মাজেদুল ইসলাম হৃদয়, ঠাকুরগাঁও
ঠাকুরগাঁও জেলায় এবার উন্নত মানের হাইব্রিড ডিএম-৪ জাতের তুলার ফলনে ও খরচের চেয়ে দ্বিগুণ লাভবান হওয়ায় খুশি কৃষকরা। অন্যান্য জাতের তুলার চেয়ে এ জাতের তুলার ফলন ও মান ভালো হওয়ায় ব্যাপক সারা ফেলেছে চাষিদের মাঝে। বস্ত্র খাতে তুলার চাহিদা মিটাতে সরকারের পাশাপাশি এগিয়ে আসছেন অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।
তাই দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছেন তুলা চাষিদের পাশাপাশি তুলার বীজ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। ভালো জাতের তুলার বীজ সরবরাহ করে তুলা চাষে উদ্বুদ্ধ করছেন কৃষকদের।
মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা। সভ্যতার দিক থেকে বিবেচনায় বস্ত্রই হচ্ছে আমাদের প্রথম মৌলিক চাহিদা। বস্ত্র তৈরিতে তুলার ব্যবহার অপরিহার্য। তাই বিশ্বের বাজারে দিন দিন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তুলার চাহিদা। আর আমাদের দেশে পোশাক তৈরিতে এসব তুলার সিংহভাগ আমদানি করা হচ্ছে বিদেশ থেকে। তাই সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গুলোর যৌথ উদ্যোগে অধিকাংশ তুলা বাংলাদেশ থেকে উৎপাদন করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
এরই ধারাবাহিকতায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান লাল তীর সীড লিমিটেড বাজারে নিয়ে এসেছে উন্নত হাইব্রিড ডিএম-৪ জাতের তুলার বীজ। যা চাষ করে দ্বিগুণ লাভবান হচ্ছেন ঠাকুরগাঁও জেলার কৃষকরা।
যে জেলায় আগে তুলা চাষ সম্পর্কে মানুষের জানা ও ধারণাই ছিল না। সেই জেলায় গত ২১-২২ অর্থ বছরে তুলা চাষ হয়েছে উফশী ও হাইব্রিড মিলে ৪২৬ হেক্টর জমিতে ও উৎপাদন হয়েছে ২ হাজার ৮১৬ বেল তুলা। যার মূল্য ১৮ কোটি টাকা। আর ২২-২৩ অর্থ বছরে তুলা চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭০০ হেক্টর জমি যার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বর্তমান মূল্য প্রায় ২৮-৩০ কোটি টাকা। এতো টাকার তুলা উৎপাদিত হবে শুধু এ জেলা থেকেই।
সদর উপজেলার হরিহরপুর গ্রামের তুলা চাষি নুরুজ্জমান (গোলাপ) বলেন, ৩৩ শতাংশের ১৪ বিঘা জমিতে চাষ করেছেন লাল তীরের হাইব্রিড ডিএম-৪ জাতের তুলা। চাষ করতে বিঘায় খরচ হয়েছে ২০-২৫ হাজার টাকা। এক বিঘাতেই ফলন হয়েছে ১৬ মণ। বর্তমান যার প্রতিমণ বাজার মূল্য ৩ হাজার ৮০০ টাকা। প্রতি বিঘার জমির তুলা বিক্রয় করেছেন ৬০ হাজার টাকা। তাতে মাত্রা ৬ মাসে এক বিঘা জমিতে লাভ হয়েছে তার ৩৫-৪০ হাজার টাকা। এখনো সম্পূর্ণ তুলা হারভেস্ট করা হয়নি তার। জমিতে এখনো রয়ে গেছে অনেক তুলা। এছাড়াও তিনি তুলার সাথে সাথি ফসল হিসেবে চাষ করেছেন আখ।
জেলা তুলা উন্নয়ন বোর্ড ও লাল তীর সীড কোম্পানির সহযোগিতায় এবং পরামর্শে জেলার কৃষকরা পরিত্যক্ত জমিতে চাষ করেছেন তুলা। চাষিদের অনেকেই তুলার সাথে সাথি ফলস হিসেব কেউ আখ, কেউ বা কলা, কেউ আবার নানা ধরণে শাক সবজি চাষ করেছেন।
এতে এক ফসলের পরিচর্যায় ও খরচে দুই ফলস করতে পেরে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছে বলে জানান, তুলাচাষি অর্জুন দেব নাথ ও বেলাল হোসেন। এছাড়াও উদ্বুদ্ধ হয়ে তোফাজ্জল ইসলাম তুলা চাষ করেন।
তিনি বলেছেন, হারভেস্ট করার পরে তুলা গাছ গুলো জৈব সার হিসেবে ব্যবহার করেন তারা।
তুলা চাষের সাথে কৃষকরা সাথী ফসলও চাষ করতে পারছেন বলে বেশি করে তুলা চাষে আগ্রী হচ্ছেন তারা। তুলা বোর্ডের পাশাপাশি লালতীর শীড কোম্পানিও কৃষকদের নানা ভাবে পরামর্শ দিচ্ছেন ও বীজ সরবরাহ করছেন বলে জানান, ঠাকুরগাঁও তুলা উন্নয়ন বোর্ডের মাঠ পরিদর্শক স্বদেশ চন্দ্র রায়।
ঠাকুরগাঁওয়ে মাঠ পরিদর্শনে এসে লালতীর শীড লিমিটেডের রংপুর ডিভিশনাল ম্যানেজার মেহেদী হাসান খান বলেন, লাল তীর সীড কোম্পানি অন্যান্য বীজ সরবরাহের পাশাপাশি কোম্পানির দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, কৃষক এবং শ্রমিকদের আয় বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যেই ডিএম-৪ জাতের তুলার বীজ সরবরা করা হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, এ জাতের তুলা চাষের সাথে কৃষকরা নানা জাতের সবজি চাষ করে আরও বেশি লাভবান হচ্ছেন। এছাড়াও ডিএম-৪ জাতের তুলার মান ভালো ও ফলন অনেক বেশি। আমরা এখানে মাঠ পরিদর্শনে এসে কৃষকদের কাছে শুনেছি কারও কারও বিঘা প্রতি ১৬-২০ মণ করে তুলা হয়েছে।
এছাড়াও মাঠ পরিদর্শনে এসে লাল তীর সীড লিমিটেডের এক্সিকিউটিভ ডাইরেক্টর ডক্টর মোহাম্মদ ইশরাত হোসেন বলেন, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে ও গার্মেন্টস শিল্পকে রক্ষার জন্য লালতীর শীড লিমিটেডের চেয়ারম্যান আব্দুল্লা আল মিন্টু সাহেবের একান্ত প্রচেষ্টায় উন্নত জাতের তুলার বীজ ডিএম-৪ নিয়ে আসা হয়েছে এবং এ জাতের বীজের তুলার ফলন ভালো হওয়ায় চষিদের মাঝে সারা ফেলেছেন।
তিনি আরও বলেন, আমরা কোম্পানির পক্ষ থেকে কৃষকদের নানাভাবে মাঠ দিবসের মাধ্যমে পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছি। আমি সকল কৃষক ভাইদের আহ্বান করবো, আপনাদের যাদের তুলনামূলক কম উর্বর জমি আছে সেগুলো ফেলে না রেখে তুলা চাষ করুন। আসুন আমরা সকলে তুলা চাষে এগিয়ে এসে দেশের ডলার রক্ষা করি।
জেলার প্রধান তুলা উন্নয়ন কর্মকর্তা বলছেন, লাল তীর সীড়ের ডিএম-৪ জাতের বীজের জার্মিনেশন ভালো ও এর বিঘা প্রতি ১৬-২০ মণ করে ফলান হওয়ায় খুশি কৃষকরা। এছাড়া তুলা উন্নয়ন বোর্ড-ই কৃষকদের কাছে তুলা ক্রয় করে এবং এই ফসলের দামও স্থিতিশীল ও একই ফসলের সাথে অন্য ফসল করতে পারায় আগামীতে জেলায় তুলা চাষ আরও বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করছেন ঠাকুরগাঁও জোনের তুলা উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান কর্মকর্তা এ কে এম হারুন অর রশিদ।
তুলা চাষের মাঠ পরিদর্শনে এসে রংপুর অঞ্চল তুলা উন্নয়ন বোর্ডের উপ পরিচালক আবু ইলিয়াস মিঞা বলেন, ‘লাল তীর সীড়ের ডিএম-৪ ও তুলা উন্নয়ন বোর্ডের সিবি হাইব্রিড-১, উফশী-১২ ও-১৫ জাতের বীজ কৃষকদের সরবরাহ করা হচ্ছে। বর্তমানে কৃষকরা এসব হাইব্রিড জাতের তুলা চাষ করে বেশি লাভবান হচ্ছেন। তাই বিভিন্ন কোম্পানি বীজ সরবরাহ করার জন্য এগিয়ে আসছেন।
এছাড়াও দেশে উৎপাদিত তুলাকে আন্তর্জাতিক মানের তুলা কারার জন্য প্রাইমারের উদ্যোগে তুলা উন্নয়ন বোর্ডের সাথে কাজ করছে কোর্টন কার্নেক্ট ও টিএসএমএস। আর এসব তুলা বিভিন্ন জেনার্স অ্যাসোসিয়েশন ও স্পেনিং মিলস ক্রয় করে নিচ্ছেন এবং তারা কৃষকদের মুনাফা বিহীন ভাবে তুলা চাষের জন্য ঋণ প্রদান করছেন। এতে করে আমরা কৃষকদের আরও বেশি সুবিধা দিতে পারছি। তাই আগের তুলানয় এখন তুলা চাষে এগিয়ে আসছেন কৃষকরা। উত্তরাঞ্চলে আগামীতে তুলার চাষ আরও ব্যাপকভাবে সম্প্রসারণ হবে বলেও আশা করেন তিনি।
তুলা উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মতে, তুলা এমন একটি ফসল যার প্রতিটি অংশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেমন- আঁশ থেকে সুতা, বীজ থেকে খৈল ও খাওয়ার তেল পাওয়া যায়। গাছ থেকে জ্বালানি, কাগজ তৈরি ও হার্ডবোর্ড বানানো যায়। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে জমির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি করে। যে জমিতে কোনো ফসল হয় না সেই জমিতে পর পর দুই মৌসুম তুলা চাষ করলে এর উর্বরতা শক্তি এমন বৃদ্ধি পায় যে তখন সর্ব প্রকার ফসল সহজেই ফলানো যায়।
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড