মো. নুর আলম শেখ মিলন, কুষ্টিয়া সদর, (কুষ্টিয়া)
হরিনাথ মজুমদার যিনি ‘কাঙাল হরিনাথ’ নামে সমধিক পরিচিত তিনি সর্বসমক্ষে ফকির চাঁদ বাউল নামেও পরিচিত ছিলেন। অধিকন্তু তিনি গ্রামবার্তা প্রকাশিকা পত্রিকা প্রকাশের জন্যও প্রসিদ্ধ। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর কুষ্টিয়ায় তার স্মরণে ‘কাঙাল হরিনাথ জাদুঘর’ প্রতিষ্ঠা করে।
তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের নদীয়া জেলার (বর্তমান বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলা) কুমারখালিতে ১৮৩৩ সালের ২২ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার পিতার নাম হরচন্দ্র মজুমদার। বাল্যকালে কৃষ্ণনাথ মজুমদারের ইংরেজি স্কুলে কিছুদিন অধ্যয়ন করেন। কিন্তু অর্থাভাবে প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাশিক্ষায় বেশীদূর অগ্রসর হতে পারেননি। তবে সারাজীবন অবহেলিত গ্রামবাংলায় শিক্ষাবিস্তারের জন্য ও শোষণের বিরুদ্ধে সংবাদপত্রের মাধ্যমে আন্দোলন করেছেন তিনি।
১৮৫৫ সালের ১৩ জানুয়ারি নিজ গ্রামে একটি ভার্নাকুলার বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন হরিনাথ মজুমদার। এরপর বেশ কিছুদিন ওই বিদ্যালয়েই বিনা বেতনে শিক্ষকতা করেন। পরবর্তীকালে তারই সহায়তায় ১৮৫৬ সালের ২৩ ডিসেম্বর কৃষ্ণনাথ মজুমদার কুমারখালিতে একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন।
অত্যাচারিত, অসহায়, নিষ্পেষিত কৃষক-সম্প্রদায়কে রক্ষার হাতিয়ার স্বরূপ সাংবাদিকতাকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন হরিনাথ মজুমদার। অল্প শিক্ষা নিয়েই তিনি দারির্দ্য ও সচেতনতা বিষয়ক লেখনি সংবাদপত্রে প্রকাশ করতেন।
প্রথমে সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায় লিখতেন। প্রাচীন সংবাদপত্র হিসেবে বিবেচিত সংবাদ প্রভাকর পত্রিকাটি এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করেছিল। পরবর্তীকালে ১৮৬৩ সালের এপ্রিল মাসে কুমারখালি এলাকা থেকে গ্রামবার্তা প্রকাশিকা নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন তিনি।
মাসিক এ পত্রিকাটি কালক্রমে প্রথমে পাক্ষিক ও সবশেষে এক পয়সা মূল্যমানের সাপ্তাহিকী পত্রিকায় রূপান্তরিত হয়।
এতে সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ক প্রবন্ধ নিয়মিত মুদ্রিত হতো। নিজ গ্রামের লোকের উপর জোর-জুলুম, দুঃখ-অভাবের ঘটনা সাধারণের সামনে আনার উপলক্ষ্যে তিনি প্রবন্ধ লেখা আরম্ভ করেন কবি ইশ্বরচন্দ্রের সংবাদ প্রভাষক-এ। কবির উপদেশে তার (কাঙাল) প্রবন্ধের ভুল-ত্রুটি সংশোধন করে প্রকাশ করা হতো।
তারপর নিজ উদ্যোগে গ্রাম-হিতৈষণার আদর্শ নিয়ে গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা প্রকাশ করেন। তা কলকাতার গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত্নর যন্ত্রে মুদ্রিত ও কুমারখালী থেকে প্রকাশিত হতো। চার-ফর্মার এই মাসিক পত্রিকার মূল্য ছিল পাঁচ আনা। শেষে এক পয়সার সাপ্তাহিকী পত্রিকায় রূপান্তরিত হয়।
ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেট ও দেশি জমিদারদের অব্যাহত হুমকিও তাকে এ-কাজ করা থেকে বিরত রাখতে পারেনি।
নিঃস্ব কাঙ্গাল হরিনাথ সারা জীবনে সচ্ছলতার মুখ দেখতে না পেলেও ১৮৭৩ সালে কুমারখালির নিজ গ্রামেই গ্রামবার্তা প্রকাশিকা পত্রিকাটির নিজস্ব ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। ১৮ বছর রাজশাহীর রাণী স্বর্ণকুমারী দেবির অর্থ আনুকূল্যে পত্রিকা চালানোর পর আর্থিক কারণে ও সরকারের মুদ্রণ শাসন ব্যবস্থার জন্য পত্রিকাটিকে বন্ধ করে দিতে হয়।
দীর্ঘ আঠারো বছর গ্রামবার্তা প্রকাশিকা সম্পাদনা করার পর সাংবাদিকতা পেশা পরিত্যাগপূর্বক ধর্ম সাধনায় মনোনিবেশ করেন তিনি। হরিনাথ মজুমদার আধ্যাতিক গুরু ও মহান সাধক ফকির লালনের গানের একান্ত অনুরাগী ছিলেন। ধর্মভাব প্রচারের জন্য ১৮৮০ সালে তিনি নিজস্ব একটি বাউল সঙ্গীতের দল প্রতিষ্ঠা করেন। দলটি কাঙ্গাল ফকির চাঁদের দল নামে পরিচিতি ছিল।
১৮৯৬ সালের ১৬ এপ্রিল এই ক্ষণজন্মা লেখক, শিক্ষানুরাগী ও সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব পরলোকগমন করেন। তার মৃত্যুতে ইন্ডিয়ান মিরর পত্রিকা মন্তব্য করেছিল যে, নদীয়া জেলাবাসী একজন মহান ব্যক্তিত্বকে হারায়। তার মৃত্যুর পর ১৯০১ সালে হরিনাথ গ্রন্থাবলী প্রকাশিত হয়।
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড