মনিরুজ্জামান, নরসিংদী
প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতসহ দেশ-বিদেশের বিখ্যাত বাউল-সাধকদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠেছে নরসিংদীর সাতশ বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী বাউল মেলা। আত্মশুদ্ধি আর আত্বমুক্তির লক্ষ্যে বাউলদের কীর্তন, গীতা পাঠসহ সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিভিন্ন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে সরব হয়ে উঠেছে মেঘনা পাড়ের এই বাউল আঁখড়াধাম।
বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে মানব ধর্ম ও সাম্যের জয়ধ্বনি করছেন বাউলরা। দেশ-বিদেশে ভক্তদের উপস্থিতিতে বাউল ঠাকুরের আখড়া ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণী পেশার মানুষের মিলন-মেলায় পরিণত হয়েছে।
গত রবিবার (৫ ফেব্রুয়ারি) রাতে নরসিংদী শহরের কাউরিয়া পাড়ায় মেঘনা নদীর তীরে প্রায় ৭শত বছরের পুরনো বাউল আখড়া নামে প্রথম আলো প্রজ্বলনের মাধ্যমে ঐতিহ্যবাহী এ মেলা শুরু হয়। এরই মধ্যে দেশ বিদেশের কয়েক শতাধিক বাউল সাধক ও ভারত শ্রোতা বাউল মেলায় এসে সমবেত হয়েছেন। পাঁচ দিনব্যাপী এই মেলা চলবে আগামী ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। আগামী বুধবার এর প্রসাদ বিতরণ করা হবে বলে জানিয়েছেন মেলা কর্তৃপক্ষ।
গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় সরেজমিনে দেখা যায়, মেলা উপলক্ষে মেঘনার পাড়ে শিশুদের হরেক রকমের খেলনা, খাবারসহ বিভিন্ন পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন ব্যবসায়ীরা।
বাউল ঠাকুরের আখড়াবাড়ি সূত্রে জানা গেছে, প্রতি বছরই মাঘী পূর্ণিমার দিনে শ্রী চৈতন্য দেবের জন্ম তিথী উপলক্ষে এই মহাযজ্ঞের আয়োজন করা হয়। প্রায় ৭শত বছরের ঐতিহ্যবাহী এই মেলাকে ঘিরে নরসিংদীর কাউরিয়া পাড়া এলাকার মেঘনা নদীর তীরে সমাগম ঘটে লক্ষাধিক নারী-পুরুষের। নদীতে চলে পুণ্যস্নান। পাশেই রয়েছে বাউল ঠাকুরের আখড়া।
যেখানে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বাউল শিল্পীরা এসে বাউল গানের আসর সাজায়। মেলাকে ঘিরে মেঘনা নদীর পার ঘেঁষে জমে উঠেছে খেলনা, কুটির শিল্প, মৃৎশিল্প, কাঠ-বাঁশ ও মাটির তৈরি কুটির শিল্প সামগ্রীর হরেক রকম দোকানের পসরা। এছাড়াও শিশুদের আকৃষ্ট করতে মেলায় বসেছে পুতুল নাচ, নাগর-দোলাসহ নানা বিনোদন মূলক রাইডস।
এ দিকে বাউল ভক্তরা সারি বেঁধে মহাযজ্ঞানুষ্ঠানে ঘি-প্রদীপ, মোমবাতি ও আগরবাতি জ্বালিয়ে পুজো দিচ্ছে আর প্রার্থনা করছে পরিবার ও দেশের সকল মানুষের কল্যাণসহ যত ধরনের অশুভ শক্তি, অসাম্প্রদায়িকতা ও বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সর্বোপরি করোনা ভাইরাস থেকে নিষ্কৃতি পেতে।
প্রায় ৭শত বছর ধরে চলে আসছে এই বাউল উৎসব। কথিত আছে, ৭শত বছর আগে নরসিংদীতে এক বাউল ঠাকুর ছিলেন। তিনি নিজেকে শুধু বাউল বলেই পরিচয় দিতেন। এ জন্য ঐ বাউল ঠাকুরের প্রকৃত নাম এখানকার কারো জানা নেই। সেই বাউল ঠাকুরের স্মরণে তার আখড়া ধামে দীর্ঘ ৭শত বছর ধরে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে এই বাউল মেলা। তবে কে প্রথম এখানে বাউল মেলার আয়োজন করেন তার প্রকৃত তথ্য কারোই জানা নেই।
সর্বশেষ ব্রিটিশ শাসনামল থেকে এখন পর্যন্ত মেলার আয়োজন করছেন স্বর্গীয় মনিন্দ্র চন্দ্র বাউলের পরিবার। বর্তমানে এই মেলায় আয়োজকদের মধ্যে রয়েছেন মনিন্দ্র চন্দ্র বাউলের পরিবারের সদস্য শীর্ষেন্দু বাউল পিন্টু, মলয় বাউল রিন্টু ও স্বপন বাউল।
বাউল ভক্ত ও দর্শনার্থী জানায়, এ আখড়ায় বাউল ঠাকুরের অন্তর্ধান হয়েছিল। বাউল আখড়ায় জগন্নাথ দেবতার মন্দির রয়েছে। মন্দিরে মহাবিষ্ণুর পূর্ণাঙ্গ প্রতিমা, জগন্নাথ দেবতার প্রতিমা, মা গঙ্গার (৩৩ কোটি দেবতার) গট, নাগ দেবতার বিগ্রহ ও শিবলিঙ্গ রয়েছে, যা বাউল ঠাকুর নিজে প্রতিস্থাপন করে গেছেন বলে কথিত রয়েছে। পাশে রয়েছে বাউল ঠাকুর ও মাতাজির সমাধি মন্দির।
সবার মধ্যখানে রয়েছে উপাসনার জন্য বিশাল আটচালা বৈঠক ঘর। বুধবার দেবতা ব্রহ্মার পূজা মহাযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়। মহাযজ্ঞে জগতের কল্যাণের জন্য ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবের পূজা করা হয়। ঠাকুরের কাছে দেশ ও মানুষের কল্যাণে প্রার্থনা করা হয়।
এ দিকে বাউল মেলা উপলক্ষে দেশের নানা প্রান্ত থেকে ব্যবসায়ীরা বাঙালির চিরচেনা মুখরোচক খাবার ও বাহারি পণ্য নিয়ে হাজির হয়েছেন। এসব খাবারের মধ্যে রয়েছে আমিত্তি, জিলেপি, সন্দেশ, বারো মিঠাই, দই, মুড়ালি, গুড়ের তৈরি মুড়ি ও চিড়ার মোয়া, তিলের মোয়া, তিলের সন্দেশ, খাস্তা, কদমা, নারকেলের নাড়ু, তিলের নাড়ু, খাজা, গজা, নিমকি, মনাক্কা, গাজরের হালুয়া, পিঠাসহ রকমারি খাবার। এছাড়া শিশুদের খেলনা, ঘরের তৈজসপত্র, আসবাবপত্র, বিভিন্ন ধরনের তৈরি পোশাক, মাটি ও বাঁশের তৈরি জিনিসপত্রসহ নানা ধরনের পণ্যের স্টল নিয়ে বসেছেন ব্যবসায়ীরা।
মেলার আয়োজক ও নরসিংদী বাউল আঁখড়াধাময়ের সেবায়েত শ্রী শীর্ষেন্দু বাউল পিন্টু জানান, জীবের মঙ্গলার্থে বাউল ঠাকুরের আবির্ভাব হয়েছিল। কিভাবে সহজে মানুষ নিজেকে চিনতে পারবে সেই পথ তিনি দেখিয়ে গেছেন। আমরা তার পথ অনুসরণ করে ভেদাভেদ ভুলে ঈশ্বরের সৃষ্টিকে ভালোবেসে যাচ্ছি।
জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণিপেশার মানুষের মিলন ঘটানোর জন্যই প্রতি বছর এ মেলার আয়োজন করা হয়ে থাকে বলে ও জানান তিনি।
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড