• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৬ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

আজ ভয়াল ১২ নভেম্বর

'ভোলার গাছে গাছে লাশ ঝুলছে'

  গোপাল চন্দ্র দে, বিশেষ প্রতিনিধি

১২ নভেম্বর ২০১৮, ১৫:২৭
ভোলা
ছবি : সংগৃহীত

আজ ১২ নভেম্বর। ১৯৭০ এর ১২ নভেম্বর সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার, দিবাগত রাতে ভোলাসহ উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানে সর্বকালের সর্ব বৃহৎ রেকর্ডকৃত ঘূর্ণিঝড়। যার নামকরণ করা হয় ভোলা ঘূর্ণিঝড় হিসেবে।

১৯৭০ এর এই দিনটি ভুলতে পারবে না ভোলাবাসীসহ উপকূলবাসী। ঝড়ে মারা যায় প্রায় ১০ লক্ষাধিক মানুষ। তবে সরকারি হিসাবে তা যদিও ৫ লক্ষ।

ঘূর্ণিঝড়ের আগের দিন ১৯৭০ সালের ১১ নভেম্বর বুধবার সকাল থেকেই গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হতে থাকে। পরদিন ১২ নভেম্বর বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই আবহাওয়া আরও খারাপ হয়, ফুঁসে ওঠে সমুদ্র। ৭ নভেম্বর বঙ্গপোসাগরে সৃষ্ট এই ঘূর্ণিঝড়টি বৃহস্পতিবার দিনগত রাতেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) দক্ষিণাঞ্চলের বাকেরগঞ্জ জেলার দক্ষিণ শাহাবাজপুর মহকুমায় আঘাত হানে।

প্রবল বেগে লোকালয়ের দিকে ধেয়ে আসে পাহাড় সমান উঁচু ঢেউ। প্রায় ৩০/৪০ ফুট উঁচু ঢেউ আছড়ে পড়ে উপকূলে। আর মুহূর্তেই কাঠ খড়ের মতো ভাসিয়ে নেয় মানুষ,গবাদিপশু, বাড়ি-ঘর ও কৃষকের ক্ষেতের ফসল।

ঝড়,জলোচ্ছ্বাস শেষে আকাশের নিচে পড়েছিল লাশ আর লাশ। নদীতে পানি নয় দেখা যেত লাশ, যেন লাশের নদী পানির নদী নয়। ধান ক্ষেতগুলোতে হাজার হাজার লাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে দেখেছে অনেকে। ১২ নভেম্বর সন্ধ্যায় আঘাত হানে এ ঘূর্ণিঝড়টি শক্তিহীন হয়ে নিষ্ক্রিয় হয় ১৩ নভেম্বর ভোরে।

জানা যায়, ভোলার বর্তমান তজুমদ্দিন উপজেলায় তখন ১ লক্ষ ৬৭ হাজার জন অধিবাসীর মধ্যে জীবিত ছিলেন ৭৭হাজার৪৬ শতাংশ মানুষই প্রাণ হারায় এ ধড়ে, জলোচ্ছ্বাসে, মনপুরায় ২৪ হাজার মানুষের মধ্যে জীবিত ছিল ১২ হাজার। এছাড়াও প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি হয় চরফ্যাশন, দৌলতখানসহ অন্যান্য স্থানে। তবে বর্তমান ভোলা সদরে তেমন ঘটেনি প্রানহানির ঘটনা, এখানে তেমন একটা জলোচ্ছ্বাস না হওয়াই প্রানহানি হয়নি বলে জানায় প্রত্যক্ষদর্শীরা।

এ পর্যন্ত রেকর্ডকৃত ঘূর্ণিঝড় সমূহের মধ্যে এটি সবচেয়ে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় এবং এটি সর্বকালের সবচেয়ে ভয়ঙ্করতম প্রাকৃতিক দুর্যোগের একটি। সিম্পসন স্কেলে যার ক্যাটাগরি ৩ মাত্রার। এই ঝড়ে, ১৮৫ কিলোমিটার বেগে ৩ মিনিট ও ২০৫ কিলোমিটার বেগে ১ মিনিট বাতাসের গিতিবেগ রেকর্ড করা হয়েছিল। প্রায় ১০ লক্ষাধিক মানুষ প্রাণ হারায় এই ঝড়ের প্রভাবে। যার অধিকাংশই জলোচ্ছ্বাসে ডুবে মারা যান। এটি ছিল ১৯৭০ এর উত্তর ভারতীয় ঘূর্ণিঝড় মৌসুমের ৬ষ্ঠ ঘূর্ণিঝড় এবং মৌসুমের সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ছিল এটি।

পূর্ব পাকিস্তানে তখন ৩টি বাংলা পত্রিকা চলত ইত্তেফাক, আজাদ আর পূর্বদেশ। “ভোলার গাছে গাছে লাশ ঝুলছে” শিরোনামে তখনকার পূর্বদেশ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল পত্রিকাটির তৎকালীন মহকুমা প্রতিনিধি হাবিবুর রহমানের লেখা রিপোর্টটি।

ভোলার এই প্রবীণ সাংবাদিক “দৈনিক অধিকার” এর বিশেষ প্রতিনিধি গোপাল চন্দ্র দে এর সাথে স্মৃতিচারণ করে বলেন, তখন জরুরিভাবে সংবাদ প্রেরণের জন্য ভরসা ছিল টেলিফোন। কিন্তু ঝড়ে ভোলার টেলিফোন অফিসটি ভেঙে পড়ল ঝড়ে। এখন কী করে সংবাদ প্রেরণ করি চিন্তায় পড়লাম। এ দিকে চারিদিকে “লাশ আর লাশ”। প্রলয়ের চিহ্ন, সর্বত্র হাহাকার। বেওয়ারিশ লাশ পড়ে আছে স্তুপ হয়ে, কোথাও লাশের সঙ্গে জীবিত মানুষ কোথাও ক্ষুধার্ত মানুষের কান্না। খাবার নেই, প্রত্যন্ত এলাকার মানুষ ত্রাণহীন। ঘূর্ণিঝড়ের ধ্বংসস্তুপে অনেক খবর, বীভৎস সব ছবি।

দৈনিক অধিকার

প্রত্যক্ষদর্শী কামাল চৌধুরী “দৈনিক অধিকার” এর বিশেষ প্রতিনিধি গোপাল চন্দ্র দে স্মৃতিচারণ করছেন

ঝুলন্ত লাশের ছবি আর অনেক তথ্য সংগ্রহ করেন তিনি। এবার ঢাকায় প্রেরণের পালা। শ্যালককে দিয়ে মাছধরা ট্রলারে করে ছবি পাঠিয়ে দেন ঢাকায়। কিন্তু সংবাদ প্রেরণ নিয়ে পড়েন সমস্যায়। একমাত্র ভরসা পুলিশ ওয়্যারলেস তখন। কিন্তু সেখান থেকে সংবাদ পাঠাতে হলে স্থানীয় প্রশাসনের অনুমতি লাগবে।

হাবিবুর রহমান হাতে লেখা সংবাদের কপি নিয়ে ছুটে যান তৎকালীন মহকুমা প্রশাসকের কাছে। গিয়ে দেখেন সেখানে বসে আছেন বাকেরগঞ্জ জেলা প্রশাসক তৌফিক আলী। তিনি কপিটি হাতে নিয়ে বললেন, কে বলেছে গাছে গাছে লাশ ঝুলছে? জবাবে ছবি আছে বলেন হাবিবুর রহমান। তবুও সংবাদ প্রেরণের অনুমতি দিলেন না জেলা প্রশাসক।

হাবিবুর রহমান ফিরে আসেন। পরে জেলা প্রশাসক ডেকে নিয়ে সংবাদটি প্রেরণের অনুমতি দেন। পুলিশ ওয়্যারলেসের মাধ্যমে সংবাদটি মহাখালী পুলিশ ওয়্যারলেসে পাঠানো হয়, সেখান থেকে মতিঝিলে পূর্বদেশ পত্রিকা অফিসে।

সংবাদ যেদিন পৌঁছায় সেদিনই হাতে হাতে যাওয়া ছবি ও পৌঁছায়। ঘূর্ণিঝড়ের পর চতুর্থদিনে পূর্বদেশ পত্রিকায় প্রধান শিরোনাম হয়- ‘ভোলার গাছে গাছে লাশ ঝুলছে’।

৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়টি প্রদক্ষদর্শী, ত্রাণ কর্মী ও তৎকালীন সময়ের বারেকগঞ্জ জেলা পরিষদের সদস্য কামাল চৌধুরী তার নিজের ভাষায় ১৯৭০ সালের প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড় এবং তার পরবর্তী সময়ের ত্রাণ কর্মকাণ্ড পরিচালনা সম্পর্কে “দৈনিক অধিকার” এর বিশেষ প্রতিনিধি গোপাল চন্দ্র দে এর সঙ্গে ১২ নভেম্বর সম্পর্কিত সাক্ষাৎকারে জানান, ১২ নভেম্বর রমজান মাস ছিল। সারাদিন গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি চলছিল। মনপুরা থেকে আমি বরিশালের উদ্দেশে রওনা দেই পথে তজুমদ্দিন বাজারে আসলে তজুমদ্দিন থানার পুলিশ সদস্য ও ওসির মধ্যে বিবাদমান সমস্যা সমাধানের জন্য থানায় যায়।

সমস্যা সামাধান করতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। আবহাওয়া খারাপ থাকার কারণে কোথাও না গিয়ে আমি তজুমদ্দিন ডাক বাংলোতে রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নেই। ২ থেকে ৩ ঘণ্টার পরে ডাক বাংলোয় আরও কয়েক জন লোক এসে আশ্রয় নেয়। তারা জানায় যে নদীর আবস্থা খুবই খারাপ। নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে।

এর কিছুক্ষণ পর আমাদের ডাক বাংলোতেও পানি আসা শুরু হয়। আমরা আতঙ্কিত হয়ে সবাই মিলে ছাদে আশ্রয় নেই। দেখি পানি আরও বাড়ছে। আমারে চোখের সামনে দিয়ে লোকজনসহ, মালামাল ভেসে যাচ্ছে। শেষ রাতের দিকে ঝড় আস্তে আস্তে কমে যায়।

এ সময় আমরা শুধুমাত্র তজুমদ্দিন বাজারেই শতাধিক লোকের মৃতদেহ দেখতে পাই। গতকাল দিনে যেই ওসি সাহেবের শালিশ করছিলাম তার ও স্থানীয় ডাক্তারের বউ ও সন্তানকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। পরে আমি সকাল প্রায় ১০ টার দিকে গাছের ডালে আটকে থাকা একটা নৌকা দেখতে পেয়ে সেটিকে নামাই এবং কয়েক জন একসাথে মনপুরার উদ্দেশে রওনা দেই।

মনপুরায় ২৪ হাজার লোকের ভেতর ১২ হাজার লোক মারা যায়। মনপুরায় ১৩ টি পরিবার সম্পূর্ন নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ৪৭ টি পরিবারের ১ জন করে সদস্য জীবিত ছিলেন। মনপুরায় আমার ঘরসহ ৪টি ঘর ছাড়া সকল ঘর বিধ্বস্ত হয়। মনপুরার পুকুর ও আসে পাশের নদীতে হাজার হাজার মানুষের লাশ ভাসতে থাকে।

ঘটনার ২দিন পরে ভিয়েতনাম থেকে একটি সি-প্লেন যোগে রয়টার্স, বিবিসি, সিএনএন, ইউপি, লন্ডন টেলিভিশনের ৫ জন সাংবাদিক আসে। স্থানীয় লোকজন তাদের ভাষা বুঝতে না পেড়ে আমায় খবর দেয়। আমি ইংরেজিতে তাদের সাথে কথা বলে ঘটনা জানাই। তারা প্রায় ৯০ মিনিট আশেপাশে ঘুরে দেখে। চারদিকে লাশের ছড়াছড়ি, গৃহহীন অর্ধ উলঙ্গ মানুষের অবস্থা দেখে একজন সাংবাদিক কেঁদে ফেলেন।

সাংবাদিকদের মধ্যে একজন আমাদেরকে আর্থিক সাহায্য করার জন্য তৎকালীন সময়ের ৬৫০ টাকা আমার হাতে দেয়। আমি টাকা ফেরত দিয়ে বলি, দিস পেপার মানি ইজ নাথিং ফর আওয়ার, ইফ ইউ ক্যান সেন্ড সাম ফুড, মেডিসিন অ্যান্ড ইউন্টার ক্লোথ। যেই সাংবাদিক টাকা দিচ্ছিল সে কেঁদে দিল এই কথা শুনে।

পরদিন আমার কথা কোড করেই শিরোনাম হলো এবং সংবাদ প্রচারিত হলো ঐ সকল আন্তর্জাতিক মিডিয়ায়। তৃতীয় দিনই আমাদের মনপুরায় উড়তে থাকে হেলিকাপ্টার প্রথম দিনে ত্রাণ হিসেবে আসে কম্বল। আসতে শুরু করে ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে আরও বিভিন্ন দল।

নটরডেম কলেজের তখনকার অধ্যক্ষ তার নেতৃত্বে ফাদার তার টিম নিয়ে আসে এখানে। যারা এখানকার মানুষকে সাহায্য করে। আমিও ভোলা মহকুমা প্রশাসক অফিসের এক পিয়নের সাহায্যে একটি চিঠি পাঠাই বাকেরগঞ্জ জেলা পরিষদে। সেখান থেকেও চিঠি যায় উপরের স্তরে সেখান থেকেও আসে ত্রাণ।

প্রায় ঘটনার ২-৩ দিন পরই সর্বপ্রথম ভোলায় ছুটে আসে মাওলানা ভাসানী, ৪-৫ দিন পর ছুটে আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান, ১২-১৩ দিন পর চীন সফর সংক্ষিপ্ত করে পশ্চিম পাকিস্তানে না গিয়ে সরাসরি পূর্ব পাকিস্তানে এসে ভোলায় আসেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান।

ঘূর্ণিঝড়ে বিপর্যস্ত মানুষগুলোর প্রতি পাকিস্তান সরকার ত্রাণ কার্যক্রমে গড়িমসি করায়। এমন নিষ্ঠুরতা দেখে পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। ২৪শে নভেম্বর এক সভায় মাওলানা ভাসানী পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে অদক্ষতার অভিযোগ তোলেন এবং পদত্যাগ দাবি করেন।

৭০ এর নির্বাচনে তৎকালীন বিরোধীদল আওয়ামী লীগ নির্বাচনে বিপুল ভোটে প্রাদেশিকভাবে জয়লাভ করে। ঘটনাপ্রবাহে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একটি প্রাকৃতিক ঝড়ের ঘটনা একটি দেশে স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম একটি কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড