• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৯ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

ক্ষমতার যাঁতাকলে পিষ্ট ৪৮ শিক্ষক-কর্মচারী 

১১ মাস বেতন বন্ধে বাঁধাগ্রস্ত পাঠদান

  মো. রেজোয়ান ইসলাম, নীলফামারী

২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:৪৫
ক্ষমতার যাঁতাকলে পিষ্ট ৪৮ শিক্ষক-কর্মচারী 
মীরগঞ্জহাট ডিগ্রি মহাবিদ্যালয় (ছবি : অধিকার)

দুই সভাপতির করা পাল্টাপাল্টি মামলা ও দুই অধ্যক্ষের পদবি নিয়ে দ্বন্দ্বে ৪৮ শিক্ষক-কর্মচারী বেতন-ভাতা তুলতে পারছেন না ১১ মাস ধরে। এ নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার মীরগঞ্জহাট ডিগ্রি মহাবিদ্যালয়ে। এতে পাঠদানসহ বিঘ্নিত হচ্ছে শিক্ষার পরিবেশ।

কলেজের ‘অধ্যক্ষ’ আবুজার রহমান এবং ‘ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ’ প্রভাষক মিজানুর রহমান দুজনের দাবি তারা নিয়মিত অফিস করছেন এবং কাজকর্ম পরিচালনা করছেন। আর সভাপতির পদ নিয়ে মামলা চলছে অধ্যাপক খয়রাত হোসেন এবং জলঢাকা উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি আবুল কালাম আজাদের মধ্যে।

কলেজ সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের (২০২১ সালের ৫ মার্চ দুই বছর মেয়াদে কলেজের পরিচালনা কমিটির সভাপতি হিসেবে অধ্যাপক খয়রাত হোসেনকে মনোনয়ন দেয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। কমিটির মেয়াদ পূর্তির ১১ মাস আগে ২০২২ সালের ৩১ মার্চ অন্য সদস্য ঠিক রেখে খয়রাত হোসেনকে পরিবর্তন করে আওয়ামী লীগ নেতা আবুল কালাম আজাদকে সভাপতি পদে মনোনয়ন দেয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।

সংক্ষুব্ধ খয়রাত হোসেন ৩০ মে হাই কোর্টে রিট করেন। আদালত নতুন সভাপতি আবুল কালাম আজাদের কাজে তিন মাসের স্থগিতাদেশ দেয়। এই আদেশের বিরুদ্ধে আবুল কালাম আজাদ ১২ জুন হাই কোর্টের চেম্বার আদালতে একটি আবেদন করেন। শুনানি শেষে আদালত আট সপ্তাহের জন্য আদেশটি স্থগিত করে। এরপর খয়রাত হোসেন চেম্বার আদালতের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবেদন করেন। সেই মামলা এখনও চলমান আছে।

অপর দিকে আবুল কালাম আজাদ সভাপতির দায়িত্ব পেয়ে ২০২২ সালের ৭ মে ডাকযোগে কলেজের অধ্যক্ষ আবুজার রহমানকে অপসারণের চিঠি পাঠান। তিনি প্রভাষক মিজানুর রহমানকে কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগের কথা জানান। তখন অপসারণের চিঠি অবৈধ দাবি করে মামলা করেন অধ্যক্ষ আবুজার রহমান।

শিক্ষক-কর্মচারীরা আরও বলেন, দায়িত্ব পেয়ে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান গত বছরের ৭ জুলাই শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা উত্তোলনের জন্য হাই কোর্টে একটি রিট আবেদন করেন। আদালত মিজানুর রহমানকে গভর্নিং বডির সভাপতির স্বাক্ষরে বেতন-ভাতা প্রদানের অনুমতি দেন।

এরপর ২৪ জুলাই অধ্যক্ষ আবুজার রহমান ওই আদেশের বিরুদ্ধে চেম্বার আদালতে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আবেদন করেন। আদালত ইউএনও এবং সভাপতির যৌথ স্বাক্ষরে বেতন-ভাতা উত্তোলনের আদেশ দেন। কিন্তু ইউএনও তাতে স্বাক্ষরে অপারগতা প্রকাশ করেন। সে থেকে বন্ধ রয়েছে শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা।

এ প্রসঙ্গে দৈনিক অধিকারকে জলঢাকা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ময়নুল ইসলাম জানান, পরিচালনা কমিটির মেয়াদ পূর্তির আগেই পরিবর্তনের জেরে দুই সভাপতির বৈধতার চ্যালেঞ্জে আদালতে মামলা এবং কলেজের অধ্যক্ষের পদ নিয়েও সমস্যার মধ্যে চলমান দুপক্ষের পাল্টাপাল্টি মামলায় বেতন-ভাতার চেকে সই হচ্ছে না।

নির্বাহী কর্মকর্তা আরও জানান, আদালত একবার সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন, ইউএনও এবং সভাপতির স্বাক্ষরে বিল দিতে। কিন্তু এখানে দুইজন সভাপতি হওয়ায় আমি কার স্বাক্ষর নেব? আদালত আমার একক স্বাক্ষরে বিল দিতে বললে আমার স্বাক্ষর করতে কোনো সমস্যা নেই।

কলেজের মনোবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক আবুল কালাম আজাদ দৈনিক অধিকারকে বলেন, আমরা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পড়াই। রাজনীতি করতে যাইনি। কিন্তু রাজনীতির শিকার হয়ে এখন আমরা মানবেতর জীবন কাটাচ্ছি।

কলেজের প্রদর্শক মো. মোজাহারুল ইসলাম বলেন, আগে বেতন-ভাতা নিয়মিত থাকলেও সভাপতি পরিবর্তনের পর থেকে বন্ধ রয়েছে। এখন দুই সভাপতির ক্ষমতার যাঁতাকলে পিষে মরছি আমরা। বেতনের অভাবে ধার-দেনা করে সংসার চালাতে হচ্ছে আমাদের।

বেতনহীন অবস্থায় গত বছরের ১৫ অগাস্ট হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে রসায়ন বিভাগের প্রভাষক মোসলেম উদ্দিন এবং ৬ অক্টোবর অফিস সহকারী ছবিল উদ্দিনের মৃত্যু হয়। দুই পরিবারের সদস্যরা অতি কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন বলে জানান তাদের সহকর্মীরা।

এ প্রসঙ্গে দৈনিক অধিকারকে আওয়ামী লীগ নেতা আবুল কালাম আজাদ বলেন, অবৈধ নিয়োগের মাধ্যমে কলেজের অধ্যক্ষ হয়েছেন আবুজার রহমান। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় তাকে বরখাস্ত করেছে। আবুজার রহমানের করা মামলার কারণে শিক্ষক-কর্মচারীরা বেতন-ভাতা তুলতে পারছেন না।

তিনি আরও জানান, অবৈধভাবে অধ্যক্ষ নিয়োগ দেওয়ায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় তদন্ত করে অধ্যক্ষ আবুজার রহমানকে অপসারণ এবং সভাপতি অধ্যাপক খয়রাত হোসেনকে বাদ দেওয়ার জন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে অনুরোধ জানায়। সেই পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় খয়রাত হোসেনের পরিবর্তে আমাকে সভাপতির দায়িত্ব দিয়েছে। শিক্ষক- কর্মচারীদের বেতনের জন্য আমি হাই কোর্টে ছয়টি মামলা চালাচ্ছি।

এ ব্যাপারে 'অধ্যক্ষ'আবুজার রহমান বলেন, কলেজের নিয়মিত গভর্নিং বডির মেয়াদ আগামী ৫ মার্চ পর্যন্ত আছে। এ অবস্থায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ গত বছরের ৩১ মার্চ শুধুমাত্র কমিটির সভাপতি পরিবর্তন করেন। এরই মধ্যে গভর্নিং বডির সভা না করেই আবুল কালাম আজাদ ডাকযোগে একটি পত্র প্রেরণের মাধ্যমে আমাকে অপসারণ করে কলেজের প্রভাষক মিজানুর রহমানকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব প্রদান করেন, যা অনিয়মতান্ত্রিক।

কলেজ পরিচালনা কমিটি কখনই একজন অধ্যক্ষকে অপসারণ করতে পারেন না। অধ্যক্ষকে অপসারণ করতে হলে তিনটি সভা আহ্বান এবং তিনবার কারণ দর্শানো নোটিশ (শোকজ) দিতে হবে। প্রত্যেক সভার কার্যবিররণী এবং সদস্যদের স্বাক্ষর থাকতে হবে। এরপর সরকারি কলেজেরে একজন অধ্যক্ষকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি হবে।

অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগের যাবতীয় তথ্য-প্রমাণের কাগজপত্র তদন্ত কমিটির প্রতিটি সদস্য ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাতে হবে। এ নিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট অধিবেশনে বিষয়টি উপস্থাপন করবে। সেখানে অধ্যক্ষ আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাবেন। তারপর যাচাই-বাছাই শেষে অধ্যক্ষকে অপসারণ করবে সিনেট।

সভাপতির দায়িত্বে থাকা আবুল কালাম আজাদের বিরুদ্ধে কলেজ তহবিলের টাকা অবৈধভাবে উত্তোলনের অভিযোগ করে আবুজার রহমান দৈনিক অধিকারকে বলেন, কলেজের যাবতীয় দাপ্তরিক কাজ আমি পরিচালনা করছি। আবুল কালাম আজাদের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে দীর্ঘ ১১ মাস থেকে শিক্ষক-কর্মচারীরা বেতন-ভাতা থেকে বঞ্চিত হয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এবং উপেক্ষা করে দায়িত্বে থাকা সভাপতি একক সিদ্ধান্তে আমাকে অধ্যক্ষ পদ হতে অব্যাহতি দিয়েছেন। যা অবৈধ এবং আইনের পরিপন্থি।

এ ব্যাপারে মীরগঞ্জ হাট ডিগ্রি কলেজের ‘ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ' মিজানুর রহমান দৈনিক অধিকারকে বলেন, কলেজ পরিচালনা কমিটি আমাকে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। আমি ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে কলেজের যাবতীয় দাপ্তরিক কাজ পরিচালনা করছি। এখানে আবুজার রহমানের কোনো উপস্থিতি নেই।এখানে কলেজ পরিচালনা কমিটি মিটিং করেছে কি-না। নিয়মনীতি অনুসরণ করেছে কি-না সেটা আমার জানার বিষয় না।

মিজানুর রহমান আরও বলেন, আবুজার রহমান মীরগঞ্জ হাট ডিগ্রি কলেজের এখন কেউ নন। একসময় আবুজার রহমান কলেজের প্রভাষক ছিলেন। হঠাৎ করে ২০২১ সালের ১ এপ্রিল কলেজের অধ্যক্ষ পদে আসীন হন। এরপর তিনি প্রভাষক পদ থেকে অব্যাহতি গ্রহণ করেন। ওই সময় ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্বে থাকা আব্দুস সাত্তার আবুজার রহমানের অধ্যক্ষ পদ চ্যালেঞ্জ করে আদালতে একটি মামলা করেন। ওই মামলার মাধ্যমে আমি জানতে পারি, আবুজার রহমান ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে নিয়োগ নিয়েছেন। এ ছাড়া মাউশির একটি তদন্তেও তার নিয়োগ ভুয়া বলে প্রমাণিত হয়েছে।

কলেজ পরিচালনা কমিটির সদস্য মো. মাহবুবার রহমান দৈনিক অধিকারকে বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আবুল কালাম আজাদকে সভাপতি মনোনয়ন প্রদান করার পর থেকে কলেজটির অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়। এই সময়ে পরিচালনা কমিটির কোনো সভা অনুষ্ঠিত হয়নি।

মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা রংপুর অঞ্চলের উপ পরিচালক (কলেজ) মো. উমর ফারুক দৈনিক অধিকারকে বলেন, দুই অধ্যক্ষ আর দুই সভাপতি এসেছিল কিন্তু দুই পক্ষে কোনো পক্ষ ছাড়া দিতে রাজি নয়। আঞ্চলিক কার্যালয়ের সাথে বিল শাখার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। ওনারা মাউশির সাথে পরামর্শ করে বিষয়টি সমাধান করতে পারে। আর যেহেতু হাইকোর্টে বিচারাধীন রয়েছে আমাদের কিছু করার থাকে না। আমাদের আদালতের ফলাফলের অপেক্ষা থাকতে হবে।

আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড