আবু সালেহ মুছা, শিবচর (মাদারীপুর)
পদ্মা সেতুর বিভিন্ন প্রকল্প থেকে ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে সরকারের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে মাদারীপুর জেলা প্রশাসন থেকে ২০ জন দালালের একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে।
তারা হচ্ছেন- মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার দত্তপাড়া ইউনিয়নের বাচামারা গ্রামের কেএম নাসির (নাসির কাজী), মাদবরচর ইউনিয়নের বাখরের কান্দি গ্রামের শেখ ফরিদ, একই এলাকার মিজানুর রহমান বাবু মোল্লা, বাখরকান্দি এলাকার লিটু খলিফা, কাঁঠালবাড়ি ইউনিয়নের দোতারা গ্রামের বাহাদুর হাওলাদার, বাংলা বাজার শিকদারকান্দি গ্রামের লাক্ষু আকন, দত্তপাড়া ব্রিজপাড় এলাকার রায়হান, মাদবরচর ইউনিয়নের ডাইয়ারচর এলাকার শামীম ফরাজি, মাদবরেরচর ইউনিয়নের রিপন মোল্লা, শিবচরের আহসানুল হক বাবুল, শিবচরের ইউসুফ মাদবর, বাহাদুর মোল্লা, পাচ্চর এলাকার আমির, দুলাল, শরীয়তপুর জেলার জাজিরা উপজেলার বিকে নগর এলাকার হুমায়ন ঢালী, এমদাদ মাদবর, নাওডোবা গ্রামের রিপন ঢালী, মাদারীপুর সদরের ফারুক সড়কের গিয়াস শিকদার, ডিসি অফিসের সামনের দোকানদার রেজাউল হাওলাদার ও মাদারীপুর পৌরসভার জাকির হাওলাদার।
এসব দালালদের অনুসন্ধানের জন্য তালিকা ইতোমধ্যেই দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) পাঠানো হয়েছে।
এ দিকে গত ১৮ জানুয়ারি মাদারীপুর সদর থানায় একটি প্রতারণার মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নেওয়ায় একটি মামলা দায়ের করা হয় জেলা প্রশাসকের নির্দেশে। ওই মামলায় ১ কোটি ৮৮ লক্ষ টাকা প্রতারণা করে হাতিয়ে নেওয়ার দায়ে শাহিন বেপারী ওরফে সাহেব পুড়া নামে একজন বর্তমানে জেলে রয়েছেন। তবে ওই মামলার অন্য আসামিরা এখনো রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
তালিকাভুক্ত ২০ জন দালালের মধ্যে শরিয়তপুরের জাজিরা উপজেলার বিকেনগর ইউনিয়নের হাওলাদারকান্দি গ্রামের আবদুল হক ঢালীর ছেলে হুমায়ুন ঢালী। ৫ বছর আগেও জাজিরা উপজেলার কাজির হাটসহ কয়েকটি হাটে ছাগল বিক্রির দালালীর পাশাপাশি জমিতে ট্রাক্টর চালিয়ে হাল চাষ করতেন।
দরিদ্র পরিবারের ও দিনমজুরের সন্তান হুমায়ুনে এক সময় নিজের ভিটেমাটি ছাড়া আর কোনো জমি ছিল না। গত ৫ বছরের হয়েছেন কোটি কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক। নিজের নামে কোটি কোটি টাকার জমি ক্রয়েরও খবর পাওয়া গেছে। মাত্র কয়েক বছরে আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়া হুমায়ুন এখন মাদারীপুর ও শরিয়তপুর জেলার টক টপিক্সে পরিণত হয়েছে।
সরেজমিনে নাওডোবা-জাজিরা আঞ্চলিক সড়কের বিকেনগর ইউনিয়নের দৈনিক বাজার এলাকায় হুমায়ন ঢালীর বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, সেখানে পাঁচতলা বিশিষ্ট অট্টালিকা নির্মাণাধীন রয়েছে। ইতোমধ্যে দুই তলার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়াও অতিরিক্ত বিল উত্তোলন করার উদ্দেশ্য তার বাড়িতে টিনের ৫টি চৌচালা ঘর উত্তোলন করা হয়েছে।
এ দিকে স্থানীয়দের সাথে কথা বলে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে। তার মধ্যে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০ সালে বিকেনগর এলাকার চান মিয়া শেখের নিকট থেকে ২২ শতাংশ জমি ক্রয় করেন। যার দলিল নং ৮০১/২০। গত ৯ জুন ২০২০ সালে একই এলাকার জ্বলিল শিকদারের নিকট থেকে ১৬.৫ শতাংশ জমি ক্রয় করেন যার দলিল নাম্বার ১২৮৭/২০।
গত ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০ তারিখে একই এলাকার দানেছ শেখের নিকট থেকে ২১ শতাংশ জমি ক্রয় করেন যার দলিল নং ৬৬৩/২০। গত ৬ আগস্ট ২০১৯ তারিখে একই এলাকার আবদুল জ্বলিল শিকদারের নিকট থেকে ১৬.৫ শতাংশ জমি ক্রয় করেন যার দলিল নং ৩১২৩/১৯।
এছাড়াও হুমায়ূন ঢালীর নিজ নামে ক্রয় করা জমি বিক্রেতা জাকির শিকদার বলেন, আমি গত দেড় দুই বছর আগে দুইটা জমি হুমায়ূন ঢালীর নিকট বিক্রি করেছি। জমির পরিমাণ একটা ৪ কাঠা, অন্যটি ৫ কাঠা। একটি ২৩ লক্ষ টাকা, অন্যটি ৫ লক্ষ টাকা। হঠাৎ শুনি হুমায়ূন ঢালী অনেক জমি কিনতেছে। তখন তার কাছে জমি বিক্রি করেছি। শুনেছি ব্রিজের ওখান থেকে (পদ্মা সেতু) টাকা কামাই করছে। মানুষের বিল নাকি কি করে নিয়ে গেছে। কেমনে কি করছে তা জানি না।
আরেক জমি বিক্রেতা ইদ্রিস হাওলাদার বলেন, আমি ৭ শতাংশ ও আমার চাচা ২০ শতাংশ জমি হুমায়ূন ঢালীর নিকট বিক্রি করেছেন। ১ লক্ষ ৪০ হাজার টাকা করে শতাংশ দাম দিয়েছে। হুমায়ুন ঢালী আগে সংসারী কাজ করতো। কোথায় এত টাকা পেলো তা জানি না। সে ৫/৬ বিঘা জমি কিনেছে জানি।
এ দিকে পদ্মা সেতুর জাজিরা পয়েন্টের নাওডোবা গোলচক্কর থেকে শরিয়তপুর সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় তিনটি প্যাকেজে ২৭ কিলোমিটার সড়ক চার লেন, ২৭টি কালভার্ট ও ২টি সেতু নির্মাণ করা হচ্ছ। প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ হাজার ২৩১ কোটি ১৮ লাখ টাকা ধরা হয়েছে জমি অধিগ্রহণে। আর এই ক্ষতিপূরণের টাকা দিচ্ছে শরীয়তপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে। নাওডোবা থেকে শরিয়তপুর পর্যন্ত সড়ক চার লেন করার প্রকল্প অনুমোদন পাওয়ার পর থেকেই দুই পাশে স্থাপনা নির্মাণের হিড়িক পড়েছে।
ডিসি অফিসের এলএ শাখার কর্মকর্তা কর্মচারীদের যোগসাজশে গড়ে তোলা হয়েছে সুযোগ সন্ধানী একটি প্রতারক ও প্রভাবশালী দালাল চক্র। তাদের উদ্দেশ্য একটাই সরকারের কোটি কোটি টাকা কৌশলগতভাবে প্রতারক ও প্রভাবশালী দালাল চক্র দের মাধ্যমে ভাগ বাটোয়ারা করে নেওয়া।
স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, সড়ক প্রশস্ত করতে উভয় পাশেই জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে। ক্ষতিপূরণ হিসেবে বেশি অর্থ হাতিয়ে নিতে এসব স্থাপনা নির্মাণ করছে একটি দালাল চক্র। এ জন্য রাতারাতি তোলা হচ্ছে ঘর। লাগানো হচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির চারাগাছ। নির্মাণ করা হচ্ছে কারখানা ও খামার।
সড়কের উভয় পাশেই দেখা গেছে নির্মাণাধীন পাকা, আধা পাকা ও টিনশেডের বসতঘর, দোকান, করাতকল, মাছ, মুরগি ও গরুর খামার।
এই ব্যাপারে বিকেনগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হাজী ইস্কান্দার আলী ভূঁইয়া বলেন, আমি দীর্ঘদিন বিদেশে ছিলাম। গত এক বছর আগে দেশে এসে নির্বাচন করে চেয়ারম্যান হয়েছি। হুমায়ন ঢালীকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। ৫ বছর আগেও নিম্ন ফ্যামিলির ছিল তারা। এখন অর্থবিত্ত প্রতাপশালী হয়েছে। তবে কিভাবে এত টাকা পয়সা, অর্থবিত্ত হইলো, কি ব্যবসা করে, তা আমার জানা নাই। আমি জানি ৫/৭ বছর আগে এমনিই কৃষি কাজ করতো।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে আমাদের সাথে রাজনীতিতে জড়িত সে। তাকে কোনো পদ দেওয়া নাই। নির্দিষ্ট কোনো ব্যবসা নাই তার। এখন আবার দুবাই যাওয়া আসা করে।
স্থানীয় খোকন হাওলাদার বলেন, হুমায়ুন ঢালী আমার পরিচিত, আমাদের পাশেই বাড়ি। ছোট থেকে একত্রেই বড় হয়েছি। ওরে ৪ বছর আগেও মেশিন (পাওয়ার টিলার) চালাইতে, কৃষি কাজ করতে দেখেছি। কাজীর হাটে বকরী ছাগলের দালালী করতে। হঠাৎ করেই দেখি ও অনেক জমিজমা কিনেছে। অনেক বড় বিল্ডিং করছে।কদিন আগে টিভিতে দেখেছি মাদারীপুরের ডিসি তার নামে দুদকে একটা মামলা দিয়েছে।
হুমায়ুন ঢালীর মেয়ে ফাতেমা আক্তার (১৯) এর নিকট তার বাবার এত অর্থ সম্পদের উৎস সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার বাবা দুবাইতে অন্যরকমের ব্যবসা, যেমন, সাবান শ্যাম্পু, কসমেটিক্স এর ব্যবসা করেন।
হুমায়ূন ঢালীর মা জমিলা খাতুন বলেন, হুমায়ন আগে মেশিন (পাওয়ার টিলার) চালাইছে, ধান পান ভাঙাইছে। আমার বাবার কালের জায়গা জমির টাকা পয়সা পাইছি ২০ লক্ষ। অন্য ছেলেদেরসহ হুমায়ূনকে সেই টাকার ভাগ দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন তিনি।
এই ব্যাপারে হুমায়ূন ঢালীর বক্তব্য নিতে তার বাড়িতে গেলে তিনি পরিচয় গোপন করে কৌশলে সটকে পরেন। পরে তাকে ফোন করা হলে তিনি বিভিন্ন ব্যস্ততা দেখিয়ে বলেন, আমি বিদেশে ছিলাম, বর্তমানে দুবাই থেকে কসমেটিক্সের ব্যবসা করি। ব্যবসার লাইসেন্স নেই, তবে এয়ারপোর্টে ট্যাক্স দিই। আমার নানার কালে ৫০ বিঘা জমির বিল পেয়েছি। বাবার কালের দেড় কোটি টাকার জমি বিক্রি করেছি আমরা চার ভাই। আমি কোনো জমি কিনিনাই।
সদ্য নির্মিত তার এত বড় অট্টালিকা বাড়ি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার বাড়ি আমার বাবা করে রেখে গেছেন। আমার বাবা মারা গেছেন ৭ বছর আগে। বাবা একজন কৃষক ছিলেন। আপনি আমার সাথে সাক্ষাৎ করে কথা বইলেন, এগুলো সব মিথ্যা কথা। এসব বলেই ফোনের সংযোগ কেটে দেন হুমায়ুন।
এ বিষয়ে শরিয়তপুর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) সাইফুদ্দিন গিয়াস বলেন, আমাদের এখান থেকে কোনো ধরনের অনৈতিক কাজ করার সুযোগ নেই। দালালদের তালিকা পেলে প্রয়োজনে আমাদের অফিসে টাঙিয়ে রাখা হবে। কেউ যাতে অনৈতিক সুবিধার না নিতে পারে তার জন্য আমরা প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
মাদারীপুর পুলিস সুপার মাসুদ আলম বলেন, নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তি নয় আমরা সবার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করব। যারা রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাৎ করেছে তাদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলমান রয়েছে। আমরা তদন্তপূর্বক সবার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেব।
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড