• রোববার, ১৯ মে ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১  |   ২৮ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

নির্মাণাধীন ভবনে তিন শ্রমিকের মৃত্যুর পর ঠিকাদার-ফোরম্যান গ্রেফতার 

  আব্দুর রউফ রুবেল, গাজীপুর

৩১ মার্চ ২০২৩, ১৫:০৫
নির্মাণাধীন ভবনে তিন শ্রমিকের মৃত্যুর পর মালিক-ঠিকাদার গ্রেফতার 

গাজীপুরের শ্রীপুরে কারখানার নির্মাণাধীন ভবনের কাজ করার সময় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে তিন নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনায় নিহতদের পক্ষে একজনের স্বজন মামলা দায়ের করেছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার (৩০ মার্চ) রাতে কারখানার মালিকসহ তিনজনের বিরুদ্ধে এ মামলা দায়ের করা হয়।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শ্রীপুর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) ফুরকান খান শুক্রবার (৩১ মার্চ) দুপুর ১২টায় বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

মামলায় আসামিরা হলেন- আলিফ এন্টারপ্রাইজের অধীনে কর্মরত ঠিকাদার ইব্রাহিম খান, ফোরম্যান রাব্বানী এবং স্কাইনিস পাওয়ার কোম্পানির মালিক আরশেদ আলী। তাদের মধ্যে প্রধান আসামী ইব্রাহিম এবং রাব্বানীকে ওইদিন রাতেই গ্রেফতার করা হয়েছে।

মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে কর্তব্য অবহেলার অভিযোগ আনা হয়। নিহত মনোয়ার হোসেনের ভাই আনোয়ার হোসেন তিনজনের নাম উল্লেখ করে মামলা রুজু করেন।

এর আগে বৃহস্পতিবার (৩০ মার্চ) সকাল ৮টায় শ্রীপুর পৌরসভার কেওয়া পূর্ব খণ্ড এলাকার ছাদে রড উঠাতে গিয়ে কাত হয়ে বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে তাদের মৃত্যু হয়। কাজের স্থানে কোনো রকম নিরাপদ কর্ম পরিবেশ ও নিরাপত্তার বালাই ছিল না বলে জানিয়েছে স্থানীয় লোকজন।

নিহতরা হলেন- নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার চর কচ্ছপিয়া গ্রামের আমজাদ হোসেনের ছেলে পিয়াস (২০), একই গ্রামের বেলাল সওদাগরের ছেলে পাভেল (২৩) এবং জামালপুর জেলার বকশিগঞ্জ উপজেলার বগারচর গ্রামের মুকুল হোসেনের ছেলে মনোয়ার হোসেন (২৫)। তারা আলিফ এন্টারপ্রাইজের অধীনে দৈনিক মজুরী ভিত্তিতে ওই কারখানায় নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করছিলো।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকাল সাড়ে ৮টার দিকে আগুনে পোড়ার গন্ধ পাওয়া যায়। পরে সকাল পৌনে ৯ টার দিকে কারখানার গেইটে উৎসুক জনতা ভিড় করতে থাকে। সাংবাদিকেরা প্রবেশ করতে চাইলে তাদেরও বাধা দেওয়া হয়। কিছু সাংবাদিক ও স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তি ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের সাথে কারখানায় প্রবেশ করে।

এ সময় ছবি তুলতে চাইলে কর্মরত শ্রমিকেরা সেখানেও সাংবাদিকদের বাধা দেয়। শ্রমিকদের মধ্যে থেকে একজন শ্রমিক কৌশলে আঙ্গুল উঁচিয়ে ভবনের পাশে বালির নিচে লাশ থাকার কথা জানায় সাংবাদিকদের। ওই স্থানে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের যেতে দিলেও সেখানে সংবাদকর্মীদের যেতে বাধা দেওয়া হয়। লাশ পুড়ার গন্ধে ভিতরে দাঁড়িয়ে থাকা কষ্ট হচ্ছিল। নিহতের খবর ছড়িয়ে পড়লে কারখানার প্রধান ফটকে উৎসুক জনতা লাঠিসোটা ও লোহার রড দিয়ে আঘাত করার পর গেইট খুলে দেওয়া হয়।

শ্রীপুরের মাওনা ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন অফিসার ইফতেখার হোসেন রায়হান ও প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, আরমাদা স্পিনিং কারখানায় সকাল ৮টায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলেও আমার সকাল ৯টা ১০ মিনিটে খবর পাই। খবর পেয়ে আমরা ঘটনাস্থলে ৯টা ২৫ মিনিটে পৌঁছাতে সক্ষম হই। কারখানায় প্রবেশ করে দেখতে পাই ওই কারখানায় তিন তলা ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। দৈনিক হাজিরা ভিত্তিতে তিন নির্মাণ শ্রমিক কাজ করছিল। এসময় তারা ২৫ মিলি রড রশি দিয়ে উপরে উঠাচ্ছিল। আকস্মিক রডগুলো পাশ দিয়ে (কারখানার বাহির দিয়ে) প্রবাহিত ১১ হাজার ভোল্টের বিদ্যুতের তারে পড়ে যায়। মুহূর্তেই বিদ্যুতায়িত হয়ে তিন শ্রমিকের মৃত্যু হয়।

স্টেশন অফিসার আরও বলেন, আমরা নিহতদের মরদেহ বালির নিচে চাপা দেওয়া অবস্থায় দেখতে পাই এবং উদ্ধার করি। তাদের শরীর ঝলসানো অবস্থায় পাওয়া গেছে। তবে কি কারণে লাশ বালি দিয়ে চাপা দিয়ে রাখা হয়েছিল তা বলতে পারছি না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিহতদের কয়েক সহকর্মী জানায়, ভবন নির্মাণে নিরাপত্তাজনিত কোনো ধরণের ব্যবস্থা ছিল না। হাতে গ্লাভস, পায়ে প্লাস্টিকের জুতা, মাথায় প্লাস্টিকের টুপি বা অন্য কোনো ধরণের ন্যুনতম নিরাপত্তার ব্যবস্থাও ছিল না। ভবনটি শুরু থেকে তিন তলা পর্যন্ত নির্মাণে নিরাপদ এবং নিরাপত্তার কোনো বালাই ছিলনা। পুড়ে যাওয়া মরদেহের দুর্গন্ধে সেগুলো বালির নিচে চাপা দিয়ে রাখা হয়েছিল।

সরেজমিনে দেখা যায় নির্মাণাধীন ওই ভবনের সামনে দুটি বালুর ঢিবি রয়েছে। নিহত তিন জনের লাশ একটি ঢিবিতে মধ্যে বালুচাপা দেওয়া অবস্থায় ছিল। কারখানার এক কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার পর তিন শ্রমিকের শরীরে আগুন ধরে গিয়েছিল। আগুন নেভানোর জন্যই তাদের বালুর ঢিবিতে ফেলা হয়েছিল।

ময়মনসিংহ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২ (মাওনা জোনাল) অফিসের উপ-মহা ব্যবস্থাপক (ডিজিএম) আহমদ শাহ আল জাবের জানান, সকাল ৯ টার দিকে হঠাৎ আমাদের দক্ষিণ পাশের লাইন বন্ধ হয়ে যায়। পরে খবর নিয়ে জানতে পারি কেওয়া পূর্ব খণ্ড এলাকার আরমাদা স্পিনিং মিলস লিমিটেড-২ এ বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে তিন নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। আমাদের বিদ্যুৎ কর্মীরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে।

শ্রীপুর পৌরসভার প্রকৌশলী হারুনুর রশীদ ও সার্ভেয়ার মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল জানান, স্কাইনিস পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের কাছ থেকে আরমাদা স্পিনিং লিমিটেড কারখানাটি কিনে নেয়। তাদের মধ্যে লেনদেন হলেও কাগজপত্র সম্পাদন এখনও বাকী রয়েছে বলে জানা গেছে। আলীফ এন্টারপ্রাইজ কারখানা ভবন নির্মাণের অনুমোদন নিয়েছে। আলীফ এন্টারপ্রাইজের কাছ থেকে ঠিকাদার ইব্রাহীম কাজের অনুমোদন নিয়ে ভবন নির্মাণের কাজ করছে। ঠিকাদার ইব্রাহীমকে শ্রমিক সরবরাহ করেছে গোলাম রব্বানী।

ওই কারখানার শ্রমিকদের ঠিকাদার (ফোরম্যান) বমোহাম্মদ রব্বানী বৃহস্পতিবার (৩০ মার্চ) বিকেলে জানান, পিয়াস, পাভেল ও মনোয়ার সকাল সাতটার দিকে কাজে আসে। তারা কারখানার পশ্চিম পাশের ভবনের ওপর রড তোলার কাজ করছিলেন। সকাল ৮ টার দিকে ২৫ মিলি (প্রায় ২০ ফুট লম্বা) রড খাড়া করার সময় রডটি (ওজন বেশি হওয়ায়) কাত হয়ে যায় এবং পাশের একটি বৈদ্যুতিক উচ্চ ভোল্টের (১১ হাজার ভোল্ট) তারের সঙ্গে রডের সংস্পর্শ হলে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ঘটনাস্থলে তিন শ্রমিকের মৃত্যু হয়। তারা গত এক বছর যাবত আলিফ এন্টারপ্রাইজের অধীনে এ কারখানায় নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করছে।

নিহত তিন শ্রমিকদের কোনো ধরনের সেইফটি ইকুইপমেন্ট দেওয়া হয়েছিল কিনা এ বিষয়ে জানতে চাইলে কারখানার সহকারী মহা-ব্যবস্থাপক (রক্ষণাবেক্ষণ) নজরুল ইসলাম বলেন আমি ঘটনার সময় কারখানায় উপস্থিত ছিলাম না।

তিনি আরও বলেন, মরদেহ বালিচাপা থাকার বিষয়টি আমার জানা নেই। কর্তৃপক্ষ বা অন্যান্য কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগের পরামর্শ দিয়ে তিনি মুঠোফোন কেটে দেন। এসময় কারখানার অন্য কোনো কর্মকর্তার সন্ধান পাওয়া যায়নি। বিষয়টি জেনে আপনাকে (সাংবাদিককে) জানাতে পারব এবং আধা ঘণ্টা পর আবার যোগাযোগ করতে বলেন বিষয়টি জানার জন্য। আধা ঘণ্টা পর ফোন দিলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি এবং পরবর্তীকালে ওই কর্মকর্তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

শ্রীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল ফজল মো. নাসিম বলেছেন, বৃহস্পতিবার (৩০ মার্চ) রাতে বকশিগঞ্জ উপজেলার বগারচর গ্রামের মুকুল হোসেনের ছেলে নিহত মনোয়ার হোসেনের ভাই আনোয়ার হোসেন বাদী হয়ে কারখানার মালিকসহ তিনজনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেন। তাদের মধ্যে রাতেই দুইজনকে গ্রেফতার করা হয়।

আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড