• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৭ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

নাগালের বাইরে খেজুরের গুড়ের দাম

মিলছে না গাছি, কমেছে গাছও

  জে রাসেল, ফরিদপুর

২১ ডিসেম্বর ২০২২, ১০:০৪
নাগালের বাইরে খেজুরের গুড়ের দাম
খেজুরের গুড় (ছবি : অধিকার)

ফরিদপুরের গ্রাম-গঞ্জে এক সময় রাস্তার দুই ধারে, নদ-নদীর পাড়ে ও বসতবাড়ির আঙ্গিনায় সারি সারি খেজুর গাছের দেখা মিলত। শীতের আগমনের আগে হেমন্তের মাঝামাঝিতেই এসব গাছ থেকে রস আহরণের কাজে ব্যস্ত হয়ে উঠতেন গাছিরা। পিঠে বাঁশের চটা দিয়ে বানানো খোল, তার মধ্যে গাছ কাটার ধারালো ছ্যান, তালের খোলা, পোড়া বালি। কোমরে দড়ির গোছা।

কাঁধে বাঁশের মোটা চটার দুই ধারে থাকতো রসে ভরা হাড়ি। শীত এলে এই দৃশ্য ছিল ফরিদপুরের গ্রাম-গঞ্জের বিভিন্ন এলাকার এক চিরচেনা দৃশ্য।

তবে সেই দৃশ্য এখন আর দেখা যায় না। যেই হারে খেজুর গাছ কাটা হচ্ছে, বিপরীতে নতুন করে গাছ না লাগানোর পাশাপাশি গাছি পেশায় নতুনদের আগ্রহ কম থাকায় এমনটি হয়েছে।

অন্য দিকে এই সুযোগে হাটেবাজারে সয়লাব হয়ে গেছে ভেজাল গুড়ে। চিনির চেয়ে কয়েকগুণ দাম বেড়ে বর্তমানে বাজারে খেজুর রসের খাঁটি গুড় এক কেজি পাঁচশো থেকে ছয়শ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

সারাদেশের মধ্যে দক্ষিণাঞ্চলের জেলা যশোরের মতোই ফরিদপুরেও খেজুরের রসের সুখ্যাতি রয়েছে। শীত এলেই খেজুরের গাছগুলো ঝুরে যৌবনবতী করে তুলতো গাছিরা। ধারালো কাঁচি দিয়ে গাছের ডগা ঝুরে নতুন বাকল বের করে গুঁজে দিতো রসের নল। সেখানে সন্ধ্যায় হাড়ি বসানোর পর পরেরদিন সকালে নামিয়ে আনতো রসে ভরা টইটুম্বুর হাড়ি। এরপর পথেঘাটে হেঁটে হেঁটে বিক্রি করতো সেই রস।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ফরিদপুরে প্রায় ২শ’ হেক্টর জমির উপর প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার খেজুর গাছ রয়েছে। এসব গাছ থেকে প্রায় ১৫শ’ ৫০ মে. টন রস হয়। যা থেকে পাওয়া যায় প্রায় আড়াইশো মে.টন গুড় পাওয়া। জেলায় সবচেয়ে বেশি খেজুর গাছ রয়েছে বোয়ালমারী ও নগরকান্দা উপজেলায় প্রায় ৩০ হাজারের মতো।

এর পরে রয়েছে ভাঙ্গায় প্রায় ১৪ হাজারের মতো। সদর উপজেলাতেও এ সংখ্যা ১২ হাজারের মতো। আর সালথা, মধুখালী, আলফাডাঙ্গা ও সদরপুরে, সালথায় কমবেশি ১০ হাজারের কাছাকাছি এবং চরভদ্রাসনে রয়েছে ৫ হাজারের বেশি। তবে বাস্তবে বর্তমানে খেজুর গাছের সংখ্যা এর চেয়ে অনেক কম বলে মনে করা হয়।

শহরের ডোমরা কান্দির মো. এনামুল হোসেন গিয়াস জানান, তিনি পরিচিতদের সুবিধার্থে প্রতি কেজি খেজুরের খাঁটি গুড় সর্বনিম্ন দর চারশো টাকা বিক্রি করছেন এবছর। অবশ্য বিভিন্নস্থানে খাঁটি গুড় ৫শ’ থেকে ৬শ’ টাকা দরে বিক্রিও হয় বলে জানা গেছে। আর ভেজাল গুড় প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে মাত্র দেড়শ থেকে তিনশো টাকা করে।

তিনি আরও জানান, গুড় ছাড়াও খেজুর গাছের পাতা মাদুর ও জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তবে যেই হারে খেজুর গাছ কাটা পড়ছে সে অনুপাতে লাগানো হচ্ছে না। ফলে সাম্প্রতিককালে খেজুর গাছের সংখ্যা ব্যাপক হারে কমেছে।

সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন বলেন, বিলুপ্তির হাত থেকে খেজুর গাছ রক্ষা করতে গ্রামের রাস্তার দুই পাশে ও অব্যবহৃত পতিত জমিতে খেজুর গাছ রোপণ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি উপযুক্ত প্রশিক্ষণ, আধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রণোদনা প্রদানের মাধ্যমে গাছিদের জীবনমান উন্নত করতে পারলে এ পেশার প্রতি তাদের আগ্রহ ধরে রাখা সম্ভব।

স্থানীয়রা জানান, আগে শীত মৌসুমে খেজুরের রসের সরবরাহ থাকায় গৃহস্থের বাড়িতে রস জ্বালানোর বড় চুল্লিতে গুড় তৈরির ধুম পড়ে যেতো। টিনের বড় থামালে রস জ্বালাতে জ্বালাতে ঘন হয়ে এলে তাতে বীজ মিশিয়ে খেজুরের ডগা দিয়ে এক কোনে অনবরত নেড়ে নেড়ে জমাট করে তৈরি হতো গুড়। এরপর সেই গুড় কাপড়ে মোড়ানো ছোট ছোট পাত্রের ছাঁচে ফেলে বানানো হতো পাটালি। পাশাপাশি তৈরি হতো ঝোলা গুড়।

তিনি জানিয়েছেন, শীতের আমেজে পিঠেপুলিতে ব্যবহৃত হতো পাটালি আর মুড়ি বা ছাতুর সাথে খাওয়ার জন্য রাখতো ঝোলা গুড়। তবে সেই চিত্র এখন প্রায় হারিয়েই গেছে।

রঘুয়ারকান্দী গ্রামের গাছি তৈয়ব মিয়া বলেন, গ্রামে খেজুর গাছ নেই বলে এখন আর গাছ ঝুড়েন না। আগে তিনি একাই প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০টি গাছ ঝুড়তেন। তখন বাজারে গুড়ের দামও ছিল কম। এখন গরিব মানুষের পক্ষে খেজুরের গুড় কিনে খাওয়া সম্ভব না। তবে বিপরীতমুখী বক্তব্য যদুনন্দী গ্রামের গাছি জয়নাল শেখের। তিনি জানান, তিনি এখনও প্রতিদিন ৭০ থেকে ৮০টি খেজুর গাছ কাটেন এবং এই রস জ্বালিয়ে ৩০ কেজির মত গুড় হয়। তবে কিছু লোক আমাদের থেকে গুড় কিনে নিয়ে তাতে চিনি ও রং মিশিয়ে ভেজাল গুড় তৈরি করে বলে শুনেছি।

ক্ষুদ্র গুড় ব্যবসায়ীরা জানান, ভেজাল গুড় তৈরির জন্য একশ্রেণির বড় মহল গড়ে উঠেছে। তারা বিভিন্নস্থান থেকে খেজুরের ঝোলা গুড় কিনে এনে তার সঙ্গে রং, আটা ও চিনি মিশিয়ে ভেজাল গুড় তৈরি করে। চিনির দাম কম হওয়ায় তারা এ সুযোগ নিচ্ছে। ছোট ব্যবসায়ীরা তাদের কাছ থেকে এসব গুড় কিনে এনে সরবরাহ করছে। তারা বলেন, আসল গুড়ের অর্ধেক দামে ভেজাল গুড় বিক্রি হচ্ছে।

ফরিদপুর জেলা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক সোহেল শেখ বলেন, এ ব্যাপারে তাদের নজরদারি রয়েছে। তবে বাজারে যারা গুড় বিক্রি করে তারা স্বীকার করে যে চিনি দিয়েই তারা গুড় বানান। ভেজাল গুড় তৈরির উৎসের কোন সন্ধান থাকলে তিনি তথ্য দিয়ে সহায়তার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ইতোপূর্বে বেশ কিছু ব্যবসায়ীকে জরিমানা করা হয়েছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ জিয়াউল হক বলেন, ইট ভাটায় কাঠ পোড়ানো বন্ধ থাকায় সাম্প্রতিক খেজুর গাছ নিধন কমেছে। তাই এবার জেলায় আগের বারের চেয়ে বেশি রস ও গুড় পাওয়া যাবে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে গাছিরা যাতে খেজুর গাছ কেটে রসের সদ্ব্যবহার করতে পারে সেজন্য তাদের উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। এতে ফরিদপুরের খেজুর গুড়ের ঐতিহ্য আবারও ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে আমি আশাবাদী।

আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড