• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৮ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

বীরাঞ্চল ডাকাতিয়া 

  শফিয়েল আলম সুমন, ময়মনসিংহ

২৪ ডিসেম্বর ২০২২, ১৬:২০
বীরাঞ্চল ডাকাতিয়া 

স্বাধীনতার মহান স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭১ সালে ৭ মার্চ ভাষণের পর থেকে বাংলার আপামর জনগণ যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। যুদ্ধের জন্য নিরাপদ আশ্রয় এবং প্রশিক্ষণ ছিল অত্যাবশ্যকীয়।

বাংলার দামাল ছেলেরা শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে ছুটতে থাকে তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে। ময়মনসিংহের ভালুকার ডাকাতিয়া এমন একটি ইউনিয়ন যা বন জঙ্গলে আচ্ছাদিত একটি বিরান ভূমি। মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রতিটি বাড়িই ছিল আশ্রয় কেন্দ্র এক দিকে আফসার বাহিনী অন্যদিকে কাদেরিয়া বাহিনী দু-বাহিনী এ ইউনিয়ন কে এমন ভাবে নিরাপদে রেখেছিল এখানে পাকিস্তানি সৈন্য আসলেও বারবার পরাজিত হয়েছে এ দু-বাহিনীর কাছে।

যুদ্ধ শুরু লগ্নে অত্র ইউনিয়নের চেয়ারম্যান-মেম্বারগণ পদত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের শাসন ব্যবস্থা কায়েম করেছিল। ঢালুয়া পাড়ায় গড়ে উঠেছিল আফসার বাহিনীর সদর দপ্তর। দৌলার আজাদ নগর থেকে প্রকাশিত হতো বীর মুক্তিযোদ্ধা এস এ কালামের সম্পাদনায় “জাগ্রত বাংলা” পত্রিকা। ডাকাতিয়ার অধিকাংশ খোলা মাঠ ব্যবহৃত হয়েছে ট্রেনিং সেন্টার হিসেবে।

যুদ্ধের প্রাক্কালে ডাকাতিয়াকে উত্তর ও দক্ষিণ দু ভাগে ভাগ করা হয়েছিল বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং আশ্রিতদের খাবার, বাসস্থানের জন্য। উত্তরে দায়িত্ব প্রাপ্ত ছিল মরহুম আমজাদ হোসেন এবং দক্ষিণে ছিল মরহুম হুরমুজ আলী সরকার। উনাদের নেতৃত্বে বিভিন্ন বাড়ি থেকে চাল, ডাল সংগ্রহ করা হতো একেক দলে ছিল ২০ থেকে ৩০ জন।

ডাকাতিয়ার সর্বস্তরের লোকজন মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে থেকে বিভিন্ন কাজ পরিচালনা করেছেন। ধনী ব্যক্তিরা যোগান দিয়েছেন বাসস্থান আহারের, এমনকি বাড়ি বাড়ি ঘুরে চাল সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার সংগ্রহ করার খবর পেয়েছি। এ ইতিহাস ভুলে যাবার নয় যা সত্যি ছিল মর্মান্তিক ও বেদনাদায়ক। নিজ আবাসন ছেড়ে দিয়ে ক্লান্ত মুক্তিযোদ্ধাদের থাকতে দিয়েছেন এমন ঘটনা ঘটেছে অহরহ।

মুক্তিযুদ্ধের সময় সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে ডাকাতিয়া আওয়ামী লীগের সভাপতি আহছান উদ্দীন সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতে প্রশিক্ষণে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। আরেক সম্মানিত ব্যক্তি আব্দুর রহমান বি এ। যিনি অত্র ইউনিয়নের প্রথম বি এ পাশ দ্বারী ব্যক্তি। পেশায় ব্যবসায়ী হিসেবে থাকলেও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তখন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সরব উপস্থিতি ছিল।

অর্থাৎ ঐ সময় ছাত্রদের পরামর্শক অভিভাবক হিসেবে যার নাম টি আসেন তিনি হচ্ছেন ওমর আলী মাস্টার। মেজর আফসার এর পরিবার যুদ্ধকালীন সময় তার বাড়িতেই থেকেছেন। এছাড়া আরও বীর মুক্তিযোদ্ধা আ. খালেক, বীর মুক্তিযোদ্ধা আ. লতিফ প্রমুখ।

বিরামনগর জনমানবহীন লোকালয়। ঘন জঙ্গলে আবৃত। শাল, তমাল, আজুগি, সেগুন, মেহগনি, কড়ইসহ নানা রকম নাম না জানা ফলজ ও বনজ বৃক্ষে আচ্ছাদিত। বন্য প্রাণীর অবাধ বিচরণ, হাতি, বাঘ, ভাল্লুক, হরিণ, মহিষ, শিয়াল, হনুমান, বানর, বেজি, সাপসহ রয়েছে হিংস্র জানোয়ার, বিভিন্ন পাখ-পাখালি, ময়ূর, টিয়া, ঘুঘু, শ্যামা, দোয়েল, ময়না, শালিক।

বনে আছে অফুরন্ত সম্পদ, জাম, কাঁঠাল, ঢেওয়া,বউচি, অড়বড়ই সহ নানা ফলজ গাছ।

ব্রিটিশ এর আগে ধীরে ধীরে লোকালয় গড়ে উঠে, বন জঙ্গল থেকে কাঠ কেটে, ছন সংগ্রহ করে ঘরবাড়ি তৈরি হতে থাকে। গারো, হাজং এরাই হচ্ছে আদিবসতি। এখনো তাদের বংশধরদের এলাকায় পাওয়া যায়। মধুসেন ভাওয়াল গড়ে পশ্চিমাংশে পালিয়ে যায়, এবং সেই অঞ্চল শাসন করতে থাকে। এই মধুসেন নামানুসারে ভাওয়াল গড়ের নাম করণ হয় মধুপুর গড়।

কোম্পানির শাসনে জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠে। তারা কোনোভাবে কোম্পানির শাসন মেনে নিতে চায় না। ১৭৭১ খ্রিস্টাব্দে ফকির ও সন্ন্যাসীদের সমন্বয়ে গঠিত হয় ইংরেজ বিরোধী বিদ্রোহী বাহিনী যারা মধুপুর ভাওয়াল গড়ে আশ্রয় নেয়। এই বিদ্রোহীদের মধ্যে মোঘল সেনাবাহিনী থেকে অনেক সৈন্য এদের সঙ্গে যোগ দেয় এবং যুদ্ধ করে। ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দে এ বিদ্রোহ ঘনীভূত হয়। ইংরেজ শাসকগণ অনেক যুদ্ধে পরাজিত হয়। ইংরেজ কুটিগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।

ময়মনসিংহ সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ এক পর্যায়ে বিপ্লবে রূপ নেয়। প্রচুর রক্ত ক্ষয় হয়। ১৭৭১ খ্রিস্টাব্দে ভাওয়াল মধুপুর গড়ে এ বিদ্রোহীদের শক্তিশালী আস্তানা গড়ে উঠে। ফকির মজনু শাহ ছিলেন এ বাহিনীর প্রধান। বিদ্রোহীগণ কোনোভাবে সাধারণ জনগণের কোনো অর্থ সংগ্রহ করতো না বরং সহায়তা করতো। ইংরেজ বাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়।

মজনু শাহ এর বাহিনী এ লড়াইয়ে বহু ইংরেজ মারা যায়। ইংরেজ সেনাপতি ল্যাফল্যান্ট রভার্টসন যুদ্ধে গুরুতর আহত হন এবং নিরুপায় হয়ে পালিয়ে গিয়ে প্রাণ রক্ষা করেন। ইংরেজ বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়।

ফকির ও সন্ন্যাসী বিদ্রোহ স্বাধীনতা চেতনাকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যায় এবং মজনু শাহ ভাওয়াল ও মধুপুর গড়ে আস্তানা গড়ে তোলে। ইংরেজদের বারবার আক্রমণের ফলে ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহ ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়লে ইংরেজরা এই বীরদের ডাকাত বলে আখ্যায়িত করে। এ নামানুসারে ভাওয়াল গড়ের বিরামনগরের অংশ ডাকাতিয়া হিসেবে পরিবর্তিত হয়।

ভালুকার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এক সাহসী সৈনিক আফসার উদ্দীন আহমেদ গড়ে তোলেন আফসার বাহিনী । যিনি দেড় শতাধিক যুদ্ধের নায়ক হয়ে যুদ্ধে পাক হানাদার ও রাজাকার বাহিনীর মোকাবেলা করেন। তিনি নিজে ৭৫ টি যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। বাকিগুলো তাঁর নির্দেশে প্লাটুন কমান্ডার যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলেন।এই আফসার বাহিনীর সদর দপ্তর ছিল ডাকাতিয়া ঢালুয়াপাড়ায় কেরামত আলী খাঁর (ক্যামুখাঁ) বাড়ির মাটির ঘরে। এ ঘরে মেজর আফসার উদ্দিন আহমেদ বাস করতেন, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধের বিভিন্ন স্থানে পাঠাতেন এবং যুদ্ধ শেষে বীর মুক্তিযোদ্ধারা ফিরে আসতেন।

সড়ক বিহীন বন জঙ্গলে আচ্ছাদিত ডাকাতিয়া ইউনিয়নের এক বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধারা আশ্রয় নিত। খাদ্যের ব্যবস্থা করতো। সকলেই সহযোগিতা করেছিল বলেই প্রথম থেকেই এ ইউনিয়ন মুক্ত ছিল। এ মুক্ত এলাকা থেকেই প্রকাশ হতো জাগ্রত বাংলা পত্রিকা। বীর মুক্তিযোদ্ধা, স্থানীয়দেরকে উজ্জীবিত রাখতে জাগ্রত বাংলার ভূমিকা অন্যতম। মুক্তিযুদ্ধের মুখপত্র জাগ্রত বাংলা বীর মুক্তিযোদ্ধা এস এ কালামের সম্পাদনায় প্রকাশ হতো।

যুদ্ধকালীন সময়ে ২০ থেকে ৩০ জন ছাত্র দৌলার আজাদ ক্লাব,খাইলার বাইদ, তোরাব আলী বাড়ি,এবং বাদসা মিয়ার বাড়ি থেকে প্রকাশ করা হতো। পঞ্চম সংখ্যাটি প্রকাশ হয় কাদের সিদ্দিকীর অফিস থেকে। পত্রিকা প্রকাশের পর বিভিন্ন হাটে বিক্রি করা হতো তবে যুদ্ধকালীন সময়ে পাতাপির বাজার (জয়বাংলা বাজার) ছিল জমজমাট সেখানে পত্রিকা বিক্রি করে কাগজ কালি কিনে বাকি অর্থ দিয়ে চাল ডাল সবজি কেনা হতো।বীর মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধকালীন সময়ে মাছ খাওয়া এক রকম নিষিদ্ধ ছিল।

তারা শুধু সবজি খিচুরি আর মাঝে মাঝে মেজর আফসার সাহেব গো মাংস পাঠাতেন। জাগ্রত বাংলার ৫০ কপি পত্রিকা কিনে নিতেন মেজর আফসার উদ্দিন সাহেব ৫০ টাকা দিয়ে।এ পত্রিকা বিভিন্ন সেক্টরে পাঠিয়ে দিতেন এতে বীর মুক্তিযোদ্ধারা উৎফুল্ল হতো। এ বীর দের অনেক কিছুই আজো অধরা রয়ে গেছে।

তথ্য সূত্র : বীর মুক্তিযোদ্ধা এস এ কালাম (জাগ্রত বাংলার সম্পাদক) বীর মুক্তিযোদ্ধা আ. লতিফ (যুদ্ধ কালীন কমান্ডার) ও অত্র এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধাগন।

লেখক : শফিয়েল আলম সুমন, সাংবাদিক।

আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড