মো. রেজোয়ান ইসলাম, নীলফামারী
যেখানে মাটির সঙ্গে মানুষের নাড়ির সম্পর্ক। অথচ ভাগ্যের পরিবর্তন হচ্ছে না সেই মানুষ গুলোর। উপযুক্ত মাটি সংকট, প্রয়োজনীয় পুঁজি ও পরিকল্পিত উদ্যোগের অভাবে অস্তিত্ব সংকটে নীলফামারীর মৃৎশিল্পীরা। এছাড়া উৎপাদিত পণ্য সামগ্রীর ন্যায্য মূল্য না থাকায় বিপাকে পড়েছে এ শিল্পে জড়িতরা।
সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। দিশাহারা হয়ে পড়েছে জেলার ২৩০টি কুমার পরিবার। ফলে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন এই মানুষগুলো। তবুও মৃৎশিল্পের সঙ্গে জড়িতরা তাদের কর্মদক্ষতার দ্বারা এই শিল্পটাকে আঁকড়ে ধরে এখনও বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে এগিয়ে চলছেন।
সরেজমিন দেখা যায়, মাটি দিয়ে খুঁটি, হাঁড়ী, পাতিল, সারোয়া, কলস, শ্লিম, পেঁচি, ব্যাংক, প্লেট, রুটি বানা তাওয়া, চারি, কান্টা, ফুলের টপ, থালা, খেলনা- কী না তৈরি হয় নীলফামারী সদরের সোনারায় ইউনিয়নের উত্তর মুসরত কুকাপাড়া গ্রামে। নীলফামারী জেলা শহর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে সদরের সোনারায় ইউনিয়নের উত্তর মুসরত কুকাপাড়া গ্রাম। ওই গ্রামের প্রায় ৬৫ পরিবার ঐতিহ্য ধরে জীবন ও জীবিকার তাগিদে মৃৎশিল্পকে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন।
এছাড়াও জেলায় বিচ্ছিন্নভাবে ২৩০ পরিবার এই পেশায় জীবন যাপন করে। কিন্তু মাটির অভাব, প্রয়োজনীয় পুঁজি ও পরিকল্পিত উদ্যোগের অভাবে চরম অস্তিত্ব সংকটে নীলফামারীর মৃৎশিল্পীরা।
উৎপাদিত পণ্য সামগ্রীর ন্যায্য মূল্য না থাকায় এই শিল্পের সাথে জড়িতরা অন্য পেশায় যেতে বাধ্য হচ্ছেন। এত কিছুর পরও তারা তাদের পূর্ব পুরুষদের এই পেশা আঁকড়ে ধরেই কম বেশি যা আয়-রোজগার করছেন তার মাধ্যমে পরিবারসহ টিকে আছেন তারা। তাদের অধিকাংশ পরিবারেরই মাঠে আর কোনো চাষযোগ্য জমি নেই। বসতভিটার মাত্র দু-এক কাঠা জমিই যেন শেষ সম্বল।
বাড়ির উঠানে কিংবা পাশে ফাঁকা জায়গায় বসে মাটি দিয়ে বিভিন্ন প্রকার পণ্য সামগ্রী তৈরি করছেন গ্রামের মানুষ। একাধিক বাসিন্দা জানালেন, সকাল থেকে শুরু হয় ওইসব জিনিস তৈরির কাজ। এরপর রোদে শুকানো ও রং তুলির সাহায্যে সৌন্দর্য বাড়ানো হয়। নারী পুরুষরা সমান তালে একাজ করেন। সাধ্যমতো সহযোগিতা করে ছেলে-মেয়েরাও।
বাড়ির উঠানে বসে কাজ করছিলেন কারিগর নমিতা পাল। তিনি বলেন, বাপ দাদার হাতে এসব শিখছু। এখন স্বামীর সংসারে ২১ বছর ধরি এই কাম করি। স্বামী, বেটি দুইটা, বেটা একটা ওমরাও এই কামই করে। তাও সংসার চলে না।
খগেন্দ্র পাল নামে আরেক কুমার বলেন, প্লাস্টিকের ভাড়া পাতিল বের হয়ে হামার মাটির জিনিস কেউ নেয় না। বছরে একবার পহেলা বৈশাখ, হিন্দুর বিয়া বাড়ী ও বিভিন্ন পূজার সময় একটু বেচাকেনা হয়। অন্য সময় তাও হয় না। এক সময় এই ব্যবসার যথেষ্ট কদর ছিল। বাড়ীতে এসে পাইকাররা বায়না দিয়ে যেত। এখন আর সেই দিন নাই। আগে কামাই খুব হইত। কিন্তু এখন পেটে চলে না।
একই গ্রামের মৃৎশিল্পী বিকাশ চন্দ্র পাল বলেন, পুরুষদের প্রধান কাজ মাটি কিনে সেগুলো কাঁদা করা ও ভাটায় পোড়ানো। এরপর এসব সামগ্রী নিজ হাতে তৈরি করেন বাড়ীর নারী ও ছেলেমেয়েরা। আর এসব তৈরি সামগ্রী বাজারে বিক্রি করি আমরা। কিন্তু দিন দিন চাহিদা কমে যাওয়ায় এখন হাত পড়েছে কপালে।
জেলা শহরের ওইসব সামগ্রী বিক্রি করতে এসে কৈলাস চন্দ্র পাল বলেন, মাটির তৈরি হাঁড়ি, পাতিল, কলস, সারোয়া, পেঁচি, তাওয়ার এক সময় খুব চাহিদা ছিল। বাজারে আসার সাথে সাথে ক্রেতা সামলাই যেত না। এখন হাটে আসা যাওয়া ভ্যান ভাড়াই উঠে না। আগে গরমে পানি রাখার একটি কলস বিক্রি হতো ৩০-৪০ টাকা। এখন ফ্রিজ বের হয়ে কলসের কোন চাহিদা নাই। হঠাৎ এক-আধটা বিক্রি হয়, তাও পানির দামে দিতে হয়।
সদর উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের কর্মকর্তা মঞ্জুর মোর্শেদ তালুকদার দৈনিক অধিকারকে বলেন, কুমারপাড়ার ওই পরিবার গুলো বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করায় তাদের কোন সমবায় সমিতি নাই। তাদের এক জায়গায় করে সমবায় সমিতির মাধ্যমে সহযোগিতা করা যেতে পারে। প্ল্যাস্টিকের উৎপাদিত পণ্যের কাছে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে মৃৎ শিল্প।
বিসিক জেলা কার্যালয়ের ব্যবস্থাপক হোসনে আরা খাতুন দৈনিক অধিকারকে বলেন, এ শিল্পের লোকজনদের সমিতির মাধ্যমে আর্থিকভাবে সহায়তা করা যেতে পারে। তবে আধুনিকতার ছোঁয়ায় মাটির তৈরি জিনিসপত্রের আদলে তৈরি করছেন প্লাস্টিক পণ্য নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান। ফলে প্রতিনিয়ত ব্যবহার কমছে মাটির তৈরি পণ্য সামগ্রীর। এতে বিপাকে পড়েছে এই শ্রেণি-পেশার মানুষ। আমাদের শর্ত পূরণের মাধ্যমে তাদের সহযোগিতা করা যেতে পারে।
এ প্রসঙ্গে অনেকটা আশায় প্রদীপ জ্বালিয়ে জেলা প্রশাসক পঙ্কজ ঘোষ বলেন, মৃৎশিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারিভাবে কোনো ধরনের সহায়তার সুযোগ থাকলে তা অবশ্যই করা হবে। এটি গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য আর ওই ঐতিহ্য ধরে রেখেছে মৃৎশিল্পীরা।
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড