির ভেজা ঘাসে হেঁটেছেন? শেষ কবে নিজ হাতে গাছ থেকে ফল পেড়ে খেয়েছেন? মনে আছে কি কারো? আপনার নাগরিক জীবনে সেই সুযোগই বা কই? বছরে দুটো ঈদে নাড়ির টানে বাড়ি ফিরে মানুষ। ঈদ ছাড়াও বছরের বিভিন্ন মৌসুমে রয়েছে নানা ছুটি এবং উৎসব। আপনার সেই উৎসব-উদযাপনে ভিন্নতার ছোঁয়া এনে দিতে পারে কৃষি পর্যটন। কৃষি প্রধান দেশে শেরপুরেও রয়েছে এ কৃষি পর্যটনের দারুণ সম্ভবনা।
শহরের পরিবেশে বেড়ে ওঠা স্কুলের ছেলে-মেয়েরা ভাত খায় ঠিকই কিন্তু কীভাবে ধান হয় তা হয়তো তারা কখনো দেখেনি। কীভাবে কৃষক মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ঝড়-বৃষ্টি রোদ উপেক্ষা করে ফসল ফলাচ্ছেন তা শুধু টিভিতে দেখলেও বাস্তবে উপলব্ধি করেনি কখনো। তাই ঈদের ছুটি বা অন্য কোনো ছুটি হতে পারে তাদের দেশের বৈচিত্রময় কৃষি ও কৃষ্টির সঙ্গে পরিচিত করার একটি সুবর্ণ সুযোগ। শীত মৌসুমে গ্রামীণ মেঠো পথের ধারের হলদে সরিষা ক্ষেত কার না মন কাড়ে।
কৃষি প্রধান বাংলাদেশে যেদিকে চোখ যায় শুধু সবুজ আর মনকাড়া চিত্র-বৈচিত্রে ভরা। যে মৌসুমই আসুক না কেন সবুজ আর সজীবতার যেন শেষ নেই। আর এর মধ্যেও আছে নানা বৈচিত্রের সমাহার। কেউ কি আমরা খুঁজে দেখেছি সেসব বৈচিত্রময় বিচিত্রতাকে। কতজন কবির ভাষায় চোখ মেলে দেখেছি ‘ধানের ক্ষেতে ঢেউ খেলে যায় বাতাস কাহার দেশে, কোথায় এমন হরিৎ ক্ষেত্র আকাশ তলে মেশে’। কিংবা সকালের দিকে ধানের ফুল ফোটার শব্দ কেউ কি কান পেতে শুনেছি?
কেউ কি দেখেছি সকালের সূর্যোদয়ের সময় ধান ক্ষেতের পশ্চিমে দাঁড়িয়ে পূবের দিকে মাকড়শার জালের অপূর্ব কারুকার্য! কিংবা শীতকালীন সবজি ক্ষেতে সকালের শিশির বিন্দু। হয়তো দেখেছি আসা-যাওয়ার পথে। কিন্তু দেখিনি দেখার মতো করে। মনের মাধুরী মিশিয়ে কল্পনা করিনি কোনো কিছুর সঙ্গে।
দিনাজপুরের লিচু ভালো, রাজশাহীর আম, সিলেটের চা ভালো, পার্বত্য চট্টগ্রামের জাম। নরসিংদীর কলা ভালো, বগুড়ার দই। আর শেরপুরের ব্র্যান্ডিং হয়েছে ‘তুলশি মালার সুগন্ধে, পর্যটনের আনন্দে’। একেক অঞ্চল একেকটি ঐতিহ্যবাহী ফসল নিয়ে কৃষি পর্যটন হতে পারে। শহরের তরুণরাও এসব স্পটে দল বেঁধে ভ্রমণ করতে পারেন। এতে তারা কৃষির সঙ্গে পরিচিত হতে পারবে পাশাপাশি, প্রকৃতির সঙ্গে সময় কাটিয়ে নির্মল আনন্দ পাবে।
শেরপুরের সম্ভাবনাময় কৃষি পর্যটন স্পট :
শেরপুর জেলায় এক সময় প্রায় ৭টি নদী, ২০টি খাল ও অর্ধশত বিল ছিল, বর্তমানে সেসব বিলের খুব একটা অস্তিত্ব না থাকলেও যে টুকু আছে বর্ষায় কিছুটা চোখে পড়ে। এসব জলাশয়ে নৌকা করে ঘুরে বেড়ানো, পাখি দেখা, মাছ ধরার, জেলেদের সঙ্গে মাছ ধরার সুযোগ, নৌকা বাইচ দেখা এবং নৌকা চালানো বেশ আকর্ষণীয়। ধানের জেলা হিসেবে ইতোমধ্যে দেশের অন্যতম জেলা হিসেবে সুপরিচিত হয়ে উঠেছে শেরপুর জেলা।
বছরে তিনটি ধানের আবাদের মৌসুমে দিগন্ত জুড়ে সোনালী ফসলের সমারোহে যে কোনো মানুষের মনে দোলা দিয়ে যায়। ধান যখন পেকে সোনালী বর্ণ ধারণ করে তখন জেলার বিভিন্ন সড়কের পাশ দিয়ে চলাচলরত যেকোনো পেশার পথিকের মন ছুয়ে যায় পাকা ধানের ম-ম গন্ধে। জেলার চরাঞ্চলের পাশপাশি গারো পাহাড় এলাকায় পাহাড় ঘেষা ধান ক্ষেতে বাতাসের দোলা দেখলে ক্ষনিকের জন্য হলেও যেকোনো প্রকৃতি প্রেমী মানুষ থমকে দাঁড়াবে। শীত মৌসুমে জেলার সদর উপজেলার চরাঞ্চলের কিছু এলাকা এবং নকলা উপজেলার চন্দ্রকোণা এবং উরফা ইউনিয়নে সরিষার ব্যপক ফলন হয়। নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে সরিষার ফুল এলে দিগন্ত জুড়ে ম-ম গন্ধ ছড়িয়ে যায়।
এ সময় দু’চোখ যে দিকে যায় শুধু হলুদ আর হলুদের সমারোহ। এ যেনো হলুদ গালিচায় প্রকৃতি সাঁজে নতুন সাঁজে। সরিষা মৌসুমে সরিষা ক্ষেতের পাশেই মৌমাছি পালনকারীদের মধু সংগ্রহ দেখা ও টাটকা মধু খাওয়া, স্বল্পমূল্যে পর্যটকদের কাছে বিক্রির ব্যবস্থা করা পর্যটকদের আকৃষ্ট করবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। শীতের সবজিতে শেরপুর জেলার জুড়ি নেই। বিশেষ করে শীতের সবজি চাষাবাদের সময় জেলার বিভিন্ন চরাঞ্চলে শত শত একর জমিতে টমোটো, ফুল কপি, বাঁধা কপি, সিম, বেগুন, মটর শুটি, মাশকালাইসহ নানা শীতকালীন সবজির আবাদ হয়। এসব সবজি ক্ষেতের থোকা থোকা বিভিন্ন টাটকা সবজি দেখে মন জুড়িয়ে যায়।
শীতকালীন সবজি ছাড়াও গ্রীষ্মকালীন সবজির পাশপাশি জেলার বিভিন্ন এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে গড়ে উঠেছে অ্যাগ্রো-ফিসারিজ ফার্ম, মালটা, কমলা, বিভিন্ন প্রজাতির লেবু বাগান, নকলা উপজেলার টালকি ইউনিয়নের রামেরকান্দি গ্রামে সমতলের চা বাগান, সীমান্তবর্তী গারো পাহাড় এলাকায় বর্ষাকালীন সবজি চাষের পাশাপাশি সম্প্রতি শুরু হয়েছে চা চাষ। এছাড়া, জেলার বিভিন্ন স্থানে ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে উঠেছে রয়েছে আম, জাম, লিচু, কলা, পেঁপেসহ বিভিন্ন মিশ্র ফল বাগান, ফলজ, ওষুধি, বনজ গাছের মনোরম নার্সারি, বিভিন্ন গাছ-গাছালির অর্কিড বাগান উল্লেখযোগ্য।
শহরের প্রাণ কেন্দ্রের নয়আনী বাজার ডিসি অফিসের চারপাশে লেক বেষ্টিত ছায়াসুনিবির পরিবেশে ডিসি চত্বর। কৃষি পর্যটন এলাকায় রকমারি সুন্দর সুন্দর ফুল ফোটা সবজি ক্ষেত পরিদর্শন করা, আন্তঃপরিচর্যা, সংগ্রহ ও সবজির চাষ কৌশল দেখা, থোকা থোকা বিভিন্ন ফলের ঝুলে থাকা দৃশ্য কার না ভালো লাগবে। সরকার কৃষি উৎপাদন বাড়াতে জেলার নালিতাবাড়িতে দুটো, নকলায় একটি এবং ঝিনাইগাতিতে একটিসহ মোট ৪টি বিভিন্ন নদীর ওপর রাবার ড্যাম বা বাঁধ তৈরি করা হয়েছে। এ রাবার ড্যামের পাশে বসে ঝর্নার জলের মতো ড্যামের ওপর দিয়ে গড়িয়ে পড়া পানি দেখে অনেকেই নেমে পড়ে সে পানিতে।
রাবার ড্যামের পাশেই বিভিন্ন গাছের ছায়াতলে কোথায় কোথাও স্থাপন করা হয়েছে বেঞ্চ। এসব বেঞ্চে বসে বিকেলের সোনালী রোদ্দুরের সাথে রাবার ড্যামের ওপর দিয়ে গড়িয়ে পড়া পানির কলতান শুনলে ক্ষনিকের জন্য হলেও জীবনের অনেক কষ্ট ভুলে থাকা যাবে। এসব স্থানে ইতোমধ্যে স্থানীয় এবং জেলার বাইরের বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ ভ্রমণে আসছে। দল বেঁধে বেড়াতে যাচ্ছে বন্ধু-বান্ধব ও পরিবারের সদস্যদের নিয়ে। কৃত্রিমভাবে তৈরি পাহাড়ের এবং সমতলে প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন পিকনিক বা পর্যটন স্পট দেখতে দেখতে মানুষ অনেকটা হাফিয়ে উঠছে। প্রকৃতির নির্মল বাতাস আর মৌসুম ভিত্তিক জেলার বিভিন্ন কৃষি পর্যটন এলাকায় বিভিন্ন ফসলের ম-ম গন্ধ যেন জীবনকে আরও প্রাণবন্ত করে তুলে।
তাই আগামী প্রজন্মের কাছে কৃষি পর্যটনের প্রতি দিন দিন আকর্ষণ বাড়ছে। জেলায় রয়েছে কৃষি নির্ভর ও কৃষি ভিত্তিক অটোমেটিক রাইস মিল, হিমাগার, মুড়ি ও চিড়া তৈরি কারখানাসহ বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য তৈরি ফ্যাক্টরি। এসব ফ্যাক্টরিতে চলমান কার্যক্রম পরিদর্শন করা, চরাঞ্চলের কৃষি ও চরের সংগ্রামী মানুষের কৃষি কর্মকাণ্ড পরিদর্শন করা এবং তাদের সঙ্গে কাজে অংশগ্রহণ করা আনন্দের নতুন মাত্রা যোগ করবে।
অ্যাগ্রো ফিসারিজে কৃষি খামার পরিদর্শন, পাহাড়িদের কৃষির সঙ্গে পরিচিত হওয়া ও তাদের কাজের সঙ্গে অংশগ্রহণ করা, কোনো সফল কৃষকের কর্মকাণ্ড পরিদর্শন, তার সফলতার কাহিনীর বর্ণনা শোনা ইত্যাদি কৃষি পর্যটনের আকর্ষণ হতে পারে। সব বয়সী মানুষের মধ্যেই গ্রাম ও প্রকৃতির প্রতি আলাদা আকর্ষণ আছে। এছাড়া, তথ্য প্রযুক্তির কল্যাণে কৃষির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবলোকনের স্পৃহা বাড়ছে দিন দিন। মানুষ শিকড়মুখী হতে চায়, পুকুরে সাঁতার কাটতে চায়, নিজ হাতে মাছ ধরতে চায়, গাছ থেকে ফল-ফলাদি পেড়ে খেতে চায়।
যতই দিন যাবে মানুষ অর্গানিক আর বিষমুক্ত কৃষিপণ্যের চাহিদা বাড়বে। এই কারণে অদূর ভবিষ্যতে মানুষ ওয়েবসাইট বা অ্যাপস ঘেঁটে তার আশপাশের কৃষি ও কৃষ্টির দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ করতে চাইবে। আর তরুণ উদ্যোক্তারা এই সুযোগটি লুফে নেবেন ব্যবসার জন্য। একটি সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক পরিবেশকে ঘিরে ব্যবসায়িক কার্যক্রম ও বিনোদন আবর্তিত হবে। এতে ক্রেতা ও কৃষক উভয়ই উপকৃত হবেন। যেমন-ভোক্তার কাছে সরাসরি পণ্য বিক্রি করতে পারলে কৃষক ন্যায্যমূল্য পাবেন।
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড