আতিয়ার রহমান, দৌলতপুর (কুষ্টিয়া)
কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে পদ্মা নদীতে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের ফলে শুকনো মৌসুমে নদী ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। গত ১৫ দিনে উপজেলার মরিচা ইউনিয়নে কোলদিয়াড়, মাজদিয়াড় ও ভুরকা এলাকার মানুষের তিন হাজার বিঘারও বেশি ফসলি জমি ও বেশকিছু ঘরবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। হুমকির মুখে রয়েছে রায়টা-মহিষকুন্ডি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, ভারত-বাংলাদেশ বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন, সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় বিভিন্ন স্থাপনা।
স্থানীয়দের আশঙ্কা, এভাবে নদী ভাঙন অব্যাহত থাকলে অচিরেই মানচিত্র থেকে মুছে যাবে মরিচা ইউনিয়নের ৩টি ওয়ার্ড।
নদী ভাঙনের শিকার ভুক্তভোগীরা জানান, বর্ষা মৌসুমে বন্যার সময় সাধারণত পদ্মা নদীর ভাঙন দেখা যায়। কিন্তু এবার শুকনো মৌসুমেই পদ্মা নদীর ভাঙন শুরু হয়েছে। মরিচা ইউনিয়নের মাজদিয়াড়-কোলদিয়াড় গ্রাম থেকে ভুরকা-হাটখোলাপাড়া গ্রাম পর্যন্ত প্রায় ৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে নদী ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। প্রতিদিনই নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে ফসলি জমিসহ বিভিন্ন স্থাপনা। হঠাৎ করে ফসলি জমি হারিয়ে অনেকেই নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। গত দু’সপ্তাহে অন্তত ৩ হাজার বিঘার বেশি বিভিন্ন ধরনের ফসলসহ জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
সরেজমিনে নদী ভাঙন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, পদ্মা নদীর ভাঙনের ফলে ভুরকা এলাকায় নদী থেকে মাত্র আধা কি.মি. দূরে রয়েছে ভারত-বাংলাদেশ বিদ্যুত সঞ্চালন লাইন। এভাবে ভাঙন অব্যাহত থাকলে যে কোনো মুহুর্তে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের খুঁটি নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। হুমকির মুখে রয়েছে রায়টা-মহিষকুন্ডি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, নদী ভরাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ভুরকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কোলদিয়াড় কান্দিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কোলদিয়াড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কোলদিয়াড় মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়, হাটখোলা পাড়া জামে মসজিদ, জুনিয়াদহ মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও জুনিয়াদহ বাজার। এছাড়াও ভুরকা, কোলদিয়াড়, জুনিয়াদহ, কোলদিয়াড় পূর্বপাড়াসহ বেশ কয়েকটি গ্রামের মানুষের মাঝে ঘরবাড়ি হারানোর আতঙ্ক বিরাজ করছে।
এলাকাবাসী জানান, রাজশাহী-কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের চরাঞ্চল দিয়ে পদ্মা নদী প্রবাহমান রয়েছে। বর্ষা মৌসুমে পদ্মায় বন্যার পানি বৃদ্ধির ফলে নদী পেরিয়ে বিস্তীর্ণ চর ও নদীর দু’পাশের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়। বন্যা বৃদ্ধি ও পানি কমার সময় সাধারণত নদী ভাঙন দেখা দেয়। এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে বন্যার পানি কমে গেলে শুরু হয় শুকনো মৌসুম। পদ্মার বুক চিড়ে জেগে ওঠে বিস্তীর্ণ চর। শুকনো মৌসুমে মূল নদী দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়। যুগ যুগ ধরে একই ধারা চলে আসছে। কিন্তু এই মৌসুমে হঠাৎ করে পানির প্রবাহ মূল নদী পেরিয়ে প্রবল স্রোতে নদীর কিনারের দিকে ধেয়ে এসে পাড়ে আছড়ে পড়ছে। ফলে মরিচা ইউনিয়নের কোলদিয়াড় থেকে ভেড়ামারা উপজেলার জুনিয়াহ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকা ভাঙনের মুখে পড়েছে। স্থানীয়দের প্রশ্ন, যুগ যুগ ধরে একই ধারায় পদ্মার পানি প্রবাহিত হলেও এ বছর শুকনো মৌসুমে নদীর পানির প্রবাহের দিক পরিবর্তন হচ্ছে কেন?
এলাকাবাসীর অভিযোগ, পদ্মা নদীর দৌলতপুর অংশে বৈধ (সরকারি ইজারাভুক্ত) কোনো বালুমহাল না থাকলেও সরকার দলীয় প্রভাবশালীরা অবৈধ ও অপরিকল্পিতভাবে নদী থেকে ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করেছে। এর ফলে পানির গতিপথ পরিবর্তন হয়ে নদী ভাঙনের সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়াও উত্তোলিত বালু বহনের জন্য বড় বড় কার্গো বা ট্রলার ব্যবহার করা হয়। এসব কার্গো বা ট্রলার নদীপাড়ের পাশ দিয়ে চলাচলের সময় নদীতে ব্যাপক ঢেউয়ের সৃষ্টি হয়। এতে নদী ভাঙনের তীব্রতা আরও বেড়ে গেছে।
কোলদিয়াড় গ্রামের ষাটোর্ধ্ব বয়সী কৃষক ভুলু ফরাজী বলেন, ‘শুকনো মৌসুমে এ ধরনের নদী ভাঙন আগে কখনও ঘটেনি। অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলন করার কারণেই এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। অবিলম্বে বালু উত্তোলন বন্ধ করে নদী ভাঙনের জন্য দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহনের দাবি করেন তিনি।’
স্থানীয় বাসিন্দা মুক্তার হোসেন জানান, ‘প্রতিবছর নদী ভাঙলেও এবার নদী ভাঙনের ভয়াবহ তীব্রতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। প্রতিদিনই নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে উঠতি ফসল ধান, গম, ভুট্টা, মসুর, খেসারিসহ ফসলি জমি ও বিস্তীর্ণ এলাকা।’
কৃষক জমির ফরাজি জানান, ‘গত তিনদিনে আমার তিন বিঘা ফসলি জমি নদীগর্ভে তলিয়ে গেছে। আরও তিন বিঘা জমি আজকের মধ্যে ভাঙবে। তাই কাঁচা গম ও ভুট্টা কেটে নিয়ে যাচ্ছি গরু-ছাগলকে খাওয়ানোর জন্য। আর ক’দিন পরেই ঘরে গম তুলতে পারতাম। কিন্তু তা আর হলো না।’ নদী থেকে বালু ওঠানোর কারণে অসময়ে পদ্মা নদীর ভাঙনে তাদের বেঁচে থাকার সম্পদ ফসলি জমি হারাতে হলো। তিনি অবৈধভাবে বালি উত্তোলন বন্ধ ও ভাঙনরোধে স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান।
মরিচা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাহিদুল ইসলাম জাহিদ বলেন, ‘পদ্মার ভাঙনে তার ইউনিয়নের অনেকে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া না হলে ফসলি জমি, বসতবাড়ি ও স্থাপনা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে।’ নদী ভাঙনরোধে সংশ্লিষ্টদের দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহনের অনুরোধ করেন তিনি।
মরিচা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান শাহ আলমগীর বলেন, ‘যারা পদ্মার ভাঙনরোধে মানববন্ধনে নেতৃত্ব দিচ্ছে তারাই পদ্মা নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছে। পদ্মা নদীতে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধ করা না গেলে অচিরেই মরিচা ইউনিয়নের ৩টি ওয়ার্ড মানচিত্র থেকে মুছে যাবে।’
দৌলতপুর কৃষি কর্মকর্তা মো. নুরুল ইসলাম জানান, ‘অসময়ে পদ্মা নদীর ভাঙনে মরিচা ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকার কৃষকদের ৪ শতাধিক হেক্টর আবাদি ও ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সহায়তা ও নদী ভাঙনরোধে সংশ্লিষ্ট দফতর পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের অবগত করা হয়েছে।’
দৌলতপুর উপজেলা চেয়ারম্যান অ্যাড. এজাজ আহমেদ মামুন ও দৌলতপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. আব্দুল জব্বার পদ্মা নদীর ভাঙন এলাকা পরিদর্শন করেছেন। পদ্মার ভাঙনরোধের বিষয়ে দৌলতপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার আব্দুল জব্বার বলেন, ‘নদী ভাঙন রোধ করতে সব ধরনের চেষ্টা করা হচ্ছে।’ বালু উত্তোলন বন্ধে প্রশাসন তৎপর রয়েছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধে একাধিকবার অভিযান চালানো হয়েছে। বালু উত্তোলন বন্ধে প্রয়োজনীয় সব ধরনের আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
আরও পড়ুন : পাঁচ জাসদনেতার নির্মম হত্যাকাণ্ডের ২৩ বছর
কুষ্টিয়া-১ দৌলতপুর আসনের সংসদ সদস্য অ্যাড. আ. কা. ম. সরওয়ার জাহান বাদশাহ বলেন, ‘তাৎক্ষণিক নদীভাঙন বন্ধে নদীপাড়ের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে জিও ব্যাগ ফেলাসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এছাড়াও স্থায়ীভাবে নদীভাঙন রোধে ইসলামপুর ফিলিপনগর-গোলাবাড়ির মত সিমেন্টের ব্লক নির্মাণ করার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।’
ওডি/এএম
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড