• সোমবার, ০৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৫ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

'বাউৎ' উৎসবে এসে হতাশ সৌখিন মৎস শিকারীরা 

  রাকিব হাসনাত, পাবনা

২৮ নভেম্বর ২০২৩, ১৯:১২
বাউৎ

ভোরের আলো ফুটার আগেই পাবনার ভাঙ্গুড়ার রুহুল বিল দূর-দুরান্ত থেকে আগত মৎসশিকারীদের পদচারনায় কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। শিশু থেকে নানা বয়সী মানুষ পলো, ধর্মজাল, চাকজাল, ঠেলাজাল, খুইরা জাল, বাদাই জালসহ নানা ধরনের মাছ ধরার উপকরণ নিয়ে নেমে পড়েছে অর্ধপানিতে। মাছ ধরার এই উৎসব যেন একে অপরের হারিয়ে যাওয়া মিলনমেলায় রূপ নিয়েছে। কেউ ঠান্ডায় জুবুথুবু অবস্থা। আবার কেউ মাছ ধরতে পেরে আনন্দ উল্লাস করছেন। বাউৎ উৎসবের এ হাসি যেন এক নিমিষেই মলিন হয়ে গেছে। মাছ না পেয়ে হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরছেন তারা।

মঙ্গলবার (২৮ নভেম্বর) সকালে পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার পার-ভাঙ্গুড়া ইউনিয়নের ওই বিলে মাছ ধরতে নেমেছিলেন, কৃষক, শ্রমিক, চাকরিজীবী-ব্যবসায়ী, চিকিৎসকসহ বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার প্রায় ৩০ হাজার মানুষ।

বিলে গিয়ে দেখা গেছে, বিলের পানিতে মাছ ধরতে নেমেছে আশপাশের ২০ থেকে ২৫ গ্রামের বাসিন্দারা। টাঙ্গাইল, রাজশাহী নাটোর, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, নঁওগা, কুষ্টিয়াসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা শৌখিন মাছশিকারাও বাস-মিনিবাস, ট্রাক-মিনিট্রাক, করিমন-নসিমন, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ব্যাটারীচালিত অটোরিকশাসহ বিভিন্ন যানবাহন নিয়ে আসছেন। সকালের শুরুতে মাছশিকারিদের উৎসাহ দেখে মনে হওয়ার উপায় ছিল না উৎসবে কোনো পরিবর্তন এসেছে। তবে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভাটা পড়ে উৎসবে। কিটনাশক ট্যাবলেট ব্যবহার করে আগেরদিন মাছ নিধন করা হয়েছে। মাছ মরে ভেসে উঠছে।মাছ না পেয়ে বাড়িতে খালিহাতে ফিরে যাচ্ছেন হাজার হাজার সৌখিন মৎসশিকারী। মাছ না থাকায় তারা মৎস অফিস ও প্রশাসনের বিরুদ্ধে অভযোগ করে বক্তব্য দেন। সামনের বছর থেকে একানে মাছ শিকার করতে আসবে না বলে জানান।

বেশ কয়েকজন মাছশিকারিদের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, বর্ষার পর পানি নিচু এলাকাগুলোতে নেমে যায়। সেখানে প্রচুর মাছ জমে। ফলে প্রতি বছরের এই সময়ে বিলপাড়ের বাসিন্দারা একত্র হয়ে মাছ শিকারে নামেন। আগে মানুষের চেয়ে মাছ বেশি ছিল। বিলে নেমে কেউ কোনো দিন খালি হাতে ফেরেনি। বড় বড় রুই, কাতলা, বোয়াল, চিতল, শোল ও গজার মাছ পর্যাপ্ত পাওয়া যেত। উৎসব হতো টানা কয়েক দিন ধরে। কিন্তু বর্তমানে বিলে মাছ নাই বললেই চলে। ফলে উৎসব এখন সপ্তাহের শনি ও মঙ্গলবার আয়োজন করা হয়।

পাবনার কুচিয়ামোড়ার শাখাড়িপাড়ার আব্দুস সাত্তার বলেন, ছোটবেলা থেকে এই বিলের বাউৎ উৎসব শুরু হলেই তিনি ছুঁটে আসতেন মাছ ধরতে। মাছ ধরতে এসে তিনি কখনো নিরাশ হননি। রুহুল বিলে নামলে তিনি মাছ না নিয়ে কখনো বাড়ি ফিরে যাননি। পলো দিয়ে তিনি ৫ কেজি চিতল পেয়েছিলেন। এবার সেই আশায় তিনি পলো চালিয়ে যাচ্ছেন।

টাঙ্গাইলে ঘাটাইল থেকে আসছেন মো: সবুর হোসেন মিয়া।তিনি বলেন, আমরা প্রায় ১০-১৫ টির মত বাস-মিনিবাস নিয়ে গতকাল সোমবার রাত ১১ টার দিকে পাবনার ভাঙ্গুড়ার রুহুল বিল এলাকায় অবস্থান করেছি।ভোরে বিলের মধ্যে আমরা পলো, ধর্মজাল, চাকজাল, ঠেলাজাল, খুইরা জাল, বাদাই জালসহ উপকরণ নিয়ে বিলপাড়ে আসছি। অনেক আশা নিয়েই এখানে আসছি যে সবাই মিলে মাছ শিকার করে আনন্দের সঙ্গে বাড়ি ফিরে যাবে।কিন্তু বিলের পানিতে নেমে দেখি কোন মাছ নাই। আমরা শুনতে পেলাম বাউত নামার কথা শুনে এলাকার অসাধু মৎসশিকারীরা আগেরদিন পানিতে কিটনাশক প্রয়োগ করেছে। এরপরও এখানে এসে দেখি হাজার হাজার সুতিজাল ও কারেন্ট জাল বিলের মধ্যে লাগানো রয়েছে। যার জন্য বিলে কোন মাছ নেই। হতাশ হয়ে বাড়ি ফেরা ছাড়া উপায় নেই।

রাজশাহী থেকে আসছেন মো: আশরাফুল ইসলাম নামের একজন তিনি বলেন, আমরা কয়েকটি বাস নিয়ে রাত ২ টার দিকে এখানে আসছি মাছ শিকার করার জন্য। প্রতিবছরই এখানে আমরা আসি। প্রতিবছর কিছুনা কিছু মাছ পেয়ে থাকি। কিন্তু এ বছর কেউ কোন মাছ পাইনি। বাড়িতে গেলে মানুষজন রাগ করবে ভেবে বাজার থেকে মাছ কিনে নিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।মানুষের কাছে ইজারা না দিয়ে সরকার এটা সবার জন্য উন্মোক্ত করার দাবি জানান।

নাটোর থেকে মাঝ বয়সী আহসান হাবিব নামের একজন মাছ শিকার করতে আসছেন। তার অভিযোগ এটা প্রতিবছর একটি আনন্দ উৎসবের ব্যাপার। অথচ কিছু মানুষ অতিলোভে এই আনন্দটাকে মাটি করে দিতে বাউৎ উৎসবের আগেই, চায়না দুয়ারী, সুতিজাল, গ্যাস ট্যাবলেটসহ বিভিন্ন উপায়ে মাছ শিকার করে নেয়। ফলে এখন আগের মতো আর মাছ পাওয়া যায় না। আগে ভাগেই মাছগুলো অসাধু মানুষ মেরে নেওয়ায় আজ আমাদের নিরাশ হতে হচ্ছে।

চাটমোহরে ফৈলজানা ইউনিয়নের মৎসজীবী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আমাদের চাটমোহর ও ভাঙ্গুড়াতে প্রতি বছর এই সময় বাউত উৎসব হয়ে থাকে যেটা আমাদের প্রাণের উৎসবে পরিনত হয়েছে। এই সময় উৎসব দেখার জন্য জামাই মেয়ে নিয়ে আসা হয়। পারা মহল্লায় আনন্দ উৎসবে মনে হয় এটা ঈদ। সব শ্রেণিপেশার মানুষজন এখানে অংশ নিয়ে থাকেন। মৎস্য শিকারের চেয়ে সবাই মিলে আনন্দ উপভোগ করা সবচেয়ে বড় ব্যাপার। এই উৎসব ধরে রাখার জন্য এসব বিলের অভয়াশ্রমগুলো থেকে যাতে অসৎ উপায়ে মাছ শিকার না করার হয়। প্রমাসনের নজরদারী রাখা দরকার।

ভাঙ্গুড়া উপজেলা মৎস কর্মকর্তা মো: নাজমূল হুদা বলেন, ভাঙ্গুড়ার রুহুল বিলে প্রতিবছরই মাছ ধরার উৎসব হয়ে থাকে। প্রতিবার আমরা সেখানে অংশগ্রহণ করে থাকি। এবছর আমরা বিষয়টি জানিইনা। এটা একদিকে যেমন আনন্দ উৎসব অন্যদিকে আমি বলব বিলের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে।কারণ একসঙ্গে এত মানুষ পানিতে নামলে পানি দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। আবার মাছেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়।মা মাছ, পোনা মাছ সব কিছু ধ্বংস হয়ে যায়।উৎসবের জন্য দেশীয় মাছ কমে যাচ্ছে। দেশীয় মাছ রক্ষার্থে আমরা চায়না দুয়ারী, ‍সূতিজালসহ নানা কিছু বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছি। মাছের অভয়ারণ্য হিসাবে খ্যাত এই অঞ্চলের নির্ধারিত সীমারেখায় কোনো মানুষ অসাধু প্রক্রিয়ায় যাতে মাছ ধরতে না পারেন বা নিধন না করতে পারেন সে বিষয়ে প্রশাসনের পাশাপাশি স্থানীয় বাসিন্দাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।

আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড