মো. কবির হোসেন, কাপ্তাই (রাঙ্গামাটি)
আবহমান বাংলার চিরায়িত সংস্কৃতির অন্যতম একটি উপধান যাত্রাশিল্পী। সামাজিক, ঐতিহাসিক, লোককাহিনী এবং ধর্মীয় প্রেক্ষাপটের উপর রচিত যাত্রাপালায় মানুষের সুখ দুঃখের গল্প, পৌরাণিক ইতিহাস, জীবনবোধ, ধর্মীয় মূল্যবোধ সহ নানা অনুষঙ্গ বিভিন্ন চরিত্র ফুটিয়ে তোলের অভিনেতারা।
রাঙ্গামাটির কাপ্তাইয়ের একজন যাত্রাশিল্পীর সাথে কথা হয় দৈনিক অধিকারের এই প্রতিবেদকের সাথে। গুণী এই শিল্পী ইতোমধ্যে আট শতাধিক যাত্রা, থিয়েটার এবং পথ নাটকে অভিনয় করেছেন। তিনি হলেন- প্রখ্যাত অভিনেতা পরিচালক রণজিৎ মল্লিক। যাকে গত ৩ জুলাই নাট্যঙ্গনে বিশেষ অবদান রাখায় কাপ্তাই উপজেলা শিল্পকলা একাডেমি কর্তৃক নাট্য সম্মাননা প্রদান করা হয়।
কাপ্তাইয়ের চন্দ্রঘোনার কেপিএম কয়লার ডিপু আবাসিক এলাকায় বসবাস করে। অভিনেতা রণজিৎ মল্লিক এর পুত্র বাউল শিল্পী বসুদেব মল্লিক জানান, ৭৫ বছর বয়সী এ অভিনেতা বয়সের ভারে অসহায় হয়ে পড়েছেন, ঠিক মতো এখন আর চলাফেরা করতে পারেনা, কথা বলতেও কষ্ট হয় এ অভিনেতার। নানা রোগ ব্যাধি বাসা বেঁধেছে শরীরে। স্মৃতিশক্তি অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছে। তবুও পুরনো স্মৃতি কিছুটা স্মরণ করেন তিনি।
৭৫ বছরের এই জীবনে তিনি প্রায় আটশ বিভিন্ন মঞ্চে যাত্রা ও নাটকে অভিনয় করেছেন। তার জীবনের প্রথম অভিনয় করা হয় ১৯৫৬ সালে। তখন মাত্র ৮ বছর বয়সে তার পিতা প্রয়াত অভিনেতা সতীশ মল্লিকের অনুপ্রেরণা নিয়ে চন্দ্রঘোনা কেপিএম হরি মন্দিরে দুর্গাপূজা উপলক্ষে একটি যাত্রাপালায় অংশ নিয়ে শুরু করেন অভিনয় জগত। যাত্রাটির নাম ছিল তরণীর বধ।
তরণীর বধে ছোট বালকের চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। যেই যাত্রাটির পরিচালক ছিলেন তৎকালীন কেপিএম এ কর্মরত পরিচালক বিভূতি রঞ্জন বড়ুয়া। সেই দিন তার অভিনয়ে খুশী হয়ে এক দর্শক তাকে পাঁচ টাকা পুরস্কার দেন, যা তাঁর জীবনের সেরা পুরস্কার বলে মনে করেন তিনি।
রণজিৎ মল্লিকের অভিনীত উল্লেখযোগ্য কয়েকটি যাত্রা পালা হলো- মানিকমালা, গরীবের মেয়ে, রাজসিংহাসন, রাঙা তলোয়ার, গৌরি মালা, জীবন্ত কবর, আলোমতি প্রেম কুমার। এছাড়া তিনি আরও অনেক যাত্রাপালা, থিয়েটার নাটক এবং পথ নাটকে অভিনয় করেছেন। তবে যাত্রা পালায় তিনি সবসময় রাজার চরিত্রে অভিনয় করতেন বলে জানান।
টেলিভিশন পর্দায় কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন তিনি। বেসরকারি চ্যানেল এনটিভিতে প্রচারিত ‘একটি কিনলে একটি ফ্রি’ নামক টেলিফ্লিমে তিনি একটি চরিত্রে অংশ নিয়েছেন। যাত্রাপালার পাশাপাশি বিভিন্ন ধর্মীয় পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বনে রচিত নিমাই সন্ন্যাস, সাবিত্রী সত্যবানসহ কয়েকটি পৌরাণিক নাটকে তিনি কখনো গায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন, তার গানের গলাও বেশ সুমধুর।
দ্য লেপ্রসি মিশনের প্রযোজনায় বিশিষ্ট অভিনেতা জন অশোক বাড়ৈ এর পরিচালনায় কুষ্ঠ বিষয়ক পথ নাটক ‘আকাশ কুসুম’ নাটকে পাগল চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেছেন তিনি। যা দুই শতাধিক মঞ্চস্থ হয়েছে। রাঙামাটির কাপ্তাই, বিলাইছড়ি, রাজস্থলী, কাউখালী উপজেলা এবং চট্টগ্রাম জেলার রাঙ্গুনিয়া, রাউজান, বোয়ালখালিসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়েও যাত্রা ও অভিনয় করেছেন গুণী এই অভিনেতা।
অভিনেতা রণজিৎ মল্লিক অভিনয়ের শিক্ষা জীবনে প্রয়াত বিশিষ্ট অভিনেতা বিভূতি রঞ্জন বড়ুয়া, শেখ মতিউর রহমান, আপ্রুসী কারবারি, জন অশোক বাড়ৈ, গোপাল ব্যানার্জীসহ অনেক গুণী পরিচালকের সাথে কাজ করেছেন।
অভিনয়ের পাশাপাশি রণজিৎ মল্লিক কাপ্তাই চন্দ্রঘোনার কর্ণফুলী পেপার মিলস হাসপাতালে দীর্ঘদিন চাকুরি করেছেন। তিনি গত ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠানটি থেকে অবসরে যান। অভিনেতা রণজিৎ মল্লিক অভিনয়ের সাথে সাথে একজন পাল্টা কীর্তনিয়া ও সংগীতশিল্পী হিসেবেও জনপ্রিয়তা আছে। এছাড়া তিনি নিজেও বেশ কয়েকটি যাত্রায় পরিচালকের ভূমিকা পালন করেছেন বলে জানান। অভিনেতা রণজিৎ মল্লিক অভিনয়ে স্বীকৃতি স্বরূপ কাপ্তাই শিল্পকলা একাডেমি সম্মাননা, কেপিএম ম্যানেজমেন্ট থেকেও সংবর্ধনা পেয়েছেন।
কেমন কাটছে এই অভিনেতার বর্তমান জীবন এই বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এক সময় অভিনয় করে জীবনে প্রথম তিনি ৫ টাকা সম্মানী পেয়েছিলেন। এরপর থেকে নামমাত্র সম্মানী কিংবা সম্মানী ছাড়াও ভালবেসে তিনি সারাজীবন অভিনয় করে গেছেন বলে জানান। অভিনয় ছিল একমাত্র তার ভালবাসা।
এ দিকে বর্তমানে দুর্বিষহ জীবন কাটছে তার। বার্ধক্য জনিত সমস্যার কারণে তিনি চলাফেরা করতে এবং স্পষ্টভাবে কথা বলতে পারেন না। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, যদি সুস্থ থাকি, তাহলে মৃত্যুর আগে আর একটি বার মঞ্চে অভিনয় করবো।
ভবিষ্যৎ এ যেন সকলের ভালবাসা ও আশীর্বাদ নিয়ে বাকি জীবনটা পার করতে পারেন সেই আশা রাখেন তিনি।
কাপ্তাইয়ের এই সময়ের জনপ্রিয় অভিনেতা ও পরিচালক এবং কাপ্তাই উপজেলা শিল্পকলা একাডেমির নাটক বিভাগের প্রধান আনিছুর রহমান জানান, অভিনেতা রণজিৎ মল্লিক হলো আমাদের প্রেরণার উৎস। তাদের দেখা পথ ধরেই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। তিনি রাজার চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করতেন।
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড