তুষার আহমেদ, নারায়ণগঞ্জ
শীতলক্ষ্যায় মাছের পোনা অবমুক্তকরণ কর্মসূচিতে গত শনিবার দুপুরে জড়ো হন বিএনপির একদল নেতাকর্মী। ড্রামে থাকা জীবিত পোনাগুলো একে একে ছাড়া হচ্ছিল নদীতে। ছোট্ট ড্রাম থেকে নদীতে ছাড়া পেয়ে পোনাগুলোর প্রাণোচ্ছ্বাস বাড়বে- এমনটা প্রত্যক্ষ করার বাসনায় ছিলেন সকলেই।
তবে দেখা গেলো এর বিপরীত ও হৃদয় বিদারক এক দৃশ্য। লক্ষ্যায় গা ভাসাতেই কাতর হয়ে উঠে পোনাগুলো; যেন ফিরে আসার আকুতি জানাচ্ছিল দুর্লভ অঙ্গ-ভঙ্গিতে। প্রাণহীন এই নদীতে সদ্য ছাড়া পাওয়া প্রাণগুলো খুব বেশিক্ষণ টিকেও থাকতে পারেনি। অতিমাত্রায় দূষিত শীতলক্ষ্যার পাড়েই মৃত পোনাগুলো ভেসে উঠে একে একে।
জানা গেছে, প্রাচ্যের ডান্ডি খ্যাত নারায়ণগঞ্জের বুক চিরে বয়ে যাওয়া শীতলক্ষ্যার দৈর্ঘ্য ১০৮ কিলোমিটার। গড়ে ২২৮ মিটার প্রস্থের এই শীতলক্ষ্যা দেশের বাণিজ্যিক ক্ষেত্রেও অবদান রেখে চলেছে যুগের পর যুগ। যেই নদীর ভিত্তিতে একসময় সচল ছিল দেশের অর্থনীতির চাকা, সেই নদীই শুষ্ক মৌসুমে হয়ে উঠে নিষ্প্রাণ। অতি নির্মল সুস্বাদু হওয়ায় যেই নদীর সুনাম ছিল ইংরেজ বনিকদের মুখেও, সেই নদীই এখন বিষে পরিণত হয়েছে।
কল-কারখানায় সমৃদ্ধ নারায়ণগঞ্জের টাইটেল এখন ‘শিল্পনগরী’। তথ্য বলছে, অধিকাংশ কারখানাগুলোতে নেই ইফলুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (ইটিপি) বা বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ স্থাপনা। কোনো কোনো কারখানায় ইটিপি থাকলেও তা ব্যবহার করা হচ্ছে না। তাই কারখানার বিষাক্ত তরল বর্জ্য পরিশোধন ছাড়াই ফেলা হচ্ছে নদীতে। ডাইং, প্রিন্টিং, কয়েল ও পেপার মিলসহ অজস্র কলকারখানার কেমিক্যালযুক্ত তরল বর্জ্যে ভয়ানক ভাবে দূষিত এই নদী এখন ‘প্রাণহীন’। মৃত এই লক্ষ্যায় প্রাণ দেবে কে, সেই প্রশ্ন জোড়াল হচ্ছে সচেতন মহলে।
প্রাপ্ত তথ্য মতে- নদীতে জলজ প্রাণী বাঁচার জন্য প্রতি লিটারে ৪ মিলিগ্রাম দ্রবীভূত অক্সিজেন প্রয়োজন। কৃষি বা অন্যান্য কাজে ব্যবহারের জন্য এর প্রয়োজন পড়ে লিটারে ৫ মিলিগ্রাম। আর ৬ মিলিগ্রাম না থাকলে তা শোধনের অযোগ্য বলে বিবেচিত হয়। যদিও সমীক্ষা বলছে, শুষ্ক মৌসুমে লক্ষ্যার পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ নেমে আসে একেবারেই শূন্যের কোঠায়। অর্থাৎ শীত মৌসুমে লক্ষ্যার দূষিত পানিতে থাকে না কোনো অক্সিজেন। তাই নদীতে মাছ তো বটেই, হুমকির মুখে অন্যান্য জলজ প্রাণীও। গতকাল শীতলক্ষ্যায় পোনা অবমুক্ত করায় এর প্রমাণ মিলল আরও একবার।
একদা যেই নদী নিয়ে ইংরেজরাও গর্ব করতেন, কালের বিবর্তনে সেই নদী নিয়েই আক্ষেপ শোনা যায় দেশের মানুষের মুখে। তবে নদী রক্ষায় এখনো কার্যকরী উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি সংশ্লিষ্টদের।
গত শনিবার বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু শীতলক্ষ্যায় পোনা মাছ অবমুক্ত করার সময় নদীর পানি দেখে হতাশা প্রকাশ করে বলেন, মৎস্যজীবী দলের পক্ষ থেকে শীতলক্ষ্যায় মাছের পোনা অবমুক্ত করেছি। কিন্তু এ পোনাগুলো বাঁচবে কী-না আল্লাহ জানেন। নদীগুলোর পানি দূষিত। এ বিষয়ে সরকার বা প্রশাসনের কোনো নজর নেই।
জানতে চাইলে মহানগর বিএনপির আহবায়ক অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান বলেন, শীতলক্ষ্যায় রুই কাতল ও কার্ফু মাছের পোনা অবমুক্ত করা হয়। মাছগুলো জীবিত এবং ভালো জাতের আনা হয়। কিন্তু নদীতে যখন মাছগুলো ছাড়া হয়, তখন মাছ আর পানির দিকে যাচ্ছিল না। পানি দূষিত হওয়ায় অক্সিজেনের অভাবে মাছগুলো উপরের দিকে মাথা দিয়ে শ্বাস নিচ্ছিল। অনেক মাছ নদীতে মারা গেছে। শীতলক্ষ্যার পানি এখন বিষে পরিণত হয়েছে। এই পানি এখন কোন কিছুর জন্যই ব্যবহার উপযোগী নয়। সরকারের সংশ্লিষ্টদের এই বিষয়ে নজর দিতে হবে।
এ দিকে শীতলক্ষ্যার পানি দ্রুতই দূষণমুক্ত করার তাগিদ দিয়ে নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি অ্যাড. মাহবুবুর রহমান মাসুম বলেন, আমার মতে নদী দূষণমুক্ত করার দায়িত্ব নৌবাহিনীকে দেয়া উচিৎ। এছাড়া সিটি করপোরেশনেরও দায়িত্ব নিতে হবে। সেটা হচ্ছে ডাইং কারখানার তরল বর্জ্যগুলো যেন একটি সেন্ট্রালে আসে, সেই ড্রেনেজ ব্যবস্থা করে, সেখানে সেন্ট্রাল ইটিপি স্থাপন করা। যেন ওই সেন্ট্রাল ইটিপি’র মাধ্যমে দূষিত পানিগুলো পরিশোধন হয়ে তারপর নদীতে নির্গত হয়। তাহলেই শীতলক্ষ্যাকে বাঁচানো সম্ভব।
এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক আব্দুল্লাহ আল-মামুন বলেন, কলকারখানার দূষিত তরল বর্জ্য পরিশোধন ছাড়াই নদীতে ফেলা হচ্ছে। প্রতিটি কারখানায় যেন ইটিপি স্থাপন করা হয় এবং ইটিপিগুলো যেন সঠিক ভাবে ব্যবহার করা হয়, সেই জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, নারায়ণগঞ্জে যদিও কাজ করার জন্য আমাদের পর্যাপ্ত লোকবল নেই। এরপরও আমরা সমস্যা সমাধানের জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছি। সেন্ট্রাল ইটিপির বিষয়ে আলোচনা হয়েছিল। এটা বেশ ব্যয় বহুল। যেহেতু সমস্যা গুলো একদিনে তৈরি হয়নি, সেহেতু একদিনেই তা সমাধানের আশাও করা যায় না।
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড