• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৮ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

কিশোরগঞ্জের প্রাচীন আখড়া মন্দিরটি এখন কালের সাক্ষী

  শামসুল আলম শাহীন

২০ অক্টোবর ২০১৮, ১৫:০৫
নারায়ণ জিউর আখড়া
কিশোরগঞ্জের প্রাচীন শ্রী শ্রী শ্যাম সুন্দর লক্ষী নারায়ণ জিউর আখড়া

কিশোরগঞ্জের প্রাচীন শ্রী শ্রী শ্যাম সুন্দর লক্ষী নারায়ণ জিউর আখড়াটি এখন কালের সাক্ষী। কিশোরগঞ্জ শিল্পকলা একাডেমী সংলগ্ন হিন্দু সম্প্রদায়ের এককালের বিখ্যাত ধর্মীয় পীঠস্থান, আখড়া মন্দির ও মন্দিরে স্থাপিত শ্যামসুন্দর আখড়াটি শহরের অন্যতম সেরা আকর্ষণ।

বর্তমানে এটি শ্রী শ্রী শ্যামসুন্দর লক্ষী নারায়ণ জিউর আখড়া নামে সুপরিচিত। এই আখড়ার দোলমঞ্চ ও অন্যান্য নিদর্শন আজো যে কোনো পথিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই আখড়াকে কেন্দ্র করেই এলাকাটি ‘আখড়া বাজার’ নামে পরিচিত লাভ করেছে বর্তমানে।

আখড়া ও মন্দিরটির স্থাপনকাল সম্পর্কে সঠিক সময় নির্ণয়ের কোন রেকর্ডপত্র উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তবে এটুকু জানা গেছে যে, ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে ব্রহ্মজ্ঞানী মহাত্মা বিজয় কৃষ্ণ গোস্বামী কিশোরগঞ্জে এসে দু’টি ব্রাহ্মধর্ম সভায় যোগদান ও বক্তৃতা দেন।

বক্তৃতা দেয়ার পর স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়, বিশেষ করে ব্রাহ্মণ ও গোড়া ধর্মপ্রাণ হিন্দুগণ বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর মতামতের বিরুদ্ধে উক্ত আখড়ায় ‘ধর্মসভা’ নামে এক সভার আয়োজন করেছিলেন। সে সময়ে এ আখড়ায় একটি সংস্কৃত শিক্ষার টোলও প্রতিষ্ঠিত ছিল। গৌরচন্দ্র পাঠক নামে একজন খ্যাতনামা পন্ডিত উক্ত টোলের শিক্ষকতায় নিয়োজিত ছিলেন। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দের পূর্বেই আখড়াটি প্রতিষ্ঠিত ছিল।

হয়বত নগরের দেওয়ানদের নিয়ে এই আখড়া সম্পর্কিত সুন্দর একটি তথ্য রয়েছে। জানা যায়, বর্তমান আখড়া বাজারসহ আশে পাশের বিস্তীর্ণ এলাকা ছিল জঙ্গল। রাখাল বালকের জঙ্গলের আশে পাশের পতিত জমিতে গরু চরাত। একদিন রাখাল ছেলেরা জঙ্গলের মধ্য থেকে ধোয়া উঠতে দেখে কৌতুহলবশে তারা বনের মধ্যে প্রবেশ করে জ্বলন্ত আগুনের পাশে একজন সন্নাসীর বসে থাকতে দেখে। পরে পর্যায় ক্রমে সন্নাসীর কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।

ঐ এলাকাটি ছিল হয়বতনগরের দেওয়ানদের। দেওয়ান সাহেব হুকুম দিলেন সাধুকে ধরে নিয়ে আসতে। কিন্তু সাধুকে কোন অবস্থাতেই, এমনকি তার পাইক বরকন্দাজগণ শক্তি প্রয়োগ করেও স্থানচ্যুত করতে পারলো না। সাধু সর্ম্পকে নানা কথা এতদিনে ছড়িয়ে পড়েছে। দেওয়ান সাহেব শেষ পর্যন্ত নিজে এসে সাধুর সাথে দেখা করেন। দেওয়ান সাহেব সাধুর প্রতি অনুরাগ বশতঃ বর্তমান আখড়া বাজারস্থ বিরাট মহালটি মন্দির ও আখড়া স্থাপনের জন্য দানপত্র করে দেন। এভাবেই প্রতিষ্ঠিত হল শ্যামসুন্দর আখড়া।

হয়বতনগর জমিদার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বলে আখড়াটিতে প্রথম মেহান্ত থেকে পরবর্তীকালে নতুন মোহান্ত নির্ধারিত হলে তাকে প্রথমেই দেওয়ানবাড়ির উত্তরাধিকারীর বা হাতের কড়ে আঙ্গুলে কপালে দেয়া সিদুরের টিপ নিয়ে পদে অভিষিক্ত হতে হতো। শেষ মোহান্ত পর্যন্ত এই নিয়ম বলবৎ ছিল।

যারা মোহান্ত ছিলেন তাদের মধ্যে রয়েছেন (ক্রমানুসারে) শ্রী শ্রী ব্রজবল্লব গোস্বামী, শ্রী কৃষ্ণমঙ্গল গোস্বামী, গঙ্গা গোবিন্দ অধিকারী, রাধাগোবিন্দ অধিকারী (১), রাধাগোবিন্দ অধিকারী (২), ব্রজগোপাল অধিকারী, দোল গোবিন্দ অধিকারী, দয়াল গোবিন্দ অধিকারী, গকুল গোবিন্দ অধিকারী, প্রহলাদ চন্দ্র অধিকারী, নগেন্দ্র গোবিন্দ গোস্বামী, রামানন্দ দাস বাবাজী, সদানন্দ দাস বাবাজী। শেষ দুই মোহান্ত জমিদারী স্বত্ব উচ্ছেদের পর অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। শ্রী গকুল গোবিন্দ অধিকারীর সময় আখড়া সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য সেবাইতের পাশাপাশি একটি পরিচালনা কমিটি গঠন কর হয়। বাংলা ১৩৯১ সনের ১০ই পৌষ সর্বশেষ সেবাইত শ্রী সদানন্দ দাস বাবাজী লোকান্তরিত হবার পর আর কোন সেবাইত নিয়োগ করা হয়নি। স্বাধীনতার পর যে সকল ব্যক্তিবর্গ কমিটির প্রধানের দায়িত্ব পালন করেছেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রখ্যাত আইনজীবী পরলোকগত শ্রী হেমেন্দ্র নারায়ন রায়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় এই প্রাচীন আখড়াটি বেশ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল।

বর্তমানে শ্যামসুন্দর আখড়াটি প্রাচীনতম নিদর্শন হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে। প্রাচীন ইতিহাস রক্ষার্থে মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষন ও সংস্কারের প্রয়োজন মনে করছেন বর্তমান পরিচালনা পরিষদ। বর্তমান কার্যকরী কমিটির সাধারণ সম্পাদক শুভংকর পাল জানান, এই মন্দিরটি প্রাচীন মন্দির। মন্দিরের সাথে রয়েছে একটি দোল মন্দির, আগে জাঁক জমক পূর্ণভবে জমিদারগন পূজা করেছিলেন।

মাঝখানে কিছুটা স্থবিরতা থাকলেও এখন পূজা, লীলাকীর্তন ও রামায়নের পালার আয়োজন করা হয়। তবে সব পূজার আয়োজন করা সম্ভব হয় না। এই মন্দিরের এক সময় দোলপুজার আয়োজন বড় করে করা হতো। এখনও হয় তবে ছোট আকারে। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর চেষ্টা করে যাচ্ছি সকল পূজা,লীলাকীর্তন, রামায়নের পালার আয়োজন করার। এছাড়াও মন্দিরের সংস্কারসহ আয়ের উৎস বৃদ্ধি করা।

ইতোমধ্যে যেসব এলাকায় মন্দিরে জায়গা জমি রয়েছে তা প্রশাসন ও এলাকাবাসীর সহায়তায় উদ্ধার করে বহুতল ভবন তৈরী করার চিন্তা ভাবনা করছি। যাতে মন্দিরের আয়ের উৎস বৃদ্ধি পায়। তিনি আরো জানান, মন্দিরের সংস্কারের জন্য ইতিমধ্যে এলাকাসহ বিত্তশালীদের কাছে সহায়তা চেয়েছি।

তার মধ্যে গত কয়েক দিন আগে এলাকার একজন বিত্তশালী যার পরিবারের প্রায় সবাই অষ্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে কর্মরত আছেন। তাদের মধ্যে একজন দীপংকর পন্ডিত। তিনি পেশায় একজন প্রকৌশলী। শ্যামসুন্দর আখড়ার দোল মন্দিরটি তিনি স্বেচ্ছায় অবকাঠামো রেখে সংস্কার করে দিয়েছেন। ফলে দোল মন্দিরটির সৌন্দর্য বৃদ্ধি পেয়েছে। অপর দিকে একই এলাকার ডা. অজয় বর্ধন তিনি রাধা শ্যামের একটি বিগ্রহ (পাথরের মুর্তি) দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। যা মন্দিরের শুভাবর্ধন হবে।

অন্যদিকে এলাকার প্রবীণ সমাজসেবক রতন বসাক জানান, হয়বতনগরের দেওয়ানদের দেওয়া সম্পত্তিই এক মাত্র আয়ের উৎস। বর্তমানে আখড়ায় একটি ছাত্রাবাস রয়েছে। ছাত্রাবাসের আয়ের উৎস দিয়েই মন্দির পরিচালনা করা হয়। মন্দিরের সেবায় একজন কেয়ারটেকার, একজন সেবায়েত, একজন কর্তী ও একজন ক্লিনার রয়েছে তারা বেতন ভুক্ত। মন্দিরের যে আয় হয়, সে আয় দিয়ে বর্তমান বাজারে চলে না।

এছাড়াও এলাকার ব্যবসায়ি রতন সরকার, তপন সরকার ও চাকুরীজিবী সঞ্জয় বর্ধন বলেন, এটা আমাদের এলাকার গৌরব ও প্রাচীন মন্দির। এর সৌন্দর্য রক্ষা করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। আমারা না থাকলেও যেন আমাদের এলাকার এই মন্দিরটি কালের সাক্ষী হয়ে থাকে । আমাদের পূর্ব পুরুষের রেখে যাওয়া স্মৃতি ধরে রাখতে যা করা দরকার তা আমরা করবো, যেন আমাদের আগামী প্রজন্মের সন্তানরা এর ইতিহাস জানতে পারে।

আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড