• বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৬ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

জনবল সংকটের মাঝেও চলছে ১০০ কোচের মেরামত

জোড়াতালি দিয়ে ইদযাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছে রেলওয়ে

  মো. রেজোয়ান ইসলাম, নীলফামারী

০৬ এপ্রিল ২০২৩, ১৬:১৮
জোড়াতালি দিয়ে ইদযাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছে রেলওয়ে
পুরাতন কোচের মেরামত কাজ চলছে (ছবি : অধিকার)

চাহিদার মাত্র ২০ শতাংশ জনবল, বাজেট স্বল্পতা, উপকরণ সরবরাহসহ বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে এবারের ইদযাত্রায় ১০০টি কোচ মেরামতে ব্যস্ত সময় পার করছে নীলফামারী সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার শ্রমিকরা। যেখানে রয়েছে ৮৩টি ব্রডগেজ ও ১৭টি মিটার গেজ কোচ। অল্প সংখ্যক জনবল নিয়ে ব্যাপক চাপের মধ্যে নষ্ট ও চলাচল অযোগ্য বগিগুলোকে সচল করে তুলছেন কারখানার শ্রমিক-কর্মচারীরা। চরম কর্মব্যস্ততায় সময় কাটছে তাদের।

রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানায় পুরনো ট্রেনকে নতুন করার কাজ চলে আসছে ব্রিটিশ আমল থেকে। ব্রিটিশ সরকার ১৮৭০ সালে সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানাটি স্থাপন করে। সেই সময় সৈয়দপুর কারখানায় কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শ্রমিকের সংখ্যা ছিল প্রায় ১০ হাজারের মতো। ধীরে ধীরে জনবল কমে যাওয়ার পরও এ কারখানায় প্রতিদিন একটি কোচ ও একটি ওয়াগন মেরামত করা হয়। এছাড়াও রেলওয়ের নানা ধরনের যন্ত্রাংশ তৈরি করা হয় এখানে। প্রয়োজনের মাত্র ২০ শতাংশ জনবল নিয়ে কাজ হচ্ছে কারখানাটিতে। কারখানার যান্ত্রিক শাখায় দুই হাজার ৮৫৯ জনবলের বিপরীতে কর্মরত রয়েছেন মাত্র ৬২১ জন।

সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার জিওএইচ, উৎপাদন মেশিন শপ, ক্যারেজ শপ, হুইল শপ, বগি শপ ও সিএইচআর শপ ঘুরে দেখা গেছে, চলছে নষ্ট হয়ে যাওয়া বগি মেরামত। কেউ ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ, কেউবা ব্যস্ত চাকা মেরামতে। আবার কেউ ওয়েল্ডিং ও কোচের সিট মেরামতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। কোথাও আবার মেরামত করা বগিকে নতুন করে রং লাগিয়ে চকচকে করে তোলা হচ্ছে। যেন দম ফেলার সময় নেই তাদের। তীব্র জনবল সংকটের মধ্যেও সেবার ব্রত নিয়ে কাজ করছেন শ্রমিকরা। তাদের অভিযোগ- পর্যাপ্ত জনবল ও কিছু সংখ্যক কাঁচামালের অভাবে পুরো কর্মযজ্ঞ কিছুটা বাধাগ্রস্ত।

মেরামতকৃত এসব কোচ ঈদের বিশেষ ট্রেনগুলোতে সংযুক্ত করা হবে। রেলবহরে বাড়তি কোচগুলো যুক্ত হলে ঈদে ঘরমুখো মানুষের যাত্রাপথের ভোগান্তি কিছুটা হলেও লাঘব হবে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে শুরু করে বিকেল ৪টা পর্যন্ত কাজ চলছে কারখানার ২৪টি বিভাগে। ইতোমধ্যে প্রস্তুত হওয়া ৭০টি বগি চলে গেছে রেলওয়ের পাকশী ও লালমনিরহাট রেলওয়ে বিভাগের কাছে।

ক্যারেজ শপের ওয়েল্ডিং মিস্ত্রি সুবাহান আলী দৈনিক অধিকারকে বলেন, ঈদুল ফিতর উপলক্ষে আমাদের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে গাড়ির যাবতীয় কাজ করছি। অচল গাড়িকে আমরা সচল করে থাকি। আমাদের কাজের পরিমাণ বেড়ে গেছে, আগে যে পরিমাণ আউটটার্ন যেতো তার দ্বিগুণ দেওয়া চেষ্টা করছি। অল্প পরিমাণ লোক আমাদের কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে খুব আন্তরিক। আমাদের ওভারটাইম, হলিডেসহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দিয়ে আউটটার্ন নেওয়া চেষ্টা করছে আমরাও চেষ্টা করছি আউটটার্ন দেওয়ার। আমাদের কষ্টের বিনিময়ে মানুষ শান্তিমত ঈদ করতে পারবে, ঘরে ফিরতে পারবে এটাই আমাদের সফলতা।

পেইন্ট শপের বাবু লাল দৈনিক অধিকারকে বলেন, আমি কালো রংয়ের কাজ করি, গাড়ির বডিতে যত কালো রং আছে সব আমি আরও পাঁচজন মিলে করি। আর ঈদের সময় যে কাজের চাপ থাকে তা আমরা মহানুভূতি-সহানুভূতির সাথে সুন্দর করে যাচ্ছি। আরও যদি কাজ থাকে তবুও আমরা করবোই। আমরা কাজকে ভয় করিনা, কাজকে ভালোবেসে করে যাচ্ছি। বাংলাদেশের জনসেবার জন্য আমরা এটা করছি আর ঈদে ঘরমুখো মানুষের জন্য আমরা সুন্দর ভাবে কাজ করে যাচ্ছি।

একই শপের শহিদুল ইসলাম দৈনিক অধিকারকে বলেন, কাজের চাপ প্রচুর। এতো প্রচুর যে বলার মতো না। আমাদের লোক সংকট যার কারণে আমরা আউটটার্ন ঠিকমত দিতে পারছি না। সীমিত লোক নিয়ে গাড়ি আউটটার্ন দিচ্ছি আমরা। বাংলাদেশের বহুলোক বহু জায়গায় নিজ নিজ গন্তব্য স্থলে যাবে, গাড়িতে টিকেট কেটে যাবে। এটা আমাদের অনেক অনেক ভালো লাগবে। এটা আমাদের গর্ব। আমরা একটা সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেছি। সেবা দেওয়াটাই আমাদের কর্ম।

বগি শপের মিস্ত্রি মেহেদী হাসান দৈনিক অধিকারকে বলেন, ট্রলি বের করে নতুন চাকা ফিটিং করে আবার সেটা গাড়িতে ফিটিং করি। ফিট করার পর গাড়ি আউটটার্ন দেই। এভাবে মাসে ১০ থেকে ১৫ টা গাড়ি আউটটার্ন দেই। ঈদ উপলক্ষে বসেরা যে কাজ দিবে সেটাই আমাদের করতে হবে। দশজনের কাজ দুইজনে করা লাগে। এই জায়গায় লোকবল নাই। লোকবল তো নিচ্ছে না।

বগি শপের ইনচার্জ জহিরুল ইসলাম দৈনিক অধিকারকে বলেন, পহেলা মার্চ থেকে ১৮ এপ্রিল আমাদের কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে। টার্গেট ৪০ দিনে এক’শ কোচ। এই টার্গেট আমরা সকাল ৭টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত কর্মযজ্ঞ চালাই। কারখানায় অনেকগুলো শপ আছে। একটা শপ আরেকটা শপের উপর নির্ভরশীল। সবগুলো শপ সমন্বয় করে আমরা আউটটার্ন দেই। জিনিসটা এমন কেউ যদি একদিন মিস করে অন্যদিকে পিছায় যাওয়া লাগে।

এ জন্য আন্তরিকতার সাথে সকাল থেকে আমাদের শ্রমিকরা রোজা থেকে কায়িক পরিশ্রম করছে। আমাদের একটাই উদ্দেশ্যে এবারের ঈদে নিরাপদে অতিরিক্ত যাত্রী গ্রামে এবং ঈদ শেষে যাত্রীদের নিরাপদে ঢাকায় পৌঁছায় দেওয়া।

ক্যারেজ শপের ইনচার্জ মমিনুল ইসলাম দৈনিক অধিকারকে বলেন, ইদ উপলক্ষে ঘর মুখো যাত্রীদের একটা প্রত্যাশা ও চাপ থাকে বাংলাদেশ রেলওয়ের উপরে। সেই লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। সৈয়দ রেলওয়ে কারখানা ১০০ কোচের লক্ষ্যমাত্রায় কাজ করছে। আমাদের বিভাগীয় তত্ত্বাবধায়কের নেতৃত্বে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। ইতিমধ্যে ৭০ শতাংশ কোচ আমরা আউটটার্ন দিতে সক্ষম হয়েছি। আগামী ১৮ এপ্রিলের মধ্যে বাকি ৩০ শতাংশ আউটটার্ন দিতে সক্ষম হবো আশা রাখছি।

তিনি আরও বলেন, আমরা দেশের সেবা করতে পারছি দেশের জনগণের সেবা করতে পারছি তাদেরকে আমরা তাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারছি রেলসেবা দিয়ে। ভালো লাগার একটা বিষয় তো আছেই। আমাদের কারখানায় লোকবল অনেক সংকট কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে সদয় রয়েছেন ওভারটাইম দিচ্ছেন এবং লোকজন স্বতঃস্ফূর্তভাবে দ্বিগুণ পরিশ্রম করছে। এই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রাকে লক্ষ্যে পৌঁছাতে চরম পরিশ্রম করে যাচ্ছে তারা।

জিওএইচ শপের ইনচার্জ আরিফুল ইসলাম দৈনিক অধিকারকে বলেন, আমাদের অল্পসংখ্যক জনবল দ্বারা আমরা আমাদের কাজগুলো সম্পূর্ণ করে থাকি। আমার এখানে মঞ্জুরি ১৩৯ জন আছে মাত্র ৩৭ জন। এছাড়াও কিছু অস্থায়ী শ্রমিক রয়েছে। আমরা অন্য সময়ে যে কোচ আউটটার্ন দিয়ে থাকি তার দ্বিগুণ আমরা বর্তমানে হাতে নিয়েছি। ঈদ উপলক্ষে যে ১০০ টি কোচের টার্গেট ইতিমধ্যে আমরা ৭০ টি কোচ ডিভিশনে হস্তান্তর করতে পেরেছি। আগামী ১৩ বা ১৪ তারিখের মধ্যে বাকি কোচ গুলো ডিভিশনে হস্তান্তর করতে পারবো। ইদে মানুষের ঘরমুখে আসার জন্য চলাচল ব্যবস্থা নিরাপদ করার জন্য আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। এই পরিশ্রমটাকে আমরা পরিশ্রম মনে করিনা। যখন মানুষ জন নিরাপদে ভ্রমণ করে নিজ গন্তব্যে আসতে পারে তখন আমাদের সার্থকতা আমরা পেয়ে থাকি।

কারখানার শিডিউল দপ্তরের ঊর্ধ্বতন উপ-সহকারী প্রকৌশলী (ইনচার্জ) রুহুল আমিন রুবেল দৈনিক অধিকারকে বলেন, প্রতিবারের মতো এবারও সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানায় ঈদে ঘরমুখো মানুষের যাত্রার সুবিধার্থে ১০০ কোচ আউটটার্ন প্রোগ্রাম হাতে নিয়েছে। এরই মধ্যে ৭০টি কোচ মেরামত করে ডিভিশনে হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকি ৩০টি কোচ আগামী ১৮ এপ্রিলের মধ্যে ডিভিশনে হস্তান্তর করা হবে। এই কোচগুলা দিয়ে পঞ্চগড়-ঢাকা, রাজশাহী-ঢাকা, চিলাহাটি-ঢাকা, খুলনা- ঢাকা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-ঢাকা এবং ঢাকামুখী ট্রেনগুলো সেগুলোতে সংযোজন হবে। অতিরিক্ত যাত্রী স্বাচ্ছন্দ্যে পরিবহন করা সহজ হবে। আমরা ইদে ঘরমুখো মানুষের জন্য অবদান রাখতে পারছি এজন্য শুকরিয়া।

সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার বিভাগীয় তত্ত্বাবধায়ক (ডিএস) সাদেকুর রহমান দৈনিক অধিকারকে বলেন, গত মার্চের ১ তারিখ থেকে এপ্রিলের ১৮ তারিখ পর্যন্ত আমাদের ৪০টি কার্যদিবস রয়েছে। এই ৪০টি কার্যদিবসের মধ্যে আমরা টোটাল ১০০টি কোচ মেরামত করে অপারেটিং ডিপার্টমেন্টকে আমরা হস্তান্তর করবো।

এই কারখানা সক্ষমতা তিন ইউনিট সেখানে এই সময় আমাদের শ্রমিক কর্মচারীরা রয়েছেন তারা অতিরিক্ত পরিশ্রম করে অতিরিক্ত কোচ গুলোকে আউটটার্ন দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এই কোচ গুলো বিভিন্ন আন্তঃ নগর ট্রেনগুলো যুক্ত হবে।

তিনি আরও বলেন, অন্যান্য সময় আমাদের যে সমস্যা গুলো থাকে এই সমস্যা গুলো এখনও বহাল আছে। কিন্তু এই ইদের সময় যাতে যাত্রীরা নিরাপদে নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারে সে জন্য আমাদের শ্রমিকরা উৎফুল্ল হয়ে কাজ করছে। অনেক সময় তাদেরকে কাজের জন্য বলা লাগে কিন্তু বর্তমানে স্ব প্রণোদিত হয়ে অতিরিক্ত কাজগুলো করে। তারা অনুভব করে যাত্রীদের যে গন্তব্যস্থানে পৌঁছার যে আনন্দটুকু সেটুকু মধ্যেও তারা শেয়ার করতে পারছে।

আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড