আবুল মনছুর, হাটহাজারী (চট্টগ্রাম)
ছয় বছরের মুছা ঘরে ঘুমিয়ে ছিল পাশে ছিল বোন হাবিবা আকতার। যার বয়স মাত্র দেড় বছর। সবে মাত্র মুখে বুলি ফুটেছে বাবা ডাকে। হঠাৎ রান্না ঘরে লাগা আগুন মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে পুরো ঘরে। জেগে উঠে মুছা ঘরে আগুন দেখে বোনকে টেনে বের করতে চাইলেও পারেনি রুমে ছড়িয়ে পড়া আগুন ধরে যায় বোনের গায়ে।
ঘরের বেড়ার দরজা ভেঙে দৌড় দেয় পুকুর পাড়ে মায়ের কাছে। কাঁদতে কাঁদতে মাকে বলে- ‘মা; হাবিবার গায়ে আগুন’ বাঁচাতে মাসহ পুরো কলোনির মায়েরা এক যোগে দৌড় কিন্তু ততক্ষণে কলোনির সব রুমসহ দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে হাবিবার দেহ।
আগুনের লেলিহান শিখার কাছে সবাই থেমে যায়। বুক চাপড়াতে থাকে হাবিবার ‘অভাগিনী মা’! আগুন নিয়ন্ত্রণের পর ঘরের মাটিতে খুঁজে পায় হাবিবার অঙ্গার দেহ। দেহে কোনো কাপড় নেই। নেই এক টুকরো মাংস। পড়ে আছে অবশিষ্ট কিছু হাড়। সেগুলো নিয়েই পার্শ্ববর্তী একটি কবরস্থানে কবর দেয়া হয়।
ভীষণ মর্মান্তিক ঘটনাটি গত শুক্রবার ঠিক বিকাল তিনটায় হাটহাজারী উপজেলার দক্ষিণ বুড়িশ্চর ৮ নং ওয়ার্ডস্থ তালতলা এলাকার নাজিম কলোনিতে ঘটেছে।
সরেজমিনে নিহত শিশুর পিতা ভ্যানচালক ইয়াছিন, নিহতের ভাই মুছা মর্মান্তিক এ ঘটনার বর্ণনা দেন। বর্ণনার এক পর্যায়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন নিহতের হতভাগা পিতা। পুত্র হারানোর শোকে পাগলপ্রায় নিহতের মা। নাওয়া খাওয়া বন্ধ তাদের। কথা হয় ক্ষতিগ্রস্ত অন্যান্য পরিবারের সাথে। জানা গেছে ক্ষতিগ্রস্ত সব পরিবারই হতদরিদ্র। দিনে আনে দিনে খায়। আগুনের থাবায় সব হারিয়ে নিঃস্ব তারা। মানবেতর জীবনযাপন করছে খোলা আকাশের নিচে। ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে চুয়ান্ন বছরের বিউটি জানান।
কলোনির পুকুর সেচ দেয়ায় সব মহিলারা পুকুর পাড়ে ছিল। পুকুর থেকে মাছ ধরার দৃশ্য দেখছিল। এর মধ্যে ইয়াছিনের ছেলে মেয়ে ঘরে ঘুমন্ত ছিল। হঠাৎ তারা আগুন দেখতে পায়। ইয়াছিনের ছেলেটি কাঁদতে কাঁদতে দেড় বছরের হাবিবার কথা বলছিল কিন্তু কেউই পাশে ঘেঁষতে পারেনি আগুনের তীব্র তাপের মুখে উল্টো পুকুর পেরিয়ে জমিনের দিকে যেতে বাধ্য হয়। একে একে পুড়ে যায় সাত পরিবারের বসতঘর ও দোতলায় অবস্থিত একটি মুরগির ফার্ম। একটি কানাকড়ি বের করতে পারেনি। চোখের সামনে সব পুড়ে ছাই।
তিনি বলেছেন, তার নিজ বাড়ি বরিশাল। ঘটনার দিন বিকেলে বরিশালের উদ্দেশ্য যাওয়ার কথা। বাড়িতে বাড়ির কাজ ধরবে এ জন্য কিছু জমানো টাকা নগদ ৩০ হাজার কিছু কাপড়চোপড় গুছিয়ে রাখছিলেন। আগুন সব কেড়ে নিল। যেভাবে কেড়ে নিয়েছিল তার বড় ছেলেকে। বেশ কয়েক বছর আগে অক্সিজেন এলাকার কেডিএস গার্মেন্টসে আগুনে ঝলসে নিহত হয়েছিল। এ কথা বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন বিউটি বেগম।
প্রত্যক্ষদর্শী ব্যবসায়ী শামসুল আলম বলেন, ঠিক তিনটায় আগুন ধরে পনের মিনিটে শেষ। পুকুর ও বিল থেকে পানি ও কাঁদা দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। তবে পাশের ঘর কোনমতে রক্ষা করা হয় পরে কালুরঘাট ও হাটহাজারীর চারটি গাড়ি এসে আগুন নিয়ন্ত্রণে এনে বাকী ক্ষয়-ক্ষতি থেকে রক্ষা করে। রাস্তার অবস্থা নাজুক হওয়ায় ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি যথাসময়ে যথাস্থানে আসতে পারেনি। অনেক দুর থেকে পানি ছিটিয়ে কাজ করে।
ভ্যানচালক ইয়াছিন (৩০) ছাড়াও অন্যান্য ক্ষতিগ্রস্তরা হলেন- রাজমিস্ত্রি হাবিব (৩৬), গৃহকর্মী বিউটি (৫৪), দিনমজুর রুহুল আমিন (৩৩), দিনমজুর হারুন (৩৫), গার্মেন্টস শ্রমিক শামিম (২৯), মন্নান (২৫) ও মুরগির ফার্মের মালিক গোলাফ সওদাগর (৪২)।
ইয়াছিনের রান্নাঘরের লাকড়ির চুলা থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে বলে ধারনা ক্ষতিগ্রস্ত, প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয়দের ধারণা। ভয়াবহ এ অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ২০ লক্ষ টাকার ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে বলেও জানান তারা। এদিকে ঘটনার পর পর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. শাহিদুল আলম নিহতের দাফনকর্ম সারাতে তার পরিবারকে জেলা প্রশাসকের নির্দেশনায় নগদ ২৫ হাজার টাকা প্রদান করেন।
একইসাথে অন্যান্য পরিবারকে নগদ দুই হাজার টাকা ও কম্বল বিতরণ করেন। তবে ঘটনার পর সমাজের অনেকেই চাল, ডাল, শুকনো খাবার বিতরণ করেন। তবে তাদের থাকার মত কোন আশ্রয় না থাকায় দ্রুত ঘরগুলো তৈরি করে দিলে উপকৃত হবে। তৈরি হবে মাথা গোঁজার একটু ঠাই।
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড