শাকিল মুরাদ, শেরপুর
একসময় নদীমাতৃক জেলা হিসেবে পরিচিত ছিল শেরপুর। কারণ, এ জেলায় প্রায় দেড় ডজন নদী ছিল। আর রেলপথবিহীন জেলার সড়কপথে যোগাযোগ ছিল একেবারেই কম। ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য যাতায়াত হতো নদীপথ দিয়ে। কিন্তু দিন দিন এসব নদীগুলোর অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। নাব্যতা হারিয়ে বিলীন হয়ে গেছে অনেক নদী খাল-বিল। নদীর বুকে চলছে ফসল আবাদ। নির্মাণ করা হয়েছে ঘর-বাড়িসহ নানা প্রতিষ্ঠান। আবার কিছু কিছু নদীর নাম পরিবর্তনও হয়েছে অনেক আগেই।
জানা গেছে, এক সময়ের মৃগী নদীতে ছিল টলটলে জল। শহরের মানুষের প্রশান্তির স্থান ছিল এই মৃগী নদী। কিন্তু নদীটি এখন আধুনিক পৌর শহরের বর্জ্যের আস্তানা। শহরের বিশাল ড্রেন নামিয়ে দেওয়া হয়েছে মৃগী নদীর বুকে। বিলীন হয়েছে নদীর মিঠা পানির মাছ। পানির দুর্গন্ধে মৃগী নদী এখন রোগীতে পরিণত হয়েছে। জেলার প্রায় দেড়শ বছর আগের ইতিহাসে ১৬টি প্রধান নদী ও ৯টি ক্ষুদ্র নদীর কথা উল্লেখ রয়েছে। প্রাচীন ঐতিহাসিক গ্রন্থে যে ১৬টি প্রধান নদীর নাম উল্লেখিত আছে, সেগুলো হচ্ছে- ব্রহ্মপুত্র, মালিঝি, সোমেশ্বরী, মৃগী, নেত্রবতী, মহাঋষি, থলঙ্গ, ভোগবতী, খারুয়া, দর্শা, ভুরাঘাট, বলেশ্বরি, সুতী, মরাখড়িয়া, বৃদ্ধ ভোগবতী ও খড়িয়া।
এগুলোর মধ্যে মরা বা আধমরা হয়ে ৮টি নদী এখনও কালের সাক্ষি হয়ে কোনোরকম বেঁচে রয়েছে। অন্য ৮টি নদী এখন শুধুই ইতিহাস। যে ৮টি নদী কোনোরকম টিকে রয়েছে তার মধ্যে ব্রহ্মপুত্র, মৃগী, সোমেশ্বরী ও মালিঝি পূর্ব নামেই এখনো পরিচিত। আর যে ৪টি নদীর নাম পরিবর্তন হয়েছে, সেগুলো হলো- ভোগবতী থেকে ভোগাই, মহাঋষি থেকে মহারশি, থলঙ্গ থেকে চেল্লাখালি এবং নেত্রবতী থেকে নেতাই নদী। অন্য নদীগুলোর বিলুপ্তি ঘটেছে।
অন্যদিকে ‘দশানি’ নামে নতুন একটি নদীর সৃষ্টি হয়েছে। এক সময়ের বিখ্যাত নেতাই নদী নেতাই খালে রূপান্তরিত হয়। পরবর্তীতে একেবারেই হারিয়ে যায়। নতুন প্রজন্ম এই নদীর নামও এখন আর জানে না। অথচ এই নেতাই সাবেক শেরপুর পরগণার মধ্যে ৪৩ মাইল দীর্ঘ নদ বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। এছাড়া মৃগী নদীর দৈর্ঘ্য ২৯ মাইল, ব্রহ্মপুত্র নদ সাড়ে ১০ মাইল, মালিঝি সাড়ে ৩৫ মাইল, চেল্লাখালি ১২ মাইল, সোমেশ্বরী সাড়ে ১৮ মাইল, মহারশি ১৫ মাইল এবং ভোগাইনদী ১৬ মাইল দীর্ঘ ছিল। এখন নদীগুলো পরিমাপ করার অবস্থায় আর নেই। আর নকলার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া সূতি নদীকে ঘিরে বৃটিশে চন্দ্রকোণায় গড়ে উঠেছিল বিশাল বন্দর। আর আজ সেই সূতি এখন প্রভাবশালীদের মৎস খামারে পরিণত হয়েছে। হিমালয়ের মানস সরোবর থেকে ব্রহ্মপুত্র নদটি চীন ও ভারত হয়ে বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করে জামালপুর ও সিরাজগঞ্জ হয়ে শেরপুর-জামালপুর সীমারেখায় প্রবাহমান হয়েছে। শেরপুর-জামালপুর অংশের এই ব্রহ্মপুত্র, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ নাম ধারণ করেছে। এই ব্রহ্মপুত্র নদ শেরপুর-জামালপুরের চরাঞ্চলের আর্শীবাদ ছিল। কালের বিবর্তনে আজ নদীটি ছোট একটি খালের মতো হয়ে গেছে। কিন্তু প্রতি বর্ষা মৌসুমে অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায় এই নদী। বর্ষাকালে ক্ষত-বিক্ষত করে চরাঞ্চলের মানুষদের।
ভারতের মেঘালয় রাজ্যের তুরাপাহাড় থেকে কংস নদীর জন্ম হয়ে শেরপুরের হাতিবাগার এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ভারতে এর নাম কংস হলেও শেরপুরের নালিতাবাড়ীর হাতিবাগার এসে এ নদীর নাম হয়েছে ভোগাই। নালিতাবাড়ীর ৫ কিলোমিটার ভাটিতে আসিন দীটি দিংঘানা, চেল্লাখালি, মহাররি, মালিঝি ইত্যাদি বাহারি নামে উপনদীর নাম ধারণ করে আবার ভোগাই নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। এই ভোগাই নদীটি ময়মনসিংহের ফুলপুরের খড়িয়া নদীর সাথে মিশে গেছে। খরিয়া নদীটি আবার ব্রহ্মপুত্র নদের সাথে মিশেছে। দীর্ঘদিনের দখল আর নানা উৎপাতে বাহারি নামের এই নদীগুলো আজ বিলীন হয়ে গেছে। অথচ বিশাল পাহাড়ঘেরা ভারতের মেঘালয়ের পাহাড়ি ঢলের পানি ধারণ করতো এই নদীগুলো। নদী শেষ হলেও মেঘালয়ের পাহাড়ি ঢল এখন ভোগাই, চেল্লাখালি, সোমেশ্বরী, মহারশির নদীর দুকূলে রৌদ্র মূর্তিতে আবর্তিত হয়। বর্ষায় প্রতিবছর পাহাড়ি ঢলের সাথে নেমে আসা বালি-পলিতে ভরাট হয়ে পড়েছে নদ-নদীগুলোর আশপাশ। খননের অভাবে জেলার প্রায় সব নদীতেই পানির সংকট। পানি না থাকায় নদীর ওপর দিয়ে হেঁটে চলাচল করে পথচারীরা।
এছাড়া পাহাড়ি ঢলের সাথে উজান থেকে আসা বালির আস্তর পড়ে ভাটির দিকের শত শত একর ফসলি জমি অনাবাদি হয়ে পড়ছে। অপরদিকে অপরিকল্পিত এবং অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের প্রতিযোগিতা নদীগুলোকে প্রতিদিন করছে শ্রীহীন। এই অঞ্চলে একমাত্র ব্রহ্মপুত্র নদ ছাড়া সবগুলো নদীর উৎপত্তিস্থল প্রতিবেশী ভারত। ভারত থেকে গারো পাহাড় হয়ে শেরপুর দিয়ে মিশে গেছে অন্যান্য নদীতে।
জেলার বিভিন্ন লেখকের বই থেকে জানা যায়, ১৮৮৫, ১৮৯৭ এবং ১৯১৮ সালে এই অঞ্চল জুড়ে প্রবল ভূমিকম্প হয়। এর ফলে শেরপুরের বেশ কিছু নদ-নদী, খাল-বিল সমূহের গতি পরিবর্তিন ও ভরাট হয়ে যায়। এছাড়া গত শতাব্দীর পাশের দশকে গারো পাহাড় এলাকায় নির্বিচারে বনভূমি ধ্বংস এবং পাহাড়ি টিলা খুঁড়ে পাথর উত্তোলন শুরু হয়। এর ফলে উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানির সাথে পাথর তোলা আগলা বনভূমির মাটি, বালি-পলিতে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যেতে শুরু করে। আধুনিক নগরের বর্জ্য পলিথিনের জায়গা হয় এসব নদীবক্ষে।
অন্যদিকে উন্নয়ন ও উৎপাদন বাড়াতে ব্রহ্মপুত্র, মহারশি, সোমেশ্বরী, ভোগাই, চেল্লাখালি নদীর স্থানে স্থানে অপরিকল্পিত বাঁধ, সুইস গেট নির্মাণের ফলে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হয়। ফলে আস্তে আস্তে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে চর জেগে উঠে। কিন্তু নদী খননের কার্যকর কোনো উদ্যোগ না থাকায় নাব্যতা হারিয়ে নদীগুলো আজ প্রবাহহীন। নদীর বুকে জেগে উঠেছে চর। সেই চরে চাষাবাদ করছে মানুষ। আবার কিছু কিছু জায়গায় গড়ে উঠেছে ঘর-বাড়ি। নানা বিবর্তন-পরিবর্তন, প্রাকৃতিক-অপ্রাকৃতিক ও জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে নাব্যতা হারানো নদীগুলো এখন পরিণত হয়েছে সামান্য জলাধারে। নদী তার প্রাকৃতিক গতি হারানোর ফলে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ও জলজ প্রাণী। এই নদীগুলোকে বাঁচাতে বিভিন্ন সংগঠন একাধিকবার দাবি জানালেও এখন পর্যন্ত কার্যকর কিছু হয়নি।
প্রকৃতি ও পরিবেশবাদী সংগঠন সবুজ আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মো. মেরাজ উদ্দিন বলেন, দুঃখজনক হলেও সত্য মানুষের অসচেতনতার কারণে নদী বা খালগুলোর অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। ময়লা-আবর্জনা ফেলা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এছাড়া খাল দখলের প্রতিযোগিতা চলছে। আমরা প্রশাসনের নজরদারির দাবি জানাচ্ছি।
সচেতন মহল মনে করেন, নদীগুলো খনন করে নাব্যতা ফিরিয়ে আনা দরকার। পরিকল্পিত খনন করলে দুই দিকেই লাভ হবে, একদিকে নদীর নাব্যতা ফিরবে, অন্যদিকে খননের ফলে প্রাপ্ত বালু, নুড়ি মূল্যবান খনিজ সম্পদ হিসেবে বিক্রি করা যাবে।
এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক মো. মোমিনুর রশীদ বলেন, খালগুলো আসলে একদিনে ভরাট হয়নি। এটা ধীরে ধীরে হয়েছে। আমরা পানি উন্নয়ন বোর্ডকে সাথে নিয়ে জেলার বিভিন্ন খাল খনন কাজ শুরু করেছি। আমার বিশ্বাস, জেলার খনন কাজ শেষ হলে নদী বা খালের পানির প্রবাহ স্বাভাবিক হবে এবং আগের মতোই নদী ও খালগুলোর অস্তিত্ব ফিরে আসবে।
আরও পড়ুন : ভারতে সয়াবিন তেল পাচারের সময় আটক ২
তিনি আরও বলেন, নদী থেকে অবৈধ উপায়ে বালু উত্তোলন বন্ধে আমাদের নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে জেলার অনেক জায়গায় বালু তোলার ড্রেজার মেশিন জব্দ করে ভস্মীভূত করা হয়েছে।
ওডি/এএম
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড