• রোববার, ০২ এপ্রিল ২০২৩, ১৯ চৈত্র ১৪২৯  |   ২৯ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

৫০০ ফুট গভীরেও মিলবে না সুপেয় পানি!

  তুষার আহমেদ, নারায়ণগঞ্জ

২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৫:৪৩
নারায়ণগঞ্জ

# ভূগর্ভের পানির উপর চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে : জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তর

# সরকার উপরি ভাগের পানি সরবরাহ করতে ব্যর্থ : এবি সিদ্দিক

# ভূ-গর্ভে পানি রিচার্জ হচ্ছে না : পরিবেশ অধিদপ্তর

ফতুল্লার আব্দুল আলী। সুপেয় পানির আশায় নিজ বাড়ীতে ১৬০ ফুট গভীর নলকুপ স্থাপন করেছিলেন তিনি। শুরুতে ১২০ ফুটে মোটর নামিয়ে পানি পেলেও এখন ১৬০ ফুট গভীরেও পানির নাগাল পাচ্ছেন না। ফলে বিকল হয়েছে তার লাখ টাকা খরচের নলকুপটি।

অন্যদিকে, ২০১৫ সালে ৫০০ ফুট গভীর নলকুপ স্থাপন করেছিলেন কুতুবপুরের হাসেম মিয়া। শুরুতে ১৫০ ফুট গভীরে মোটরের অবস্থান রেখেও স্বচ্ছ সুপেয় পানি পেতেন তিনি। তবে ক্রমশ নি¤œমুখি হতে শুরু করে ভূগর্ভের পানি, তাই বছর বছর তার মোটর নামাতে হয়েছে গভীর থেকে গভীরে। বর্তমানে ২৫০ ফুট তলদেশেও পানির নাগাল পাচ্ছেন না তিনি। এতে হুট করেই বিকল হয়ে যায় তার সাবমার্সিবল মোটরটি।

তথ্য বলছে, শুধু ফতুল্লার আব্দুল আলী কিংবা কুতুবপুরের হাসেম মিয়াই নন, আশপাশে নলকুপে পানি না পাওয়া কিংবা মোটর বিকল হয়ে যাওয়ার এমন ঘটনা ঘটছে অহরহ।

কারণ অনুসন্ধানে জানা গেছে, ক্রমশই নিচে নেমে যাচ্ছে নারায়ণগঞ্জের ভূগর্ভের পানির স্তর। বিশেষ করে শিল্পাঞ্চল অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে আশঙ্কা জনক হারে কমছে ভূগর্ভের পানি। এতে পরিবেশে ভয়াবহ প্রভাব পড়ার জোড়ালো শঙ্কার কথা জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জে প্রতিবছর ভূগর্ভের সূপেয় পানির স্তর পরিমাপ বা নির্ণয় করে থাকে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। দপ্তরটির সদর উপজেলার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রতি বছরের মার্চ মাসে ইউনিয়নগুলোর ভূগর্ভের পানির স্তর নির্ণয় করা হয়। এখন ফেব্রুয়ারি চলছে, তাই এবছরের পানির স্তর হলফ করে বলতে পারছেন না তারাও।

তবে দপ্তরটির দেয়া এক তথ্য মতে, ২০২১ থেকে ২০২২ সালে মাত্র এক বছরের ব্যবধানে সদর উপজেলার ফতুল্লা, এনায়েতনগর ও কাশিপুরসহ আশপাশের এলাকায় ১০-১৫ ফুট করে নিচে নেমেছে পানির স্তর। অথচ, গোটা দেশের সমীকরণে প্রতিবছর মাত্র ১ ফুট করে নিচে নেমে থাকে ভূগর্ভের পানি। তবে শিল্পাঞ্চল অধ্যুষিত এই নারায়ণগঞ্জের ভূগর্ভের চিত্র উদ্বেগজনক। যা ভাবিয়ে তুলছে পরিবেশবীদদের।

জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জরিপ বলছে, ২০২১ সালে এনায়েতনগর ইউনিয়নে সুপেয় পানি মিলতো ১৭৫ ফুট গভীরে। তবে ২০২২ সালে আরো ১৩ ফুট গভীরে গিয়ে ১৮৮ ফুটে মিলছে এষানকার পানি। একই সময়ে ৮ ফুট গভীরে নেমে ১৯৮ ফুট গভীরে মিলছে ফতুল্লা ইউনিয়নের ভূগর্ভের পানি। একই সময়ে কাশিপুরে পানির স্তর নেমেছে ৬ ফুট গভীরে। বর্তমানে এই ইউনিয়নে সুপেয় পানির স্তর ১৭১ ফুট নিচে। ১৪২ ফুট গভীরে মিলছে গোগনগর ইউনিয়নের পানি আর ১০৬ ফুট গভীরে রয়েছে আলীরটেক ও বক্তাবলী ইউনিয়নের সুপেয় পানির স্তর।

জরিপে দেখা গেছে, সুপেয় পানির স্তর সবচেয়ে বেশী নিন্মমুখী হয়েছে কুতুবপুরে। ইউনিয়নটিতে সুপেয় পানি মিলছে ২৩০ ফুট গভীরে গিয়ে। অবশ্য কোথাও কোথাও ২৫০ ফুটেও তা পাওয়া যাচ্ছে না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে শহরতলীতে সর্বোচ্চ ৫০০ ফুট গভীরে নলকুপ স্থাপন করা হয়। ৫০০ ফুট গভীরে নলকুপ স্থাপনের পরও পানি মিলছে ২৫০ ফুট গভীরে গিয়ে। অর্থাৎ, ৫০০ ফুট নলকুপের অবশিষ্ট পানির স্তর বাকি রয়েছে ২৫০ ফুট।

প্রতিবছর গড়ে ১৫ ফুট করে পানির স্তর নিচের দিকে নেমে থাকলে সমীকরণ বলছে, ৫০০ ফুট গভীর নলকুপের অবশিষ্ট ২৫০ ফুটের স্তর ফুরাতে সময় লাগবে মাত্র ১৬ থেকে ১৭ বছর। অর্থাৎ আগামী ১৬-১৭ বছর পর নারায়ণগঞ্জের বেশীর ভাগ স্থানে ৫০০ ফুট গভীর নলকুপেও মিলবে না সুপেয় পানি! এমনটা হলে প্রতিটি বসত বাড়িতে আবারও নতুন করে স্থাপন করতে হবে আরো গভীর নলকুপ। অন্যথায় পানির জন্য হাহাকার পরার সম্ভাবনা রয়েছে নারায়ণগঞ্জে।

সদর উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রকৌশলী মো. শাহ আলম বলেন, ‘সদর উপজেলার মধ্যে ফতুল্লা, এনায়েতনগর ও কাশিপুর ইউনিয়ন শিল্প কারখানা অধ্যুষিত এলাকা। এসব এলাকায় গড়ে উঠা ডাইং কারখানাগুলোর পানির চাহিদা মেটানো হচ্ছে ভূগর্ভ থেকে। এতে ভূগর্ভের পানির উপর চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই অন্যান্য ইউনিয়নের তুলনায় এসব ইউনিয়নে আশঙ্কাজনক হারে পানির স্তর নেমে যাচ্ছে।’

পরিবেশবাদী আন্দোলন নারায়ণগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট এবি সিদ্দিক বলেন, ‘পরিবেশ অধিদপ্তরের উপর যেই দায়িত্ব আছে, তারা তা পালন করে না। অযুহাত দেখায়। একটি বাড়িতে ডিপ মোটরের মাধ্যমে যে পরিমান পানি উত্তোলন হয়, প্রতি ঘন্টায় তার চেয়ে কয়েক লক্ষ গুণ বেশী পানি উত্তোলন করে বিভিন্ন ডাইং কারখানাগুলো। ২০১৩ সালের দিকে আমরা এই বিষয়ে তীব্র আন্দোলন করেছিলাম। ঢাকা নারায়ণগঞ্জ ও কারওয়ান বাজার মিলে ১৬টি মিটিং করেছিলাম। সরকার আইন করেছিল। আইনের উদ্দেশ্য ছিলো, মানুষ ভূগর্ভের পানি না টেনে যেন উপরি ভাগের পানি ব্যবহার করে। কিন্তু সরকার উপরি ভাগের পানি সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয়। কারণ শীতলক্ষ্যা, বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী- এগুলোর পানি নষ্ট হয়ে গেছে। সরকার আবার সম্পূর্ন ভাবে পাতালের পানির উপরেই নির্ভর করেছে। ফলে ঢাকাসহ নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের ইন্ডাস্ট্রিয়াল এলাকাগুলো এবং আমাদের উন্নত শহরগুলো মাত্রাতিরিক্ত পানি উঠিয়ে লেয়ার নিচে নিয়ে গেছে। এতে করে ভয়াবহ ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’

এদিকে, ভূগর্ভের পানির স্তর নিচের দিকে নেমে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘ভূগর্ভস্থ পানি নিচের দিকে চলে গেলে সমস্ত প্রাণীকূলের জন্যই তা এলার্মিং।’

পরিবেশ অধিদপ্তরের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘অনাবৃষ্টির একটি বিষয় রয়েছে। আবার বৃষ্টি হলেও আমরা আমাদের ভূমির বেশির ভাগ স্থান সিমেন্টেড করে ফেলেছি। পাকা স্থাপনা আমাদের এখানে দিন দিন বাড়ছে। বৃষ্টির পানিটা ভূগর্ভে রিচার্জ হচ্ছে না। আমাদের পানি চক্র হিসেবে পানিগুলো সাগরে চলে যায়, সাগরে জলীয় বাষ্প হয়, জলীয় বাষ্পটা আবার ঘনিভূত হয়ে বৃষ্টির মাধ্যমে আমাদের ভূপৃষ্ঠে ফিরে আসে, সেই ভূপৃষ্ঠের পানিটা আবার ধীরে ধীরে ভূগর্ভে যায়। কিন্তু এই ওয়াটার সাইকেল বা পানি চক্রটা বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। পানিটা সঠিক ভাবে ভূগর্ভে যেতে পারছে না। তাই ভূগর্ভ থেকে শুধু পানি উত্তোলনই হচ্ছে, সেখানে পানি রিচার্জ হচ্ছে না। এটা শুধু মানুষকূলের জন্যই নয়, সমস্ত প্রাণীকূলের জন্যই ভয়াবহ ক্ষতিকর।’

আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড