• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৭ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

তার পেছনে হাজার লোক মিছিল করত, এখন কেউ নেই

  সাজ্জাদুল আলম শাওন, দেওয়ানগঞ্জ (জামালপুর)

০৪ ডিসেম্বর ২০২১, ১৪:৫৪
জামালপুর
মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক কামাল চৌধুরী (ছবি : অধিকার)

মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। তাদের সংগঠিত করে যুদ্ধে পাঠানোর কাজ করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকরা। সমাজে যুবকদের মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করে দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে উৎসাহ যুগিয়েছেন সংগঠকরা। মহান মুক্তিযুদ্ধে তাদের অবদান অবিস্মরণীয়। তেমনি এক সংগঠক জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা কামাল চৌধুরী। টগবগে যুবক কামাল চৌধুরী যখন বিভিন্ন আন্দলনে শ্লোগান ধরতেন মুহুর্তেই জনস্রোত নেমে আসত রাজপথে। ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে আগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন তিনি।

সময় ১৯৭১ সাল ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান। সেই ঘোষণা শুনেই সিরাজগঞ্জ কলেজে অধ্যায়নরত ছাত্র তৎকালীন কলেজ ছাত্রসংসদের জিএস কামাল চৌধুরী যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে নিজ উপজেলায় চলে আসেন। উপজেলায় পাকিস্তানীদের অবাদ বিচরণে থমথমে ভাব বিরাজ করলে সেদিনই পাশের উপজেলা ইসলামপুরের চিনাডুলীতে আশ্রয় নেন। নিজ উপজেলা ত্যাগের সময় অনেকেই তার সফরসঙ্গী হন। কিছুদিন পালিয়ে থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন দেশের জন্য কিছু একটা করতে হবে।

দামাল ছেলেরা একত্রিত হয়ে তৎকালীন এমএনএ আ. সামাদ শরণাপন্ন হলে তার নির্দেশক্রমে কামাল চৌধুরী, আ খ ম ইনসান আলী এবং ভাষা সৈনিক বদিউর রহমান তালুকদার মিলে দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে যুদ্ধের জন্য যুবক সংগ্রহ করতে শুরু করেন। তাদের ডাকে সামাজের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ একত্রিত হতে থাকে। ৪২ জনের একটি শক্তিশালী দল গঠন করেন তারা। তৎকালীন পাকিস্তানি এয়ার ফোর্স থেকে পালিয়ে আসা ফ্লাইড সার্জন রুহুল আমীনকে এই দলের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১০ দিন দেওয়ানগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে প্রশিক্ষণ দিয়ে আরও উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে পাঠিয়ে দেওয়া হত। মূলত প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্যই দেওয়ানগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ নির্ধারণ করা হয়েছিল।

অনুমানিক ২৮/২৯ মার্চ দেওয়ানগঞ্জ উপজেলায় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। সে সময়কার সাহসী ও বুদ্ধিমান যুবকদের নিয়ে শক্তিশালী পরিষদ গঠিত হয়। পরিষদের আহ্বায়ক করা হয় তৎকালীন এমএনএ আ. সামাদকে, যুগ্ন আহ্বায়ক প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য আশরাফ হোসেন, সদস্য ছিলেন কামাল চৌধুরী, তৎকালীন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রশিদুল হক, নুরুল হক বাদশা মিয়া, রুহুল আমিন বাদশা, মাহবুবুর রশিদ খুরুম ও আব্দুল কাদের। তাদের নেতৃত্বে বিভিন্ন পেশার মানুষ মাতৃভূমির ভালবাসায় দেশের জন্য এগিয়ে আসে। অনেকেই প্রশিক্ষণের জন্য ইন্ডিয়া চলে যান। প্রশিক্ষণে যাওয়ার সময় যোদ্ধাদের সকল সমস্যার সমাধান করে দিতেন এই পরিষদের সদস্যগণ।

যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলকে কয়টি সেক্টরে বিভক্ত করা হয়। সে সময় জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা ১১ নম্বর সেক্টরে চলে আসে। কর্নেল তাহেরকে সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়। এই সেক্টর আরও চারটি কোম্পানিতে বিভক্ত করা হয়। যেন সহজেই সকল যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ এবং দিকনির্দেশনা প্রদান করা যায়। প্রতিটি কোম্পানিতে একটি করে কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়। গাজী নাসির উদ্দিন, খায়রুল ইসলাম, আব্দুল বাসেত, ইমারত হোসেন পান্না কে কোম্পানি কমান্ডারের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। এসব কোম্পানি কমান্ডারের আওতাভুক্ত ১০০ জন বীরযোদ্ধাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করা হয়। তাদের যুদ্ধের বিভিন্ন কৌশল রপ্ত করলে পরিপূর্ণ যোদ্ধা তৈরি করেন। প্রত্যেক কোম্পানি কমান্ডার যুদ্ধে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।

কোম্পানি কমান্ডার আব্দুল কাদের নেতৃত্বে জিল বাংলা সুগার মিলে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পে হামলা চালানো হলে পাকসেনারা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। অপরদিকে গাজী নাসির উদ্দিনের নেতৃত্বে দেওয়ানগঞ্জের রেল সংযোগ ধ্বংস করে দেওয়া হলে পাক সেনারা তাদের অবস্থান থেকে সরে আসতে শুরু করে। পরপর এইসব সাহসী অভিযানে সফলতা অর্জন করে দেশের বীর সেনারা। ৬ই ডিসেম্বর কামালপুরসহ উপজেলার সর্বত্র থেকে পাক বাহিনীকে বিতাড়িত করে বিজয় লাভ করে।

যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে কামাল চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক হয়ে ১৯৮৬ ইং সালে নৌকা প্রতীক নিয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তুখোড় ছাত্রনেতা রাজনীতিতে জড়িয়ে উপজেলার বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। যুদ্ধের সময় রাজাকার-আলবদররা বাড়ি পুড়িয়ে দিলে সরকার থেকে বাড়ি নির্মাণের প্রস্তাব দেওয়া হলে তিনি তা নিষেধ করে দেন। এক সময়কার সেই টগবগে যুবক, সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী, সফল সংগঠক আজ কষ্টে দিন যাপন করছেন।

যার ডাকে এক সময় হাজার লোক জড়ো হতো, রাস্তাল মিছিল বের হতো, কিন্তু এখন তার কথা শোনার মত কোন লোকই তার পাশে নেই। সকলেই দূর থেকে প্রশংসা ও বাহবা দিয়ে যায় কিন্তু একজন কামাল চৌধুরী হয়ে বেড়ে ওঠা মানুষ একাকী হয়ে পড়েছেন। বর্তমানে তার প্রধান সঙ্গী বই। অবসর সময়ে তিনি বই পড়েই সময় কাটান। এক সময় হয়তো তিনি আর এই পৃথিবীতে থাকবেন না কিন্তু যে কয়েকদিন পৃথিবীতে বেঁচে থাকবেন যেন সম্মানের সহিত বেঁচে থাকতে পারেন।

সরকার বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে সহায়তা করে যাচ্ছেন। কিন্তু এইসব অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী মুক্তিযোদ্ধাগণ সরকারের কাছ থেকে কোন কিছু নিতে লজ্জা বোধ করেন। যদিও তিনি বর্তমানে উপার্জন অক্ষম একজন ব্যক্তি। সরকারের কাছে অনুরোধ বীর মুক্তিযোদ্ধা কামাল চৌধুরী যেন শেষ জীবনে সম্মানের সহিত বাঁচতে পারেন তার ব্যবস্থা করবেন। সেই সাথে তার এবং তার পরিবারের বর্তমান চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন প্রণোদনা প্রদান করেন।

ওডি/এফই

আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড