• সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৬ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

চিকিৎসকের অবহেলায় প্রসূতির মৃত্যুতে মাতৃহীন শিশুর মিছিল বাড়ছেই

  রিয়াজুল ইসলাম, কুষ্টিয়া

২৫ জুন ২০২৩, ১৫:৪৪
চিকিৎসকের অবহেলায় প্রসূতির মৃত্যুতে মাতৃহীন শিশুর মিছিল বাড়ছেই
প্রসূতি মা ও তার সদ্যোজাত শিশু সন্তান (ফাইল ছবি)

কুষ্টিয়ায় যত্রতত্র ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা অবৈধ ক্লিনিকগুলো যেন প্রসূতি মায়েদের মৃত্যু ফাঁদে পরিণত হয়েছে। অধিকাংশ প্রাইভেট ক্লিনিক ও হাসপাতালগুলো চিকিৎসা সেবাকে কেবলমাত্র মুনাফা আয়ের সহজ পথ হিসেবে নেয়ায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।

চিকিৎসার নামে জীবনহানি নিত্যদিনের ঘটনা হলেও প্রতিকারে দোষীদের বিরুদ্ধে কার্যত: কোনো দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ না নেয়াকে দুষছেন ভুক্তভোগীরা। একের পর এক মৃত্যুর ঘটনা ঘটলেও এসব ক্লিনিক বন্ধে দায় নিচ্ছে না কেউ। অবৈধ সিজারে প্রসূতি মৃত্যুর ঘটনায় মায়ের স্পর্শ বঞ্চিত এতিম শিশুর মিছিল দিন দিন যেন বেড়েই চলেছে।

কুষ্টিয়া সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের প্রথম ৫ মাসে ৬৩১২টি জীবিত শিশু জন্ম দিতে গিয়ে প্রসবকালীন সময়ে সাতজন মায়ের মৃত্যু হয়েছে। ২০২১ সালে প্রসবকালীন সময়ে প্রসূতি মায়ের মৃত্যু সংখ্যা ২৫ জন থাকলেও ২০২২ সালে এ সংখ্যা ২৭ জনে দাঁড়ায়। এসব মৃত্যুর ঘটনার ৯০ ভাগই ঘটেছে প্রাইভেট ক্লিনিকগুলোতে।

ভুল চিকিৎসা বা অবহেলা জনিত কারণে এসব মৃত্যু ঘটেছে বলে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলে মনে করছেন না স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে এ বছরের ১৩ জুন পর্যন্ত সংঘটিত মাতৃমৃত্যুর ঘটনাগুলো অনুসন্ধানকালে বিভিন্ন ক্লিনিকে ঝরে যাওয়া আটজন প্রসূতি মায়ের মৃত্যু ঘটনার পর্যালোচনায় জেলার স্বাস্থ্য সেবার ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে।

এরা সবাই অদক্ষ ও অপেশাদার ভুয়া স্বাস্থ্য কর্মীদের হাতে কথিত সিজারের শিকার হয়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে সদ্যজাত শিশুকে রেখে নিহত হয়েছে। অপর একজন প্রসূতি শিশুসহ মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ে বলে অভিযোগ পরিবারের।

সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, এ বছরের ৩ জুন কুষ্টিয়া মিরপুর উপজেলার পোড়াদহে ‘নাহার ক্লিনিকে’ সদর উপজেলার দোস্তপাড়া গ্রামের বাসিন্দা শিল্পী খাতুন (২২) নামে এক প্রসূতি অদক্ষ ভুয়া নার্সের হাতে সিজারের শিকার হয়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মৃত্যু হয়।

অভিযোগ আছে- এই নাহার (প্রাঃ) ক্লিনিকে সার্বক্ষণিক ডাক্তার হিসেবে ডা. আক্তারুজ্জামান ফিরোজ নামে যিনি কাজ করেন তিনি কার্যত: একজন মাদকাসক্ত ভুয়া চিকিৎসক এবং ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে মিরপুর থানা পুলিশের হাতে ইয়াবাসহ গ্রেফতার হন বলে স্থানীয়দের অভিযোগ।

২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর কুষ্টিয়া ইসলামিয়া অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক হাসপাতাল নামে একটি অবৈধ ক্লিনিকের ওয়ার্ডবয় এবং আয়া মিলে সদর উপজেলার বটতৈল গ্রামের জহুরুল ইসলামের স্ত্রী রিমা খাতুন(২৮) নামে এক প্রসূতির স্বাভাবিক ডেলিভারি করাতে গিয়ে টেনে-হিঁচড়ে শিশুটিকে বের করতে পারলেও প্রসূতির ইউটেরাস ছিঁড়ে ফেলায় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে ওই প্রসূতি রিমা খাতুনসহ শিশুটি নিহত হয়। একই ভাবে ২ মার্চ ভেড়ামারা ‘সাদিয়া ক্লিনিকে’ নাসিমা নামে প্রসূতি, ২০২১ সালের ৯ জুনে কুষ্টিয়া সনো হাসপাতালে নাসরিন নাহার রিপা (২১) নামে প্রসূতি, ২০২১ সালের ১ অক্টোবর কুষ্টিয়া সদর উপজেলার সেবা ক্লিনিকে তুলিকা বেগম (২৫), ২০২০ সালের ১ আগস্ট কুমারখালি বাঁশগ্রামের আকবরের স্ত্রী তানিয়া খাতুন (২২) কুষ্টিয়া ইসলামিয়া হাসপাতালে, ১ সেপ্টেম্বর কুমারখালি উপজেলার সোন্দাহ গ্রামের শাপলা খাতুন (২২) কুষ্টিয়া শহরের কাস্টম মোড়স্থ শাপলা ক্লিনিকে এবং একই বছর ৯ মার্চ কুষ্টিয়া শহরের পেয়ারাতলায় পদ্মা প্রাইভেট হাসপাতালে, কুমারখালী উপজেলার সাওতা গ্রামের আব্দুর রশিদের স্ত্রী ফাতেমা খাতুন (২৪) নামে প্রসূতি মায়ের অবৈধ সিজারিয়ানে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে নিহত হয়েছেন বলে অভিযোগ পরিবারগুলোর। এই সবগুলো প্রসূতিই সদ্যজাত শিশুকে এতিম করে মৃত্যুবরণ করেছেন।

এ বিষয়ে স্বাচিপ ও বিএমএ নেতা ডা. আমিনুল হক রতন মুঠোফোনে বলেন, প্রসূতি মায়েদের চিকিৎসা বিষয়টি বেশ স্পর্শকাতর। এসব ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের অধিকতর সতর্কতা জরুরি। সামান্যতম অবহেলা জনিত কারণে প্রাণহানির কারণ হতে পারে। জেলার বিভিন্ন অবৈধ ক্লিনিকগুলিতে মা ও শিশুর যথাযথ পরিচর্যা ও চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থাই কার্যত: নাই।

তিনি আরও বলেন, অথচ কিছু অসচেতন রোগীরা সেখানে গিয়ে নানাভাবে প্রতারিত হচ্ছে বলে আমরা জানি। এসব নিরসনে জেলার স্বাস্থ্য বিভাগকে আরও দায়িত্বশীল ও যত্নবান হওয়া জরুরি।

কুষ্টিয়া সিভিল সার্জন ডা. এইচ এম আনোয়ারুল ইসলাম ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, চিকিৎসায় অবহেলা জনিত কারণে প্রসূতি মায়ের মৃত্যু ঘটনার সংবাদ পেলেই আমরা সেখানে ছুটে যাই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অভিযোগের সত্যতাও পাই। সেক্ষেত্রে ক্লিনিক বা হাসপাতাল বন্ধের সুপারিশ করি। সর্বশেষ মিরপুর উপজেলার পোড়াদহে ‘নাহার ক্লিনিকে’ চিকিৎসা অবহেলায় শিল্পী খাতুন নামে প্রসূতির মৃত্যুর ঘটনাটি ঘটেছে ওই ক্লিনিকের জন্যই।

তার দাবি, ওদের এ জাতীয় চিকিৎসা দেয়ার মতো প্রয়োজনীয় কোনো আয়োজন ও অনুমোদন কোনোটিই নেই। এসব ক্ষেত্রে রোগীদেরও সচেতন হওয়া দরকার।

আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড