• শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩০ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

দাদীর ‘মানত’ রক্ষায় সাইফুলের ব্যতিক্রমী বিয়ে

  রাকিব হাসনাত, পাবনা

২২ অক্টোবর ২০২৩, ১৫:৪১
মানত

সোনা-রুপার আংটি দিয়ে মোড়ানো লাল কাপড় বেঁধে ছেড়ে দেওয়া হলো গরু। যে প্রথমে ধরবে ছেড়ে দেওয়া গরুটি হবে তার। তবে ওই গরুর মালিক বা তার কোনো আত্মীয়-স্বজন নিতে পারবে না। শুধু কী তাই, তিনদিনব্যাপী চলেছে মাদারের (আঞ্চলিক ভাষা) পালা গান। সেইসাথে চলে খাওয়া দাওয়া। এরপর পালকীতে চড়ে সারা গ্রাম ঘুরে কনের বাড়িতে বিয়ে করতে গেলেন বর। পাড়া প্রতিবেশীরাও হই-হুল্লোড়ে মেতে উঠলেন। পুরো গ্রামে যেন তৈরী হয় উৎসবের আমেজ।

এসব শুনে মনে হতে পারে এটা কোনো সিনেমা বা নাটকের দৃশ্য! মনে হতে পারে রুপকথার কোনো গল্প। কিন্তু না, এভাবেই আয়োজনের মাধ্যমে বিয়ে করলেন পাবনার চাটমোহর উপজেলার ছাইকোলা ইউনিয়নের কাটেঙ্গা নদীপাড়া গ্রামের মৃত খাদেমুল ইসলামের ছেলে সাইফুল ইসলামের (৩২)। শুক্রবার (২০ অক্টোবর) সন্ধ্যায় বিয়ের আয়োজন সম্পন্ন হয়।

সাইফুল ইসলাম ক্ষুদ্র কৃষক উন্নয়ন ফাউন্ডেশন (এসএফডিএফ) চাকরি করেন। টানা কয়েকদিনব্যাপী এই বিয়ের আয়োজনে এলাকাবাসীর মধ্যে উৎসবের আমেজ বিরাজ করছিল। পালকীতে চড়ে বর সাইফুল যখন কনের বাড়িতে গেলেন তখন এলাকার শত শত মানুষ ভিড় জমান একনজর বিয়ের অনুষ্ঠান দেখতে।

সাইফুল ইসলাম ও তার পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সাইফুল ইসলামের বাবা ছিলেন ব্যবসায়ী। মা খোদেজা বেওয়া গৃহিণী। খোদেজা বেওয়া বিয়ের পর একে একে জন্ম দেন ৮ সন্তান। কিন্তু অজানা রোগে আক্রাস্ত হয়ে সব সন্তানই মারা যায়। একটা সন্তানের আশায় পাগলপ্রায় হয়ে পড়েন খোদেজা বেওয়া। মানসিকভাবে ভেঙ্গে পরে পুরো পরিবার।

এরপর খোদেজা বেওয়ার শাশুড়ি ময়না খাতুন পার্শ্ববর্তী নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলায় মেয়ের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে জানতে পারেন সেখানকার ‘শীতলী চরলালি মসজিদে ভেজা কাপড়ে গিয়ে আল্লাহর কাছে মানত করলে মনোবাসনা পূরণ হয়’।

লোকমুখে শুনে ময়না খাতুন ওই মসজিদে গিয়ে ভেজা কাপড়ে দুই হাত তুলে আল্লাহর কাছে বলেন, ‘যদি ছেলে বউয়ের কোনো সন্তান হয় এবং বেঁচে থাকে তবে সেই সন্তানের বিয়ের সময় সোনা-রুপার আংটি দিয়ে মোড়ানো লাল কাপড় গরুর গলায় বেঁধে গ্রামবাসীর উদ্দেশ্যে ছেড়ে দেওয়া হবে। সেই সাথে হবে মাদারের গান এবং পালকীতে চড়িয়ে পুরো গ্রাম ঘুরিয়ে বিয়ে করানো হবে সেই সন্তানকে। আর বরযাত্রীকে খাসি জবাই করে খাওয়ানো হবে।

এর কিছুদিনের মধ্যেই সাইফুল ইসলামের জন্ম হয়। শুধু সাইফুলই নয়, তার মা খোদেজা বেওয়ার কোল আলো করে পর পর জন্ম নেয় একটি মেয়েসহ আরো তিন সন্তান। পরিবারে বইতে থাকে খুশির বন্যা। এরমধ্যে কেটে গেছে ৩২ বছর। পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেছেন সাইফুলের দাদী ময়না খাতুন ও বাবা খাদেমুল ইসলাম। অবশেষে দাদীর সেই ‘মানত’ রাখতেই নানা আয়োজনের মধ্যে বিয়ের পিঁড়িতে বসেন সাইফুল ইসলাম। কনে একই উপজেলার বরদানগর মরশিন্দা গ্রামের বাচ্চু মিয়ার মেয়ে মায়া খাতুন।

সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘দাদীর মানত রাখতে এইভাবে বিয়ের আয়োজন করতে হয়েছে। সব মিলিয়ে প্রায় দুই লাখ টাকা খরচ হয়েছে। আত্মীয়-স্বজন সবাইকে নিয়ে খুবই আনন্দ হয়েছে। আর পালকীতে চড়ে বিয়ে করা শুধু শুনেছি, এবার নিজে সেই আনন্দ উপভোগ করলাম।’

সাইফুলের মা খোদেজা বেওয়া বলেন, ‘আমার শাশুড়ি বেঁচে থাকতে এই মানত করেছিলেন। তিনি মৃত্যুর আগে আমাকে বলে যান, ছেলের নাম সাইফুল থাকবে। আর যেভাবে মানত করেছি সব ঠিকমতো পালন করবে। তার সেই মানত আমি পূরণ করলাম। আল্লাহ আমাদের ভাল রেখেছেন, সন্তানদের সুস্থ্য রেখেছেন। আমরা খুব খুশী।’

বিয়ের কনে মায়া খাতুন বলেন, ‘আমি শুনেছি দাদীর মানত রাখতে এভাবে বিয়ের আয়োজন করেছেন তারা। আমাদের বাড়িতেও আনন্দ উৎসব হয়েছে। আমরা খুব খুশি। সবাই দোয়া করবেন যে আমরা সুখী হতে পারি, শ্বশুরবাড়ীর সবাইকে নিয়ে ভাল থাকতে পারি।’

সাইফুল ইসলামের শ্বশুড় বাচ্চু মিয়া বলেন, ‘এভাবে আনন্দ উৎসবে আমার মেয়ের বিয়ে হওয়ায় খুশী সবাই। পালকীতে বিয়ে করতে আসায় গ্রামের মানুষ দেখতে আসেন। বাবা হিসেবে সবার দোয়া চাই যেন মেয়েটা সুখী হয়।

চাটমোহর উপজেলার ছাইকোলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুজ্জামান নুরু বলেন, ‘ব্যতিক্রমী এই বিয়েটা একেবারেই অন্যমাত্রা এনে দিয়েছে। পুরো গ্রামবাসী উপভোগ করেছেন সাইফুল ইসলামের বিয়ে।’

আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড