• রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩২ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে ভূমিদস্যুদের অপপ্রচার

  এস এম মিজানুর রহমান মজনু, স্টাফ রিপোর্টার (ময়মনসিংহ)

১৮ জুলাই ২০২৩, ১৫:৪০
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে ভূমিদস্যুদের অপপ্রচার

ময়মনসিংহের ভালুকায় একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জমি দখল, কর্মরত শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দপ্তরে নানা ভুয়া অভিযোগ, অপপ্রচার করে ক্রমাগত বিদ্যালয়ে স্বাভাবিক পাঠদানের পরিবেশ বিনষ্ট এবং এক পুলিশ কর্মকর্তা ও তার পরিবারের সুনাম নষ্ট করার অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় কয়েকজন ভূমিদস্যু সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে।

উপজেলার কাচিনা ইউনিয়নের ৭১নং কাদিগড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ করেন আবুল কালাম তালুকদার নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি। এ ঘটনায় সরেজমিনে তদন্ত করে প্রাথমিকভাবে মিথ্যা প্রমাণিত নিশ্চিত করেছেন উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা সৈয়দ আহমেদ।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, সালেহ ইমরান ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে স্কুলের ভবন ভেঙ্গে আত্মসাৎ এবং জমি জবরদখলের অভিযোগ করা হয়েছে। উক্ত অভিযোগের ভিত্তিতে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এরশাদুল আহমেদ।

সরেজমিনে কাচিনা ইউনিয়নের কাদিগড় গ্রামে গিয়ে কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, উপজেলার কাচিনা ইউনিয়নের ৭১ নং কাদিগড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পুরাতন ভবনের পেছনে প্রায় দশ একর আবাদি জমি রয়েছে। আবাদি জমির মধ্যে দক্ষিণ পাশে প্রায় তিন মাস আগে পুকুর খনন করে অভিযুক্ত সাইফুল ইসলাম। খননকৃত পুকুরের জমির ওপর দিয়ে ওই কৃষকদের প্রায় দশ একর আবাদি জমির বৃষ্টির পানি প্রবাহিত হতো।

পুকুর খননকালে পাড় তৈরির সময় কোন ধরনের কালভার্ট বা পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা রাখেননি অভিযুক্ত সাইফুল ইসলাম। ফলে কিছুদিন আগে টানা বৃষ্টিতে ওই কৃষকদের প্রায় দশ একর জমিতে ধান রোপণের জন্য রোপণকৃত চারার জমি তলিয়ে যায়। কয়েকদিনেও পানি নিষ্কাশন না হওয়ায় ওই রোপণকৃত চারা নষ্ট হওয়ার আশংকা দেখা দিলে ভুক্তভোগী শফিকুল, আলমগীর ও রেজাউলসহ বিভিন্ন কৃষকরা পুকুরের পাড়ের মধ্যে কালভার্ট দেয়ার জন্য সাইফুল ইসলাম এবং তার মেয়ের জামাই রমিজকে অনুরোধ করলেও কারও কোনো কথায় পাত্তা না দিয়ে বরং নানা হম্বিতম্বি করতে থাকে সাইফুল এবং তার মেয়ের জামাই ভালুকা ঠিকাদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. রমিজ খান।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে আরও জানা যায়, ভূমিদস্যু সিন্ডিকেট বিভিন্ন সময় নানাভাবে ওই এলাকার শান্তি শৃঙ্খলা বিনষ্ট করতে বিভিন্ন জনকে নিয়ে এমন চক্রান্ত ষড়যন্ত্র প্রায়ই করে থাকেন ভূমিদস্যু সাইফুল এবং জুয়েল। এদের সাথে নতুন করে যুক্ত হয়েছেন ঐ এলাকার স্বপন এবং রিপন তালুকদার।

সম্প্রতি স্বাভাবিক পানি প্রবাহে বাধা, জলাবদ্ধতার কারণে সৃষ্ট অনিশ্চয়তায় প্রায় দশ একর আবাদি জমি অনাবাদী থাকার আশংকা দেখা দিতে পারে বলে জানান ওই স্থানীয়রা। এ ব্যাপারে চার একর জমির মালিক পুলিশ কর্মকর্তা এসআই সালেহ ইমরান নিজে বাদী হয়ে গত ২ জুলাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও ভালুকা মডেল থানায় দুটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন।

জানা যায়, ভালুকা উপজেলার কাচিনা ইউনিয়নের কাদিগড় গ্রামের মৃত ইউসুফ আলীর ছেলে মো. সাইফুল ইসলামের বিরুদ্ধে ১৪ বছর আগে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের জীবিত দেখিয়ে নকল জমিদাতা সাজিয়ে ১৭ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ জালিয়াতি, শ্যালিকাকে ধর্ষণ ও ভ্রূণ হত্যাসহ একাধিক মামলা চলমান রয়েছে। ওই চক্রের আরেক সদস্য জুয়েল গংদের প্রত্যক্ষ মদদে মেতে উঠেছে এমন নোংরা খেলায়। তাদের সাথে সহযোগী হিসেবে রয়েছেন আবুল কালাম তালুকদার নামে এক ব্যক্তি যে কিনা অন্যের জমি নিজের বলে চালিয়ে দেবার সময় সাধারণ জনগণ তাকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল।

সহযোগী হিসেবে আছে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা দাবি করা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা মেছের আলী, সাইফুল ইসলাম ও তার মেয়ের জামাই মো. রমিজ খান, রিপন তালুকদার, স্বপন তালুকদার ও আলামিন প্রমুখ।

৭১নং কাদিগড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে একের পর এক মিথ্যা অভিযোগ করেই চলেছেন এরা। চিহ্নিত ভূমিদস্যু সাইফুল ইসলামের বিরুদ্ধে পুকুর খননের আড়ালে স্বাভাবিক পানি প্রবাহে বাধা দেয়াসহ বিদ্যালয়ের জমি থেকে বাঁশ কেটে বিক্রি করে অর্থ আত্মসাৎ এবং উক্ত জমি মাটি দিয়ে ভরাট করার গুরুতর অভিযোগ উঠেছে।

মৃত ব্যক্তির নামে ১৭ কোটি টাকার জমির জাল-জালিয়াতি সিআইডির তদন্তে চার্জশীট ভুক্ত সাইফুল ইসলাম তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করলেও তার মেয়ের জামাই ভালুকা ঠিকাদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. রমিজ খান মুঠোফোনে দৈনিক অধিকারের প্রতিবেদকের সাথে হম্বিতম্বি করেন, নানা ধরনের অসংলগ্ন ও অপ্রাসঙ্গিক কথা বলেন।

এসআই সালেহ ইমরান জানান, যেখানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদী না রাখার জন্য সবার প্রতি আহবান করছেন সেখানে সাইফুল ইসলামের মত চিহ্নিত ভূমিদস্যু পুকুর খননের আড়ালে বাধ দিয়ে মানুষের জমি জোর পূর্বক অনাবাদী রাখার পায়তারা করছে। সাইফুল তার মেয়ের জামাই মো. রমিজ খান ও স্থানীয় আলামিনসহ আরও কিছু সহযোগীদের প্রত্যক্ষ মদদ ও সহযোগিতায় এই কাজ করছেন বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

চক্রের অভিযোগের ব্যাপারে এলাকায় খোজ নিয়ে জানা গেছে, এসআই সালেহ ইমরানকে নিয়ে যে জমি জবরদখল এবং আত্মসাৎ এর অভিযোগ করা হয়েছে সেটি স্কুলের পাশেই একটি মসজিদ এবং মাদরাসার জমি। দীর্ঘ ৬০ বছর ধরে উক্ত জমি মসজিদ এবং মাদরাসা ভোগ দখলে আছে৷ উক্ত জমি নিয়ে মসজিদ এবং মাদরাসার পক্ষ থেকে সালেহ ইমরানের প্রতি কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি।

সরেজমিনে বিদ্যালয় পরিদর্শন করে বিদ্যালয়টির কয়েকজন অভিভাবকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বিদ্যালয়ের পরিবেশ অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় অত্যন্ত ভালো। উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার কিছুদিন আগে বিদ্যালয় পরিদর্শন করে বিদ্যালয়ের সার্বিক পরিবেশ নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন বলে জানিয়েছেন ওই সময় বিদ্যালয়ে উপস্থিত একাধিক অভিভাবকেরা।

পুলিশ কর্মকর্তা এসআই সালেহ ইমরানের ব্যাপারে এলাকায় খোজ নিয়ে জানা গেছে, তিনি বিভিন্ন সময়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় ভূমিদস্যুদের রোষানলের স্বীকার হয়েছেন। এলাকায় বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের বিষয়ে তার যথেষ্ট সুনাম রয়েছে৷

সরেজমিনে এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে আরও জানা যায়, সাইফুল ইসলাম ও তার মেয়ের জামাই রমিজ এর বিরুদ্ধে বিদ্যালয়ের জমি থেকে বাঁশ কেটে জমি দখল এবং পানি প্রবাহে বাধা দেওয়ার অভিযোগ দায়েরের পর থেকে ক্ষিপ্ত হয়ে ওই ভূমিদস্যু সিন্ডিকেটের সদস্যরা কাউন্টার অভিযোগ হিসেবে সালেহ ইমরান ও তার স্ত্রী ৭১নং কাদিগড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা নূপুর আক্তারের বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ দেন ওই সিন্ডিকেটের সদস্যরা। এই সমস্যা নিরসনে দ্রুত প্রশাসনের সহযোগিতাও কামনা করেন এলাকাবাসী।

৭১নং কাদিগড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জমিদাতা, পিটিআই কমিটির সভাপতি এবং অভিভাবক রুমি তালুকদার বলেছেন, এখানে পরিত্যক্ত ভবনের একটি রুম ভাঙ্গা হয়েছে। মূলত একটি ওয়াশ ব্লক করার কারণে এটি ভাঙা হয়েছে। এটা অফিসিয়াল যত ফর্মালিটি আছে এবং ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি এটিও স্যারসহ সবাই জানে ভাঙা হয়েছে। কিছু কতিপয় লোক না জেনে মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করেছে। অভিযোগ তো দেখিনায় আমরা শুনলাম ইট, রড ও টিন। এগুলো নাকি বিক্রি করেছে।

তিনি আরও বলেন, এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগ, সমস্ত কিছু মালামাল মজুত আছে স্কুলে। এর সাথে ভূমিদস্যু সাইফুল ইসলাম, জুয়েল, কালাম তালুকদার ও নতুন করে রিপন তালুকদার যুক্ত হয়েছে। এদের অত্যাচারে এলাকায় থাকা সম্ভব হচ্ছে না। যা কিছু করতেছে এরাই ক্ষমতা দেখিয়ে করতেছে।

গতকাল সোমবার ৭১নং কাদিগড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মসজিদ মার্কেটের সামনে দৈনিক অধিকারের প্রতিবেদককে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে ১৭ কোটি টাকার দুর্নীতির মামলার আসামি জুয়েল দম্ভ নিয়ে বলেন, তার নামের সাথে ভূমিদস্যু লেখছেন কেন? এ নিয়ে তিনি দৈনিক অধিকারের ময়মনসিংহের স্টাফ রিপোর্টারের সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে পড়েন।

৭১নং কাদিগড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা নূপুর আক্তার বলেন, বিদ্যালয়ের একটি মাত্র টয়লেট। আমাদের বিদ্যালয়ে ১শ ২০ জন শিক্ষার্থী ও শিক্ষক-শিক্ষিকা ৫ জন ও একজন দপ্তরী রয়েছে এবং অভিভাবকসহ সবাই একটি মাত্র টয়লেট ব্যবহার করা হয়। সেই কারণে শিক্ষক, ম্যানেজিং কমিটি এবং অফিসকে জানিয়ে রেজুলেশনের মাধ্যমে ভাঙ্গা হয়েছে। সবগুলো মালামাল মজুত রয়েছে।

এ ব্যাপারে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সৈয়দ আহমেদ জানান, ৭১নং কাদিগড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জমি কারও দখলে নয় বরং স্কুলের দখলেই রয়েছে এবং পুরাতন ভবন ভেঙে দুতলা ওয়াশ ব্লক নির্মাণের সিদ্ধান্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র অনুযায়ী নিয়মতান্ত্রিক ভাবেই হয়েছে।

ভালুকা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এরশাদুল আহমেদের কর্তৃক পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গতকাল সোমবার (১৭ জুলাই) সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত ৭১নং কাদিগড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শন করেছেন। ওই পাঁচ সদস্যের সরেজমিনে তদন্ত করে অভিযোগের কোন সত্যতা পায়নি বলে একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে। খুব শীঘ্রই তদন্ত রিপোর্ট জমা দেওয়ার পর আনুষ্ঠানিকভাবে বিস্তারিত জানাবেন বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে।

আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড