• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৭ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

র‍্যাবের হেফাজতে সুলতানা মৃত্যু

যুগ্ম সচিব নিজেই এখন প্রতারণা মামলার আসামি

  কাজী কামাল হোসেন, নওগাঁ

৩০ মার্চ ২০২৩, ১৪:২৬
যুগ্ম সচিব নিজেই এখন প্রতারণা মামলার আসামি
সুলতানা জেসমিন (ফাইল ছবি)

রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার অফিসের স্থানীয় সরকার বিভাগের পরিচালক (যুগ্ম সচিব) এনামুল হক নিজেই একটি প্রতারণা মামলার আসামি। তার বিরুদ্ধে গত বছর অক্টোবরে ছন্দা জোয়ারদার নামে এক নারী রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানায় মামলাটি করেন বলে জানা গেছে। ওই মামলাটি আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনামুল হক মামলার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, ছন্দা জোয়ারদারের দায়ের মামলাটি জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। তবে তিনি ছন্দা জোয়ারদারের মামলাটিকে মিথ্যা মামলা বলে তার বক্তব্যে উল্লেখ করেন।

এ দিকে নওগাঁয় র‍্যাব হেফাজতে সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর কারণ উদ্ঘাটনে উচ্চ পর্যায়ের বিচার বিভাগীয় কমিটি গঠনের নির্দেশনা চেয়ে করা রিটের শুনানির সময় বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ মঙ্গলবার এসব প্রশ্ন সামনে আনেন।

পাশাপাশি আটকের পর থেকে সুলতানা জেসমিনকে সম্মানজনক জায়গায় (থানা অথবা কার্যালয়ে) নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল কি না এবং হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সময়ে র্যাবের আচরণ আইনানুগ হয়েছে কি না, তাও জানতে চেয়েছেন আদালত।

এছাড়া চূড়ান্ত ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর কারণ কী আসে, সেই সংক্রান্ত তথ্য আদালতকে জানাতে আদেশ দেওয়া হয়েছে। ৫ এপ্রিলের মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষকে এসব বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত এবং এ সংক্রান্ত আইন, নথি এবং সুলতানা জেসমিনের ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করতে বলা হয়েছে। ওই দিন পরবর্তী শুনানি অনুষ্ঠিত হবে।

মামলায় বাদীর বক্তব্য ও এজাহারে ব্যাপক গরমিল নওগাঁ সদর উপজেলার ভূমি অফিসের অফিস সহায়ক সুলতানা জেসমিনের বিরুদ্ধে যুগ্ম সচিব এনামুল হকের করা মামলায় বাদীর বক্তব্য ও এজাহারে দেওয়া তথ্যে ব্যাপক গরমিল ও অসংগতি পাওয়া গেছে। রাজশাহী মেদিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকের বক্তব্য ও র‍্যাবের দাবির মধ্যেও বিস্তর ফারাক রয়েছে।

রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার অফিসের স্থানীয় সরকার বিভাগের পরিচালক এনামুল হকের জেসমিনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা বেকর্ডের জন্য রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের রাজপাড়া থানা পুলিশের কাছে তদবির করেন। ঠিক সেই সময়ে সুলতানা জেসমিন রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে পড়ে আছেন।

জেসমিন যখন মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ছেন, তখন তিনি দাবি করছেন র‍্যাব কর্মকর্তাদের সহায়তায় তিনি থানায় মামলা করেছেন। একজন সরকারি চাকরিজীবীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়েরের আগে কর্তৃপক্ষের অনুমতির প্রয়োজন হয়। এনামুল হক রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার অথবা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে মামলা দায়েরের জন্য পূর্বানুমতি নেননি বলে জানা গেছে।

এ দিকে সুলতানা জেসমিনকে তুলে নেওয়ার বিষয়ে র‍্যাবের বক্তব্য এবং যুগ্ম সচিব এনামুল হকের মামলার এজাহারে দেওয়া বক্তব্য বিশ্লেষণ করে আরও বেশকিছু গরমিল পাওয়া গেছে। এনামুল হক মামলার এজাহারে বলেছেন, ২২ মার্চ বেলা সোয়া ১১টার দিকে দাপ্তরিক কাজে তিনি নওগাঁয় যান। ওই সময় শহরের বাসস্ট্যান্ড মোড়ে র্যাবের একটি টহল দলকে তিনি দেখতে পান। র্যাব টিমের ইনচার্জ উপ সহকারী পরিচালক (ডিএডি) মো. মাসুদকে তাৎক্ষণিকভাবে তিনি ঘটনাটি জানান। এরপর বেলা ১১টা ৫৫ মিনিটে সুলতানা জেসমিনের অবস্থান শনাক্ত করে তাকে আটক করে নিয়ে যায় র্যাবের দল।

অপর দিকে র‍্যাবের পক্ষ থেকে বলা র‍্যাব হেফাজতে সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেছিলেন, কিছুদিন আগে যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার এক কর্মকর্তার ফেসবুক আইডি হ্যাক করে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা নেওয়ার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ছায়া অনুসন্ধান করছে র্যাব। অনুসন্ধানে সুলতানা জেসমিনের ব্যাংকে সন্দেহজনক লেনদেন পাওয়া যায়। ফলে তাকে নজরদারির মধ্যে আনা হয়। একপর্যায়ে তার মোবাইল ফোন তল্লাশি করে ২০ লাখ টাকা লেনদেনের প্রমাণ মেলে।

প্রতারণায় জেসমিনের বিরুদ্ধে অনেক আগেই একটা জিডি করেন বলে যুগ্ম সচিব দাবি করলেও কবে এবং কোথায় জিডি করেছিলেন এর কোনো জবাব দিতে পারেননি তিনি।

সুলতানা জেসমিনকে আটকের বিষয়ে জড়িত নন দাবি করে এনামুল হক জানান, তিনি শুধু র‍্যাবকে বিষয়টি দেখতে বলেছিলেন। তুলে নিতে বলেননি। তবে র্যাব মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মুঈন মঙ্গলবার ঢাকায় যে ব্রিফিং করেছেন তাতে স্পষ্ট করে বলেছেন, যুগ্ম সচিবের উপস্থিতিতে সুলতানা জেসমিনকে গ্রেফতার করা হয়।

দুই সপ্তাহ ধরে নজরদারিতে ছিল সুলতানার বাড়ি :

নওগাঁ শহরের চকদেব জনকল্যাণ পাড়া এলাকার যে বাসাটিতে সুলতানা জেসমিন ভাড়া থাকতেন ওই বাড়ির মালিক দেলোয়ার হোসেন দুলাল জানিয়েছেন, গ্রেফতারের ২ সপ্তাহ আগে থেকে ৩ থেকে ৫ জনের একটি দল তার ৩ তলা বাড়ির সামনে কংক্রিটের বেঞ্চে বসে মধ্যরাত পর্যন্ত আড্ডা দিত। সুলতানা ওই বাড়ির দ্বিতীয় তলায় ৬৫০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাটে ৪ হাজার ২০০ টাকা ভাড়ায় থাকতেন।

দেলোয়ার জানান, সুলতানা জনকল্যাণ পাড়া মোড় থেকে রিকশায় উঠলে আরও কয়েকজন এসে তার রিকশা অনুসরণ করে মুক্তির মোড়ে পৌঁছান এবং সেখান থেকে তাকে একটি সাদা মাইক্রোবাসে করে নিয়ে যায়। তবে কারা তাকে আটক করেছে, এ বিষয়ে তারা কিছু জানতেন না।

সুলতানার মাথায় আঘাতের কারণ এখনো অজানা :

সুলতানা জেসমিন রামেক হাসপাতালে ভর্তি করার সময় র‍্যাব কর্মকর্তারা বলেছিলেন যে পড়ে গিয়ে তার মাথায় আঘাত লেগেছে। তিনি মাথায় আঘাত পেয়েছিলেন এবং তার মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়েছিল। তবে, এই আঘাত বা রক্তক্ষরণের কারণ এখনো অজানা।

রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের (রামেক) ফরেনসিক চিকিৎসকরা সুলতানার মৃত্যুর একদিন পর ময়নাতদন্ত করেছেন। ময়নাতদন্তের জন্য গঠিত ৩ সদস্যের বোর্ডের নেতৃত্বে ছিলেন সহযোগী অধ্যাপক কফিল উদ্দিন বলেন, সুলতানা জেসমিনের মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ ছাড়াও মাথায় আঘাত লেগেছে।

ময়নাতদন্ত দলটি হিস্টোপ্যাথলজিকাল রিপোর্টের জন্য সুলতানার হৃদপিণ্ডের নমুনা রামেকের প্যাথলজি বিভাগে পাঠিয়েছে। কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান কফিল উদ্দিন বলেন, রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর সুলতানার মৃত্যুর চূড়ান্ত কারণ জানা যাবে।

এ দিকে সুলতানা জেসমিনের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন গত বুধবার বিকাল পর্যন্ত প্রস্তুত হয়নি। রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান কফিল উদ্দিন বলেন, তারা প্যাথলজিতে আলামতগুলো পাঠিয়েছেন। পরীক্ষার ফল পাওয়া গেলেই প্রতিবেদন প্রস্তুত করবেন। এ জন্য তিন থেকে সাত দিন সময় লাগতে পারে। এ ছাড়া ওই প্রতিবেদন সরাসরি বিচারিক কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়ায় তাঁরা প্রতিবেদনের তথ্য আগেই বলতে পারেন না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, র‍্যাব হেফাজতে সুলতানা জেসমিনের অস্বাভাবিক মৃত্যুর পেছনে যুগ্ম সচিবের যোগসূত্র খতিয়ে দেখা দরকার। জেসমিনের সঙ্গে তার লেনদেনসংক্রান্ত কোনো বিরোধ ছিল কি না বা তাদের মধ্যে কোনো ভুল বোঝাবুঝির কারণে জেসমিনকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন কি না, তাও তদন্ত হওয়া দরকার বলে মনে করেন তারা।

আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড