• সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৪ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

রঙ-সুতার মূল্য বৃদ্ধিতে বন্ধের পথে লাখো তাঁত 

  সোহেল রানা, সিরাজগঞ্জ

১২ জুন ২০২৩, ১১:৩৭
রঙ-সুতার মূল্য বৃদ্ধিতে বন্ধের পথে লাখো তাঁত 
তাঁত কারখানায় কাজ চলছে (ছবি : অধিকার)

সিরাজগঞ্জে ঘন ঘন লোডশেডিং ও রঙ-সুতার দাম বৃদ্ধি কারণে তাঁত কারখানাগুলোতে ধস নেমেছে। ফলে প্রায় এক লাখ তাঁত কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এতে এই পেশার সঙ্গে যুক্ত হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়ছেন।

সুতার বাজারমূল্য বাড়ার সঙ্গে কাপড় উৎপাদনে খরচ বেড়েছে। যার কারণে এই ব্যবসা টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে তাঁত মালিকদের। তাঁত সমৃদ্ধ এই জেলায় তিন লাখ তাঁত কারখানার ইতিমধ্যে এক লাখ কারখানা বন্ধ হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ হ্যান্ডলুম অ্যান্ড পাওয়ার লুম ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা।

আজ রবিবার সকালে সরেজমিনে জানা যায়, ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে কারখানা মালিকেরা ডিজেল চালিত জেনারেটরের সাহায্যে বিদ্যুৎ দিয়ে তাঁত কারখানা সচল রাখার চেষ্টা করলেও ডিজেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় কারখানা সচল রাখা সম্ভব হচ্ছে না। তাঁত মালিকদের বিদ্যুৎ বিলও দিতে হচ্ছে আবার জেনারেটরও চালাতে হচ্ছে। এতে শাড়ি, লুঙ্গি ও গামছা উৎপাদনে অতিরিক্ত টাকা খরচ হচ্ছে তাঁত মালিকদের। এমন পরিস্থিতিতে পড়েছেন তাঁত শিল্পের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকেরা। পরিবার নিয়ে কোনোমতে দিন কাটছে তাদের।

জেলার বেলকুচি, শাহজাদপুর, উল্লাপাড়া, কামারখন্দ, এনায়েতপুর, রায়গঞ্জ, চৌহালী ও কাজীপুরে কম বেশি তাঁত কারখানা রয়েছে। এখানকার উৎপাদিত শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা দেশের বিভিন্ন হাট-বাজারে বিক্রি হয়। উল্লাপাড়া, বেলকুচি, শাহজাদপুর ও এনায়েতপুর, পাঁচিল বাজারে সপ্তাহে দুই দিন কাপড়ের হাট হয়। এই হাটে বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকাররা আসেন। বর্তমানে যে পরিমাণ উৎপাদন হচ্ছে তাও হাট-বাজারে বিক্রি হচ্ছে না। যে কারণে বাধ্য হয়ে অনেকেই তাঁত কারখানা বন্ধ রাখছেন। আবার বর্তমান সুতার বাজারমূল্য যা রয়েছে তাতে কাপড় উৎপাদনে খরচ বেড়েছে। এতে করে এই ব্যবসা টিকিয়ে রাখা এখন কঠিন হয়ে পড়েছে।

তাঁত শ্রমিকেরা জানান, মহাজন কাপড় বিক্রি করতে পারে না, তাই কারখানার শ্রমিকদের কাজে আসতে নিষেধ করা হচ্ছে। আগে সারা দিনে একজন শ্রমিক ৭০০-৮০০ টাকার কাজ করতেন। এখন সারা দিনে একজন শ্রমিক ৩০০-৪০০ টাকার কাজ করছেন। যেখানে ১০ জন শ্রমিক কাজ করতো এখন সেখানে তিনজন শ্রমিক কাজ করছেন। এ অবস্থায় সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে শ্রমিকেরা।

তাঁত মালিকেরা জানান, জেলায় প্রায় তিন লাখ তাঁত কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে এক লাখ কারখানা ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। এসব কারখানা শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা তৈরি হয়। সুতায় রং দেওয়া, শুকানো, সুতা তৈরি ও কাপড় উৎপাদনের জন্য প্রতি তাঁতে ৩-৪ জন শ্রমিক প্রয়োজন। এতে মালিক কর্মচারী মিলে প্রায় চার লাখ শ্রমিক এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত।

বেলকুচি উপজেলার তাঁত মালিক হাজী শাহীন প্রামাণিক বলেন, বর্তমানে আমরা দুর্বিষহ জীবন যাপন করছি। দিনের বেলায় ৩-৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না। এ সময় তেল, ডিজেল দিয়ে জেনারেটরের সাহায্যে কাপড় উৎপাদন করতে গেলে প্রচুর খরচ বেড়ে যায় এবং শ্রমিক থাকে না।

তিনি আরও বলেন, বর্তমানে কাপড় ব্যবসায়ীরা লোকসানে রয়েছে। এর পর শ্রমিক সংকট রয়েছে। শ্রমিকের অভাবে কাপড় উৎপাদন করা যাচ্ছে না।

সাউথ এশিয়া হাইটেক সাটেল ইন্ডাস্ট্রিজ এর ম্যানেজার (আমদানি-রপ্তানি) অনিমেষ সরকার বলেন, বর্তমানে তাঁত শিল্পে শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। আমাদের ৪০টি তাঁত মাত্র দুজন শ্রমিক কাজ করছে। আমাদের লুঙ্গি উৎপাদন হচ্ছে না শ্রমিকদের বেতন দেব কি করে। প্রতি সপ্তাহে শ্রমিকদের ঠিকই বেতন দিতে হচ্ছে। শ্রমিকেরা না আসার করন হচ্ছে তাদের মজুরি বাড়াতে হবে। কিন্তু বাজারে রঙ-সুতার যে দাম তাতে উৎপাদন খরচ উঠছে না, ফলে মালামাল বিক্রি করতে পারছি না। শ্রমিকদের মজুরি কীভাবে বাড়াব।

বেলকুচি লাকী সেভেন কটেজের মালিক মনিরুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে তাঁতের দুর্দিন চলছে। তাঁত প্রায় বন্ধের পথে। সুতার দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। সে তুলনাই কাপড়ের দাম বাড়েনি। শ্রমিকদের ঠিকমতো বিল দিতে পারি না। এই শিল্পের ওপর সরকারের নজর নাই। সরকারের কাছে দাবি এই তাঁত শিল্পকে বাঁচাতে হলো রঙ-সুতাসহ সকল কাঁচামালের দাম কমানোর। তাহলে এই শিল্পকে বাঁচানো সম্ভব।

উপজেলার তামাই গ্রামের শ্রমিক শাহ আলম বলেন, তাঁত শিল্পের অবস্থা ভালো না। ইদের আগ থেকেই মহাজনের কেনাবেচা ভালো না। মহাজন কাপড় বেচতে পারে না এ জন্য কারখানার শ্রমিকদের কাজে আসতে নিষেধ করেছে। প্রতিদিন ৭০০-৮০০ টাকা কাজ হয়েছে। এখন ৩০০-৪০০ টাকা হয় না। বিল চাইলে কয় কাপড় বেচতে পারি নাই। আমরা কি করি। কীভাবে সংসার চলে।

আরেক তাঁত শ্রমিক শহিদুল ইসলাম জানান, যে কারখানায় কাজ করেন, সেখানে ৩০টি তাঁতের বেশিরভাগই বন্ধ হয়ে গেছে। বেকার হয়ে পড়েছেন অনেক শ্রমিক। মাত্র কয়েকজন শ্রমিক এখন ১০টি তাঁত চালাচ্ছেন। তবে ইদের পরে বাকি তাঁতগুলোও বন্ধ হয়ে যাবে। তাঁতগুলো বন্ধ হয়ে গেলে বেকার হয়ে পড়ার পর কীভাবে সংসার চালাবেন, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন এই দরিদ্র তাঁত শ্রমিক।

বাংলাদেশ হ্যান্ডলুম অ্যান্ড পাওয়ার লুম ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের জেলা শাখার সভাপতি হাজী বদিউজ্জামান বলেন, এই জেলাকে তাঁত কুঞ্জু হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। জেলায় ৩ লাখ তাঁত রয়েছে। এই তাঁতে আমরা শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা তৈরি করে থাকি। করোনার সময় তাঁতের ব্যবসার অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পরবর্তীকালে আশা ছিল আমাদের ব্যবসাটা ভালো হবে। কিন্তু করোনার পরে তাঁত শিল্পের জন্য যে সমস্ত কাঁচামাল রয়েছে রঙ, সুতা, তুলা সবকিছুর দাম দ্বিগুণ হয়েছে। যার কারণে কাপড় উৎপাদনে খরচ বেড়েছে। এটি একটি বড় সমস্যা।

অনেক শ্রমিক ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় চলে গেছে। অনেকে দেশের বাহিরেও চলে গেছে। যে কারণে শ্রমিক সংকট চলছে। আরেকটি কারণ রয়েছে ঘন ঘন লোডশেডিং। বিদ্যুতের সমস্যা। জেনারেটর দিয়ে তাঁত চালাইতে গেলে দেখা যায় এক লিটার তেলের দাম ১১০ টাকা। জেনারেটর দিয়ে কাপড় উৎপাদন করতে গেলে খরচ বেশি হচ্ছে। যে কারণে কাপড় উৎপাদন করতে পারছিনা।

সবকিছু মিলেই আজ তাঁত শিল্প ধ্বংসের পথে। জেলায় তিন লাখ তাঁতের মধ্যে এক লাখ তাঁত বন্ধ হয়ে গেছে। এর মূল কারণ শ্রমিক সংকটও কাঁচা মালের দাম বেশি। সরকার যদি তাঁত শিল্পকে বাঁচাতে চায় তাহলে তাঁত মালিকদের জন্য একটি তাঁত ব্যাংক করা প্রয়োজন। এই ব্যাংকের মাধ্যমে তাঁতিদের স্বল্প সুদে তাঁত লোণ দেওয়া হয় তাহলে এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব। না হলে এই শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে।

বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড বেলকুচি-চৌহালী উপজেলার লিয়াজোঁ অফিসার তন্বী হোসেন বলেন, আমরা তাঁতিদের স্বাবলম্বী করতে তাদের লোণ দিয়ে থাকি। আগে আমাদের লোণ ছিল ১৩ হাজার টাকা। এখন আমরা সেই লোণ বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ দুই লাখ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত লোণ দিচ্ছি।

তিনি আরও বলেন, ১৯টি তাঁত যাদের আছে তারা প্রান্তিক তাঁতি। তাদের জন্য আমরা লোণের ব্যবস্থা করেছি। তাঁতিদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। দুর্যোগ সময়ে তাদের সহযোগিতা করে থাকি।

আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড