নাজির আহমেদ আল-আমিন, ভৈরব (কিশোরগঞ্জ)
কিশোরগঞ্জের বন্দর নগরী ভৈরব উপজেলার কালিকা প্রসাদ গ্রামের আদি কারিগর মৃত ইব্রাহীম মিয়ার হাত ধরেই, ১৯৯৫ সাল থেকে ভৈরবে এ পাদুকা শিল্পের যাত্রা শুরু। পুরাণ ঢাকা থেকে জুতার কারখানা নিজ এলাকায় স্থানান্তরের মাধ্যমে ভৈরবে প্রথমে ব্যবসা শুরু করেন তিনি।
ঢাকায় উৎপাদন ব্যয় বেশি ও চাঁদাবাজির হাত থেকে রক্ষায় ভৈরবে কারখানা স্থানান্তর হলেও ক্রমেই তা বড় হয়ে আজ ঢাকাকে ছাড়িয়েছে বহু বছর আগে। নিপুণ হাতের তৈরি এসব পাদুকার চাহিদা রয়েছে দেশের বিভিন্ন জায়গায়।
বর্তমানে উপজেলার কমলপুর, শম্ভুপুর, শিবপুর, গজারিয়া ও কালিকা প্রসাদে প্রায় ১০ হাজারের অধিক কারখানায় ও পাদুকার নানা উপকরণ বিক্রির ব্যবসাসহ প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষ এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত। ছয়টির মতো বৃহত্তর পাইকারি মার্কেট এবং ৫০টিরও বেশি পাদুকা শিল্প পল্লী নিয়ে এখানে গড়ে উঠেছে একটি বড় কর্ম ও অর্থনৈতিক বলয়। যার উন্নতির সঙ্গে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতিও জড়িত বলে সংশ্লিষ্টদের অভিমত।
ইদ উপলক্ষে রমজান মাসে পাদুকা শিল্পের উৎপাদন ও বিক্রি নিয়ে সব চেয়ে বেশি ব্যস্ত থাকেন এখানকার সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা। পাদুকা শিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা এই মৌসুমের আয় দিয়ে সারা বছর জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। কিন্তু এবারের প্রেক্ষাপট ভিন্ন।
কারখানার মালিকরা বলছেন- দেশে করোনা পরিস্থিতির পর গত বছর ভাল ব্যবসা করলেও এবছর গত বছরের তুলনায় পাদুকা শিল্পের উপকরণ চামড়া, রেক্সিন, ফোম, হিল, কভার, পেস্টিং, সুতা, বোতাম, সলিউশন ইত্যাদি পণ্য আমদানি বন্ধের অজুহাত ও ব্যবসায়ী সেন্টিকেটের কারণে বাজারে এসব পণ্যের দাম বেড়েছে দুই থেকে চার গুণ। ফলে জুতা তৈরিতে খরচ আগের তুলনায় অনেক বেশি লাগছে। যার ফলে পাদুকার প্রচুর চাহিদা থাকা সত্ত্বেও উপকরণের মূল্যবৃদ্ধির কারণে তারা চাহিদা মতো উৎপাদন করতে পারছেন না।
ফলে হাতের পাইকার ধরে রাখতে পারছেন না তারা। আর ভরা মৌসুমে পাইকারের চাহিদা মতো সরবরাহ না দিতে পারলে, সেই বিমুখ পাইকারের কাছে আর বিক্রি করা যাবে না। আগের বকেয়াও আদায় করা যাবে না। শ্রমিকদের পাওনাও মেটানো যাবে না।
এ শিল্পের সাথে জড়িতরা আরও জানান, জুতা তৈরির উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়া, ইন্ডিয়ান ও চায়না পাদুকার আগ্রাসনে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এ শিল্প।
গোধূলি সিটির এলাকার পায়ে পায়ে সুজ কারখানার মিস্টু মিয়া জানান, গত দুই বছরে যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে চলতি বছর কারখানায় পাদুকা উৎপাদন চলছে। তবে পাদুকা তৈরির উপকরণের দাম যে হারে বেড়েছে সে তুলনায় জুতার দাম বাড়েনি। ফলে বেচা-বিক্রি নিয়ে কিছুটা দুশ্চিন্তাও কাজ করছে।
হাজি ফুল মিয়া মার্কেটের টপ সুজের মালিক জিয়া রহমান বলেন, চায়না থেকে আসা চায়না কাঁচামাল ও প্রোডাক্টের কারণে আমাদের বাংলা মালের অবস্থা বেশী ভাল না। খরচে আগানো যায় না। আগে যেই আশা করেছিলাম সেই অনুযায়ী আমরা এখন লসের মধ্যে পরে গেছি। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত আমাদের মতো ছোট ব্যবসায়ীরা। ‘গত দুই-তিন বছর করোনা ভাইরাসের প্রভাবে ভৈরবের পাদুকা শিল্পেরও বিশাল ধস নামে। করোনা পরবর্তী এই মৌসুমে প্রচুর চাহিদা সত্ত্বেও বিভিন্ন উপকরণের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ঠিক মতো উৎপাদন করতে পারছে না।
ময়মনসিংহ থেকে জুতা কিনতে এসেছেন পাইকারি ব্যবসায়ী আব্দুল হাই। তিনি বলেন, প্রতি বছরই ইদের মৌসুমে ভৈরবের জুতা কিনতে আসি। এখানকার উৎপাদিত জুতা খুবই উন্নতমানের এবং দেশব্যাপী এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তবে এ বছর জুতার দাম বেশি।
মুসলিমের মোড় এলাকার কারখানা মালিক সবুজ মিয়া বলেন, বিভিন্ন আমদানির অজুহাতে সব উপকরণের মূল্য ৮০ থেকে ১০০ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু বাজারে জুতার মূল্যতো সে অনুযায়ী বৃদ্ধি পায়নি। ফলে আমরা উৎপাদন ব্যয় আর বিক্রি নিয়ে বিপাকে পড়েছি।
এ দিকে মজুরি নিয়ে জানতে চাইলে গোধূলি সিটি এলাকার কারখানা শ্রমিক রুবেল, বশির, ফুলমিয়া পাদুকা এলাকার বিল্লাল মিয়া ও ময়না বেগম জানান, তাদের মজুরি দুই-তিন বছর আগে যেমনটি ছিল, এখনও তেমনটিই আছে। সারাদিন কাজ করে মজুরি পাই ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে কয়েকগুণ অথচ সংসারে বাজার খরচ লাগে ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা। স্বল্প মজুরি দিয়ে সংসার চালাতে আমাদের জীবনযাপন বড়ই কষ্টের হয়ে পড়েছে।
ভৈরব পাদুকা কারখানা মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. সবুজ মিয়া বলেন, এ বছর জুতা তৈরির উপকরণের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। ফলে প্রতিটি জুতা তৈরিতে উৎপাদন খরচ দুই থেকে চার গুন বেড়ে যাচ্ছে। এ কারণে জুতা বিক্রি কমে গেছে। এছাড়া জুতা তৈরির উপকরণের মূল্যবৃদ্ধির জন্য আমদানিকারক সিন্ডিকেটরাও এর জন্য দায়ী। আমরা দাম বাড়ার কারণে ব্যবসা নিয়ে হতাশ হয়ে পড়েছি। এই পাদুকা শিল্পে অনেক শ্রমিক কাজ করে তাই এই শিল্পকে বাঁচানোর জন্য সরকারের সহযোগিতা কামনা করছি।
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড