• শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১  |   ৩৮ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

বিবাহিত স্ত্রীর সাথে দুই বছর ঘর-সংসার করেও স্বামী ধর্ষণ মামলার আসামি

  মনিরুজ্জামান, নরসিংদী

১৭ জুন ২০২৩, ১৭:৩৫
ধর্ষণ

নরসিংদীর রায়পুয়ায় নিজের বিবাহিত স্ত্রীর সাথে প্রায় দুই বছর ঘর-সংসার করার পর তাদের বৈধ মেলামেশাকে ধর্ষণ হিসেবে আখ্যায়িত করে স্ত্রীর দায়ের করা মামলায় ইব্রাহিম নামে এক স্বামী ফেরারী আসামি হয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন । ওই মামলায় দুই মেয়াদে প্রায় পাঁচ মাস কারাভোগ করে জামিনে মুক্ত হয়ে সবকিছু হারিয়ে বর্তমানে সৌদি আরবে অবস্থান করছেন।

জানা যায়, ২০২০ সালের ৩ নভেম্বর ব্রাহ্মনবাড়িয়ার নবীনগরের বগডহর গ্রামের সায়েদুর রহমানের ছেলে ইব্রাহিম ও নরসিংদীর রায়পুরার সওদাগর কান্দি গ্রামের শাহ জালাল মিয়ার মেয়ে মনিরা বেগম উভয়ে ব্রাহ্মনবাড়ীয়া নোটারী পাবলিক কার্যালয়ে উপস্থিত হয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। তারা দুজনেই বিবাহিত ছিলেন। ইব্রাহিমের প্রথম পক্ষের স্ত্রী এখনও বর্তমান। অপরদিকে এক সন্তানের জননী মনিরা ইব্রাহিমকে বিয়ের আগেই ২০২০ সালের ২২ অক্টোবর তার প্রথম স্বামী রূপ মিয়াকে তালাক দেয়। তাদের বিয়ের প্রায় ছয় মাস আগে নবীনগরে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে মনিরার সাথে ইব্রাহিমের পরিচয় হয়। পরিচয় থেকে প্রণয়, অত:পর তা বিয়ে পর্যন্ত গড়ায়। তবে বিয়ের আগেই তাদের মধ‍্যে শারিরীক সম্পর্ক গড়ে উঠে। বিয়ের আগে বহুবার তারা গোপনে মিলিত হয়েছেন বলে ইব্রাহিম মোবাইল ফোনে প্রতিবেদককে বিষয়টি জানিয়েছেন।

ইব্রাহিম আরও জানায়, বিয়ের আগে ও পরে আমরা গোপনে মিলিত হতাম। তার প্রথম স্বামীর ঘরে একটি ছেলে সন্তান রয়েছে। বিয়ের বেশ কিছুদিন পর মনিরার বাড়ীর লোকজন প্রথম স্বামীকে তালাক দেওয়ার বিষয়টি জানতে পারে। তখন মনিরার বাবা-তাকে বাড়িতে আটক করে। এর কয়েকদিন পরে মনিরা সুযোগ বুঝে বাড়ি থেকে পালিয়ে ইব্রাহিমের কাছে গিয়ে উঠে। এদিকে মনিরা বাড়ি থেকে বের হয়ে আসার পর তার মোবাইল ফোনে বাড়ির লোকজন বারবার ফোন দিতে থাকে কিন্তু সে কারও ফোন রিসিভ করেনি। বেশ কয়েকদিন পর সে তার মার ফোন রিসিভ করে। বৈধভাবে নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে তাদের বিয়ে হয় এ কথা জানানোর পরও তার মা তাদের স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কটা মেনে নিতে চাইছিল না। এ অবস্থায় রাগের বশবর্তী হয়ে তাদের স্বামী-স্ত্রীর একান্ত কিছু মুহূর্তের ভিডিও চিত্র মনিরা নিজেই তার মোবাইল ফোনে ধারণ করে। আর ধারণ করা সেই ভিডিও চিত্রের একটি খন্ড অনলাইনে মায়ের মোবাইলে পাঠিয়ে দেয়। এরপর ইব্রাহিম তার দ্বিতীয় স্ত্রী মনিরাকে তার গ্রামের বাড়ি না রেখে ব্রাহ্মণবাড়িয়া নবীনগর উপজেলা সদরে ভাড়া বাসায় নিয়ে তোলে। একটা সংসার সাজাতে যত ধরনের আসবাবপত্রের প্রয়োজন ইব্রাহিম সব নতুন কিনে এনে মনিরাকে ঘর সাজিয়ে দেয়। পাশাপাশি মনিরা যখন যে ধরনের গহনার আবদার করেছে স্ত্রীর মন রক্ষার্থে স্বামী হিসেবে ইব্রাহিম তা কিনে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। এভাবে তাদের বিবাহিত জীবনের দুই বছরে স্ত্রী মনিরাকে ৬/৭ ভরি ওজনের বিভিন্ন প্রকার গয়না কিনে দেয় সে। ইব্রাহিম এর কাছে পালিয়ে আসার ৫/৬ মাস পর একদিন মনিরার মা জাহানারা বেগম নবীনগরের বাসায় এসে হাজির হয়। মেয়ে মনিরা ও মেয়ের জামাই ইব্রাহিমকে বেড়ানোর নাম করে রায়পুরা সওদাগর কান্দিতে নিয়ে আসে। সেখানে আসার পর জাহানারা বেগমের স্বরূপ পাল্টে যায়। তার দুই পরামর্শদাতা মনিরার ফুফা জসিম উদ্দিন ও তার বন্ধু আনিসুজ্জামান এর পরামর্শে মেয়েকে আর ইব্রাহিমের সাথে দিবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়ে মনিরাকে আটকে রাখে। ইব্রাহিম স্ত্রীকে হারানোর ভয়ে গ্রামের বিভিন্ন লোকজনদের স্মরণাপন্ন হয়। চানপুর ইউপি চেয়ারম্যানের বড় ভাই শরীফ সরকার পরিস্থিতি ঠান্ডা হলে এমনি এমনি সব ঠিক হয়ে যাবে বলে তাকে কিছুদিন অপেক্ষা করার পরামর্শ দেন ।

পরে ইব্রাহিম চাঁদপুর থেকে তার বাড়ি চলে যায়। এর কয়েকদিনের মধ্যেই মনিরা আবার পালিয়ে তার কাছে চলে যায়। কয়েক মাস দুজনে ভালোভাবেই ঘর সংসার করতে থাকে। এর মধ্যে একদিন মনিরার মা তাকে ফোন দিয়ে বাড়িতে আনে। ইব্রাহিমকে সাথে নিয়ে মনিরা বাবার বাড়ি আসলে মনিরার মা এবং বাবা রায়পুরায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকাতে বলে তাদেরকে। মনিরার মা-বাবার কথায় ইব্রাহিম রায়পুরার থানা-হাটি মহল্লায় মাদ্রাসার পাশেই বাসা ভাড়া নিয়ে মনিরাসহ থাকতে শুরু করে। কয়েক মাস পর মনিরা বাবার বাড়ি বেড়াতে আসলে তার মায়ের দুই পরামর্শদাতা জসিম ও আনিসুজ্জামানের কথায় তাকে ভুলভাল বুঝিয়ে ইব্রাহিম এর নামে থানায় একটি ধর্ষণ মামলা দায়ের করায়। পরবর্তীতে ২০২২ সালের ৩১ মার্চ ভৈরব ব্রিজ সংলগ্ন আশুগঞ্জ পেট্রোলপাম্প থেকে ইব্রাহিমকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এরপর দিন অর্থাৎ ১ এপ্রিল ধর্ষণ ও পর্নোগ্রাফির মামলায় তাকে আদালতে প্রেরণ করা হয়। স্ত্রী মনিরা বাদী হয়ে করা ধর্ষণ ও পর্নোগ্রাফির মামলায় আদালতের বিজ্ঞ বিচারক তার জামিন নামঞ্জুর করে জেল হাজতে প্রেরণের নির্দেশ দেয়। প্রায় দুই মাস কারাভোগের পর ইব্রাহিম ১ জুন জামিনে মুক্ত হয়। পরে ৩ আগস্ট আদালতে হাজিরা দিতে গেলে বিজ্ঞ বিচারক তার জামিন নামঞ্জুর করে তাকে পুনরায় জেল হাজতে পাঠায়। প্রায় দুই মাস কারাভোগের পর ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ তারিখে সে জামিনে মুক্ত হয়ে ভয়ে সৌদি আরব পাড়ি জমান।

স্ত্রীর দায়ের করা মামলার সত্যতা উদঘাটনের জন্য ইব্রাহীমের প্রথম স্ত্রী নরসিংদী জেলা রিপোর্টার্স ক্লাবের সংবাদকর্মীদের সহযোগিতা কামনা করলে সম্প্রতি ক্লাবের একটি টিম উপজেলার চাঁনপুর ইউনিয়নের সওদাগরকান্দি ও সুজাতপুর এলাকা ঘুরে স্থানীয় এবং মনিরার বাবা-মা, মনিরার প্রথম স্বামী রূপ মিয়ার বাড়ির লোকজনের সাথে কথা বলেন। তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, মনিরার স্বামী মালয়েশিয়া প্রবাসী হওয়ার সুবাদে সে বিভিন্ন জনের সাথে কথা ও প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলে। ইব্রাহিমের সাথে পরিচয় হওয়ার আগে ছোট বোনের বিয়ের অনুষ্ঠানের ভিডিয়ো করতে আসা এক ছেলের সাথে পরিচিত হয়। পরে ব্রাহ্মনবাড়িয়ার আশুগঞ্জে বাসা নিয়ে ওই ছেলের সাথে কোনরকম বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ না হয়েই প্রায় ৭ মাস লিভ টুগেদার করে। পরে মনিরার মা জানাহারা বেগম গিয়ে সেখান থেকে মেয়েকে নিয়ে এসে রূপ মিয়ার বাড়ি পাঠায়। সেখান থেকেও আসার সময় মোটা অংকে টাকা-পয়সা ও স্বর্ণালংকার নিয়ে আসে। সেখান থেকে আসার কয়েক মাস পর ইব্রাহিমের সাথে পরিচয় হয় মনিরার। পরে সম্পর্ক এবং স্বামী রূপ মিয়াকে তালাক দেয়, অত:পর পালিয়ে বিয়ে। ইব্রাহিম জানায়, মনিরা রূপ মিয়ার স্ত্রী থাকাকালীন সময়ে বিভিন্ন এনজিওর কাছ থেকে টাকা ঋণ নিয়েছে। সেই ঋণের কিস্তির টাকা ইব্রাহিমের কাছ থেকে নিত মনিরার মা জাহানারা বেগম। ইব্রাহিম ও মনিরার দুই বছরের সংসার জীবনে প্রায় ১০/১২ লাখ টাকা মনিরা ও তার মা হাতিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি মনিরাকে কিনে দেওয়া প্রায় ৭ ভরি ওজনের বিভিন্ন স্বর্ণালংকারও হাতিয়ে নিয়েছে।

সরেজমিনে চাঁনপুর ইউনিয়নের সওদাগরকান্দি গ্রাম ঘুরে স্থানীয়দের সাথে কথা বললে তারা জানায়, মনিরার মা জাহানারা বেগম খুবই চালাক ও লোভী প্রকৃতির মহিলা। ইব্রাহিমের সর্বস্ব হাতিয়ে নিয়েছেন তার কাছ থেকে এখন কোনো কিছু নেই তাই তিনি এবার তার মেয়েকে প্রথম স্বামী রূপ মিয়ার বাড়ি পাঠানোর পায়তারা করছেন। আর তাকে বিভিন্নভাবে বুদ্ধি পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করছেন জসিম ও আনিসুজ্জামান।

পরে ইউনিয়নের সুজাতপুর গ্রামে রূপ মিয়ার বাড়িতে গিয়ে তার মা, বোন ও ছোট ভাইয়ের সাথে কথা বলে মনিরাকে তারা আবার আনতে চায় কিনা জানতে চাইলে তারা বলেন, মনিরা নিজে রূপ মিয়াকে তালাক দিয়েছে এবং সেই তালাকের কাগজ ডাকযোগে তাদের কাছে পাঠিয়েছে। যে মেয়ে নিজে তাদের ছেলেকে তালাক দিয়েছে তাকে কোনো অবস্থাতে ঘরে তোলার কথাটি মেনে নিতে পারবে না বলে সাফ জানিয়ে দেয়।

পরে সওদাগরকান্দি গ্রামে মনিরাদের বাড়ি গেলে তার বাবা শাহজালাল মিয়াকে মনিরার সাথে ইব্রাহিমের কি সম্পর্ক জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাদের মধ্যে কোন সম্পর্ক নেই। তাদের কি বিয়ে হয়নি জানতে চাইলে তিনি বলেন, না, তাদের বিয়ে হয়নি। রূপ মিয়াকে তালাক দেয়ার বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ইব্রাহিমকে তালাক দিয়েছে। কিছুক্ষণ আগে বললেন তাদের বিয়ে হয়নি এখন বলছেন মনিরা ইব্রাহিমকে তালাক দিয়েছে। বিয়ে না হলে তালাক দিলো কিভাবে এমন প্রশ্নে তিনি হতভম্ব হয়ে চুপ করে যায়। কিছুক্ষণ পর নিরবতা ভেঙ্গে এক সাংবাদিক মনিরাকে কি তারা রূপ মিয়ার ঘরে আবার পাঠাতে চায় কি না তা জানতে চাইলে শাহজালাল মিয়া বলেন, রূপ মিয়ার ঘরে আমার যেহেতু একটা নাতি আছে তার বাবা দেশে আসলে সে যদি তার বাবাকে বলে বাবা তুমি যদি আমাকে নিতে চাও তাহলে আমার মাকে তোমার ঘরে তুলতে হবে। ছেলে চাইলে তার বাবা তা না করে পারবে না। তাই তারা রূপ মিয়ার দেশে ফেরার অপেক্ষায় আছেন বলে জানান।

এ সময় মনিরার সাথে সাংবাদিকদের কথা বলতে শাহজালাল মিয়া মনিরার ছেলেকে বাড়ির ভিতরে পাঠায়। কিছুক্ষণের মধ্যে মনিরার মা জাহানারা কানে মোবাইল ফোন লাগিয়ে এসে মনিরা বাড়িতে নেই বলে জানায়। এ সময় তার ফোনটি একজন সাংবাদিকের দিকে এগিয়ে দিয়ে তার এক দেবরের সাথে কথা বলতে বলেন। মোবাইল ফোনের অপর প্রাপ্তে কে কথা বলছে জানতে চাইলে আনিসুরজ্জামান নাম বলে পরিচয় দেন তিনি। পরে তিনি ইব্রাহিম টাকার জন্য মনিরার সাথে সম্পর্ক করে এবং তার কাছে জমানো প্রায় ১০ লাখ টাকা সে হাতিয়ে নিয়েছে বলে জানান।

পরে এ বিষয়টি চাঁনপুর ইউপি চেয়ারম্যান বাবলা সরকার ও তার ভাই শরিফ সরকারের কাছে জানতে চাইলে তারা জানায়, মনিরার জমানো টাকা ইব্রহিম হাতিয়ে নেওয়ার কথাটা সত্য নয়। মনিরার স্বামী রূপ মিয়া তার নামে কোনো টাকা-পয়সা পাঠাতেন না। বরং এই আনিসুজ্জামান ও মনিরার ফুফার প্ররোচনায় মনিরা এবং তার মা ইব্রাহিমের টাকা-পয়সাসহ স্বর্ণ গহনা আত্মসাৎ করেছে। পরবর্তীতে ইব্রাহিমকে মনিরার পথ থেকে সরিয়ে দিতে আনিসুজ্জামানের পরামর্শ ও সহযোগিতায় থানায় ধর্ষনের মামলা করেছে বলে ও জানান তারা।

আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড