• সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৯ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

রেজিস্ট্রি খরচ বাড়ায় কমেছে জমি বিক্রি, রূপগঞ্জে  ৬ মাসে সরকারের হাতছাড়া শতকোটি 

  নজরুল ইসলাম শুভ, স্টাফ রিপোর্টার, নারায়ণগঞ্জ:

১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৩:৫৯
 রাজস্ব

সরকারি রাজস্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে জমি রেজিষ্ট্রি খরচে বাড়ানো হয়েছে উৎসকর। আর রেজিষ্ট্রি খরচ বৃদ্ধির পর থেকেই কমেছে জমি রেজিষ্ট্রি। বৃদ্ধির পরিবর্তে কমেছে রাজস্ব আদায়। বিশেষ প্রয়োজনেও জমি বিক্রয় করতে না পারায় ভোগান্তি বেড়েছে সাধারণ জমি মালিকদের। বিপাকে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও।

ক্যালেন্ডোরের পাতায় ৮ ফেব্রুয়ারি বারে বৃহস্পতিবার। ঘড়ির কাটায় তখন ১২ টা। দলিলের টিপ কালি, খাতা, কলম, স্টেপলার, বার সুই-সুতা আর রেজিস্ট্রার নোট নিয়ে টেবিলের সামনে বসে আছে সাব রেজিস্ট্রি অফিসের সহকারী, স্থায়ী মোহরার, নকল নবীশ, পিয়ন ও অফিস সহকারীরা। নেই খুব একটা কাজের চাপ। ফাঁকা টেবিল আর অবসরতায় ঘিরে এভাবেই দিন কাটছে তাদের। রূপগঞ্জ পুর্ব ও রূপগঞ্জ সাব-রেজিস্ট্র অফিস ঘুরে এমন চিত্রের দেখাযায়। সারাদিনে মাত্র সাব কাবলা ১০টি, হেবানামা ১১টি, দানপত্র ৫টি, বিলএওয়াজ হেবা ৬টি, হস্তান্তর ১টি, ২৩ টি ব্যাপক ক্ষমতা সম্পুন্ন আম-মোক্তারনামা ও অন্যান্য রকমারি সহ মোট ৭৭টি দলিল রেজিস্ট্রি সম্পন্ন হয়েছে।

শুধু বৃহস্পতিবার নয় জমি রেজিষ্ট্রির খরচ বৃদ্ধি পাওয়ার পর থেকে প্রায় ছয় মাস ধরে এভাবেই চলছে সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের কার্যক্রম। অথচ যেখানে প্রতিদিনই হাজারো মানুষের পদচারণায় মুখরিত ছিল সাব-রেজিষ্ট্রি অফিস ও আশপাশের এলাকা। তবে খরচ বৃদ্ধি পাওয়ার পর থেকে সাব-কাওলা দলিলের চেয়ে আম-মোক্তারনামা, হেবানামা, দানপত্রসহ অন্যান্য রকমারি দলিল রেজিষ্ট্রি বেশি হচ্ছে।

সরেজমিনে ঘুরে জানাযায়, ঢাকার অত্যন্ত নিকটবর্তী এলাকা ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হওয়ায় ব্যবসায়ী, চাকুরীজীবি, প্রবাসী, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গসহ প্রায় সকল পেশার মানুষই রূপগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় জমি ক্রয় করে থাকেন। তাতে প্রতিদিনই চাপ থাকতো সাব-রেজিষ্ট্রি অফিসে। কাজের চাপের কারণে রেজিস্ট্রি অফিসকে রূপগঞ্জ পুর্ব ও রূপগঞ্জ সাব-রেজিষ্ট্র অফিস নামে দুটি ভাগে বিভক্ত করা হয়। আর দুটি অফিসে প্রায় ৪’শ দলিল লেখক ও তাদের প্রত্যেকের ৪/৫জন করে সহকারীসহ মোট প্রায় ১২’শ থেকে ১৩’শ লোক কাজ কাজ করতো। অথচ উৎসকর বৃদ্ধির পর থেকে প্রায় সময়ই সাব-রেজিস্ট্রি অফিস ও আশপাশের এলাকা ফাঁকা থাকতে দেখা যায়।

গত বছর ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সরকারী প্রজ্ঞাপন অনুসারে জমির শ্রেনী অনুযায়ী নারায়ণগঞ্জের নাল জমি রেজিষ্ট্রি করতে সর্বনিন্ম প্রতি কাঠা ১ লক্ষ টাকা উৎস কর ধরে দলিল রেজিস্ট্রি খরচ নির্ধারণ করা হয়েছে। তারপর থেকেই কমেছে দলিল রেজিষ্ট্রি এবং সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের চাপ। সেই সাথে ভুমির খাজনা আদায়ের নামে নামজারীর পত্রে নাল শ্রেনীর জমিকে আবাসিক লেখা হচ্ছে। তাতে জমির খাজনা ও রেজিস্ট্রি করতে উভয় ক্ষেত্রেই অতিরিক্ত টাকা গুনতে হচ্ছে ক্রেতা-বিক্রেতাদের।

অফিস সূত্রে জানাযায়, উৎসকর বৃদ্ধির পুর্বে প্রতিটি অফিসে প্রায় ১৫০ থেকে ১৭০টি দলিল হতো। আর দুটি অফিসে মিলে দৈনিক প্রায় সাড়ে তিন’শ দলিল রেজিষ্ট্রি হতো। যার মধ্যে সাবকাওলা দলিল প্রায় ৬৫ শতাংশ, হেবা-বিলএওয়াজহেবা ১০শতাংশ, ঘোষনাপত্র ৫শতাংশ, আম-মোক্তারনামা ১০/১২ শতাংশ আর অন্যান্য রকমারি দলিল ৮/১০ শতাংশ। প্রতিটি সাবকাওলা দলিল থেকে সরকার রাজস্ব পেত জমির মূল্যের শতকরা সাড়ে ১২%। রূপগঞ্জের ইতিহাসে ১'শ কোটি টাকা পর্যন্ত দলিল মূল্য দিয়ে সাবকাবলা রেজিস্ট্রি হয়েছে। অন্যান্য দলিলে রাজস্ব পায় মাত্র ১৪’শ থেকে ২ হাজার টাকা। সে হিসেব মতে গেল ছয়মাসে শুধু মাত্র রূপগঞ্জ উপজেলা থেকে সরকার রাজস্ব বঞ্চিত হয়েছে প্রায় শতাধিক কোটি টাকা।

এছাড়াও এই রেজিস্ট্রি খরচের মধ্যে শতকরা ২% উপজেলা পরিষদে, প্রতিটি ইউনিয়নে ১% করে এবং পৌরসভায় ২% কর পেত। সেই টাকা থেকেই পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতন এবং উন্নয়ন মুলক কাজ করা হয়। রেজিষ্ট্রি খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় একদিকে জমি রেজিষ্ট্রি কমেছে। অন্যদিকে এলাকার উন্নয়ন কর্মকান্ড ব্যহত হচ্চে এবং পরিষদ-পৌরসভার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বকেয়া জমেছে।

রূপগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, উপজেলায় প্রায় ৩০টির বেশি আবাসন কোম্পানি রয়েছে। প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে চার শতাধিক সাব-কাবলা দলিল সম্পাদন করে। কিন্ত বর্তমানে তারা একমাত্র আম-মোক্তারনামা দলিল রেজিষ্ট্রি করছে। এছাড়াও কোম্পানির বালুর নিচে পড়ে থাকা কৃষকের জমি চাষাবাদ করতে পারছে না। একদিকে চাষাবাদ বন্ধ। অন্যদিকে বিশেষ প্রয়োজনেও শুধু রেজিষ্ট্রি খরচ বৃদ্ধির কারণে জমি বিক্রি করতে পারছে না জমি মালিকরা।

দাউদপুর ইউনিয়নের লোকমান হোসেন জানান, বাড়ির পাশে মাধবপুর মৌজার জমি বিক্রি করে আমার ছেলে সানিকে ইউরোপের পোল্যান্ড পাঠাতে চেয়েছিলাম। কিন্ত জমি রেজিষ্ট্রি খরচ বৃদ্ধির কারণে কেউ জমি কিনতে রাজি হয়নি এমনকি কারো কাছে বায়না চেয়েও পাইনি। শুধুমাত্র টাকার জন্য ছেলেকে পাঠাতে পারিনি।

বাগপাড়া এলাকার কাওসার আলম বলেন, আমার মামা অসুস্থ ছিল। জমি বিক্রি করে মামার চিকিৎসা করাতে চেয়েছিলাম। বাড়ির পাশের বাঘপাড়া মৌজার জমি প্রতি শতাংশ ১ লক্ষ ৫৫ হাজার টাকা দরে বিক্রি করার কথা হয়েছিল। হঠাৎ করে রেজিষ্ট্রি খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় বায়না নিয়েও টাকা ফেরৎ দিতে হয়েছে। পরে আর কেউ জমি কিনতে আগ্রহ দেখায়নি। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থাতেই আমার মামাও মারা যায়।

ভোলাব ইউনিয়নের গিয়াসউদ্দিন বলেন, উৎস কর বৃদ্ধির আগে জমি বিক্রি করে আমি মাধবদী শেখেরচর এলাকায় একটি দোকান কিনেছি। আর কিছু জমি বিক্রি করে কাপড়ের ব্যবসা শুরু করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এখন জমি বিক্রিও করতে পারছি না আর ব্যবসাও শুরু করতে পারছি না।

কাঞ্চন পৌরসভার ব্যবসায়ি ওমর ফারুক জানান, জমির বায়না নিয়ে বাড়ির নির্মাণ কাজ শুরু করেছিলাম। রেজিস্ট্রি খরচ বৃদ্ধির কারণে এখন জমি রেজিস্ট্রি হচ্ছে। টাকার অভাবে নির্মান কাজ বন্ধ। অন্যদিকে প্রতিদিনই নির্মাণ সামগ্রীর দাম বেড়ে চলেছে।

কায়েতপাড়া এলাকার আবু বকর জানান, জমির মূল্যের চেয়ে যদি রেজিস্ট্রি খচর বেশি হয় তাহলে কেনা-বেচা হবে কিভাবে ? আমাদের উপজেলায় কিছু মৌজায় জমির মূল্য প্রতি বিঘা ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকা। আর প্রতি বিঘা জমি রেজিস্ট্রি করতে উৎস কর ২০ লাখ টাকা। এছাড়াও দলিলের অন্যান্য খরচতো আছেই।

বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও পৌরসভার মেয়ররা জানান, আমাদের মূল উপার্জন হল জমি থেকে রাজস্ব আদায়। এই রাজস্ব থেকেই এলাকার উন্নয়ন কার্যক্রম কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন প্রদান করা হয়। কিন্তু দলিল রেজিষ্ট্রি খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় জমি রেজিস্ট্রি কম হচ্ছে আর রাজস্ব পাওয়া যাচ্ছে না। তাই গেল ছয়মাস ধরে ইউনিয়ন ও পৌরসভার উন্নয়ন কাজ ব্যহত হচ্ছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতাও কিছুটা বকেয়া জমেছে।

দলিল লেখক সমিতির সভাপতি মুশফিকুর রহমান রিপন বলেন, দুটি সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে দলিল লেখক, সহকারী ও অফিস সহকারীসহ প্রায় ১৩’শ লোক কাজ করছে। প্রতিটি মানুষের কাজ নির্ভর করে দলিল রেজিস্ট্রির উপর। গত ছয়মাস ধরে কাজের খারাপ অবস্থা। এমনটা চলতে থাকলে বাধ্য হয়ে অনেকেই পেশার পরিবর্তন করতে হবে। তিনি বলেন, উৎসকর আইন সংযোজন কিংবা পরিবর্তন করলে সরকারের রাজস্ব খ্যাত সচল ও সর্বসাধারণ উপকৃত হবে। প্রয়োজনে জমির মৌজার মূল্য বৃদ্ধি এবং রেজিস্ট্রির শতকরা হার বাড়ানো যেতে পারে।

রূপগঞ্জ সাব-রেজিস্ট্রার খন্দকার গোলাম কবির বলেন, উৎস কর বৃদ্ধির পর জমি রেজিস্ট্রি কিছুটা কমেছে। বর্তমানে রাজউকের পুর্বাচলের উপশহরের প্লট, জলসিড়ি আবাসনের প্লটগুলো সাব কাবলা দলিল হচ্ছে। তবে হেবা, বিলএওয়াজ হেবা ও আম-মোক্তারনামা দলিল রেজিস্ট্রি বেশি হচ্ছে।

আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড