• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৭ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

আজও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাননি ভাষা সৈনিক হাবিবুর রহমান খান

  মো. রুম্মান হাওলাদার, পিরোজপুর

২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৩:৫৫
আজও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাননি ভাষা সৈনিক হাবিবুর রহমান খান
ভাষা সৈনিক হাবিবুর রহমান খান (ফাইল ছবি)

৫২ এর ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরের স্বাধীনতার সূচনা পূর্বে দক্ষিণ বাংলার যে ক’জন সাহসী সূর্য সন্তান তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল ভাষা সৈনিক মো. হাবিবুর রহমান খান সেই সাহসী, স্বপ্ন সারথিদের অন্যতম।

৭১ সালের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামেও যার ছিল সক্রিয় অংশগ্রহণ। তবে ভাষা আন্দোলনের ৭১ বছর পেরিয়ে গেলেও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি মেলেনি এই ভাষা সৈনিকের।

মো. হাবিবুর রহমান খান ১৯৩৩ সালের ২০ মার্চ পিরোজপুর জেলার বৃহত্তর মঠবাড়িয়া উপজেলার কবুতরখালী গ্রামের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মৃত মুজাহার আলীর খানের ১০ সন্তানের মধ্যে ৮ম হাবিবুর রহমান। ছাত্রজীবন থেকেই হাবিবুর রহমান ছিলেন একজন মেধাবী, প্রতিভাবান ও চৌকস ছাত্রনেতা।

ব্রজ মোহন কলেজ থেকে ১৯৫৩ সালে আইএ প্রথম বিভাগে ও ১৯৫৬ সালে বিএ এবং ১৯৫৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিভাগে পাশ করেন। বরিশাল বিএম কলেজে আইএ অধ্যয়নকালে তিনি ১৯৫১ সালে ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবির আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। তরুণ প্রতিভাবান ও মেধাবী শিক্ষার্থী হওয়ায় কলেজ শিক্ষকমণ্ডলীসহ সকল ছাত্র-ছাত্রীদের নিকট ছিলেন অত্যন্ত প্রিয়। বিভিন্ন সভা ও সেমিনারে তার বক্তব্য ছিল ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে অনুপ্রেরণামূলক।

রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবির আন্দোলনকে জোরদার ও কার্যকরী করার লক্ষ্যে বরিশাল বিএম কলেজে ১৯৫২ সালে ১৩ সদস্য বিশিষ্ট একটি রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। তিনি ছিলেন সে কমিটির অন্যতম সদস্য এবং বিএম কলেজে রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলনের হাতে গোনা কয়েকজন শীর্ষ নেতাদের মধ্যে অন্যতম।

তৎকালীন ভাষা সংগ্রাম কমিটির সদস্যবৃন্দ বরিশালের কাউনিয়াতে রাতের আধারে গোপন সভা করেন। পূর্ব পাকিস্তানের গোয়েন্দা পুলিশ সাদা পোশাকে এই কমিটির সদস্যদের গতিবিধি নজরদারী করায় প্রতি রাতেই তাদের সভাস্থল পরিবর্তন করা লাগতো। ঐ সময় আধুনিক ফোন না থাকায় পায়ে হেঁটে হেঁটে জনসংযোগ করতেন তারা। সেটা করতে গিয়ে হাবিবুর রহমানসহ কমিটির সকল সদস্যবৃন্দ নজরদারীতে পরে যায়।

সভা করতে গিয়ে প্রায়শই পুলিশের ধাওয়া ও অত্যাচার সইতে হতো। এভাবে গোপনে গোপনে অনেক মিটিং করে, তারা ছাত্র ও যুব সমাজকে ভাষা আন্দোলনের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ করেন। এরই মধ্যে ঢাকার কেন্দ্রীয় কমিটিও হাবিবুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করে সহযোগিতা ও সমর্থন দেন। আস্তে আস্তে হাবিবুর রহমান কেন্দ্রীয় কমিটির বিশ্বাসভাজন বিভাগীয় নেতা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

মেধাবী ছাত্র হওয়ায় তার নেতৃত্বে অনেক ছাত্র-ছাত্রী আন্দোলনে যোগদান করেন। তিনি বরিশালের বিভিন্ন স্থানে মিছিল, সভা, সমাবেশ, মানব বন্ধনের নেতৃত্ব দেয়ায় প্রশাসনসহ সকলের নিকট অত্যন্ত পরিচিত ব্যক্তি হয়ে উঠেন। ফলে, তার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি ও মামলা হয়। প্রশাসন ও পুলিশের অত্যধিক হয়রানির জন্য লেখাপড়াসহ ব্যক্তি জীবন অত্যন্ত দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা হলে গ্রেফতার এড়ানোর কৌশল হিসেবে তিনি গ্রামের বাড়িতে চলে আসেন।

গ্রামের বাড়িতে এসেও তার মতো একজন সংগ্রামী ও দেশপ্রেমিক মেধাবী ছাত্র চুপ করে বসে থাকতে পারেননি। তিনি মাঠবাড়িয়ার ছাত্র-ছাত্রী ও তরুণদের রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলনে যোগদানের জন্য উদ্বুদ্ধ করেন এবং তাদের মধ্যে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি কার্যক্রম চালান। স্থানীয় ছাত্র-ছাত্রী ও তরুণদের নিয়ে বিভিন্ন সভা, সমাবেশ, মিছিল ও মানববন্ধন করেন। ফলে মঠবাড়িয়াতেও তার বিরুদ্ধে প্রশাসন কর্তৃক হুলিয়া, মামলা গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি হয়।

পরবর্তীকালে রাষ্ট্র ভাষা বাংলার দাবিতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মঠবাড়িয়া উপজেলায় ছাত্রদের নিয়ে হরতাল পালিত করে। ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় পুলিশের গুলিতে নিহত শহীদদের স্মরণে এবং রাষ্ট্র ভাষা বাংলার দাবীতে মঠবাড়িয়ার কে. এম. লতীফ ইনস্টিটিউশনের চত্বরে ২৩ ফেব্রুয়ারি এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত প্রতিবাদ সভায় নেতৃত্ব দেন মো. হাবিবুর রহমান খান।

এ সময় মঠবাড়িয়ায় রাষ্ট্রভাষা পরিচালনার জন্য কে এম লতীফ ইনস্টিটিউশনে ১৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠিত হয়। হাবিবুর রহমান ছিলেন সেই কমিটির একজন সদস্য।

স্বাধীনতার সংগ্রামেও এ ভাষা সৈনিকের অবদান ছিল অপরিসীম। মঠবাড়িয়া উপজেলার গুলিশাখালী ইউনিয়নের “মুক্তি বাহিনী” ও সংগ্রাম কমিটির অন্যতম সংগঠক ছিলেন। জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চ ভাষণের পর তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য মরহুম সওগাতুল আলম সগীরের নেতৃত্বে তার সহোদর বড় ভাই ডা. শামসুর আলমের সহযোগিতায় স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে পিরোজপুর জেলাধীন মঠবাড়িয়া উপজেলার ১০নং হলতা গুলিশাখালী ইউনিয়নের জি, কে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাঠে স্থানীয় লোকজন নিয়ে সংগ্রাম কমিটি গঠন করেন। এমনকি সেনা সদস্য সার্জেন্ট আব্দুল লতীফের নেতৃত্বে গঠিত কমিটিতে পাঁচ জন প্রশিক্ষক দ্বারা ১২ মার্চ ১৯৭১ সালে একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্পেরও উদ্বোধন করেন।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি জি, কে ইউনিয়ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক থাকাকালীন সময় গুলিশাখালী ও তৎসংলগ্ন এলাকায় সক্ষম ব্যক্তিদের নিয়ে মুক্তিবাহিনী গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। নিজ বাড়িতে মুক্তিবাহিনীদের দীর্ঘদিন যাবৎ আশ্রয়, খাবারের ব্যবস্থা ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা প্রদানের পাশাপাশি তাদের উৎসাহ উদ্দীপনা যোগাতেন।

ভাষা সৈনিক হাবিবুর রহমান খান ৫২ এর ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সেই ১৮ বছরের টগবগে কিশোর এখন ৯১ বছরের বৃদ্ধ। বর্তমানে জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক হলেও আজও পাননি রাষ্ট্রীয় কোনো স্বীকৃতি। প্রতি বছর ২১ শে ফেব্রুয়ারি আসলে তার কদর কিছুটা বাড়লেও বছরের বাকি সময়টুকু একাকীত্বভাবে কাটাতে হয় তাকে।

ভাষা সৈনিক হাবিবুর রহমান খান দুঃখ করে বলেন, ভাষার জন্য আমরা সংগ্রাম করেছি, জুলুম-অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করে দিনের পর দিন পালিয়ে থেকেছি। মায়ের ভাষার জন্য এ দেশের ছাত্ররা রাজপথে জীবন দিয়েছে। অথচ আজ পর্যন্ত হয়নি ভাষা সৈনিকদের কোন গেজেট বিজ্ঞপ্তি। কেন হয়নি তাও জানি না। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসকে উপেক্ষা করলে জাতির মধ্যে অস্তিত্বহীনতা তৈরি হবে। সে জন্যই এর পরিপূর্ণ ইতিহাস ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ দরকার।

সংগ্রামী এ ভাষা সৈনিক কিছুটা আক্ষেপের সুরে বলেন, ভাবতে অবাক লাগে এদেশের অনেক মিডিয়ায় এখনো ইংরেজি শব্দ ব্যবহার হয়। আদালতে রায় লেখা হয় ইংরেজিতে, চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্র লিখেন ইংরেজিতে। আমি মনে করি এটা আমাদের জন্য লজ্জা।

আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড