এম. কামাল উদ্দিন, রাঙামাটি
রাঙামাটিতে কলেজছাত্রী পূর্ণিমা চাকমার রহস্যজনক মৃত্যুকে ঘিরে এলাকাজুড়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। এরই মধ্যে ঘটনার প্রতিবাদ আর বিক্ষোভে ফেটে পড়েছেন পূর্ণিমার স্বজন ছাড়াও কলেজ শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন মহল। এরই ধারাবাহিকতায় ঘটনাটিকে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড উল্লেখ করে এর সুষ্ঠু বিচারসহ জড়িতদের ফাঁসির দাবি জানিয়েছেন তারা।
সোমবার (১ নভেম্বর) এই দাবিতে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন শেষে রাঙামাটি রিপোর্টার্স ইউনিটির সম্মেলন কক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে অবিলম্বে পূর্ণিমা চাকমার হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে দোষীদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় এনে তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসির দাবি জানান নিহত কলেজছাত্রীর পরিবার।
জানা যায়, রাঙামাটি সরকারি মহিলা কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী পূর্ণিমা চাকমা শহরের রাজবাড়ি এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন। তিনি জুরাছড়ি উপজেলার ভারতের মিজোরাম সীমান্তবর্তী দুমদুম্যা ইউনিয়নের বগাখালী নামক পাহাড়ি গ্রামের সাধন চাকমার মেয়ে। গত ২৮ অক্টোবর দুপুরের দিকে পূর্ণিমাকে অচেতন অবস্থায় রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই সময় তাকে মৃত ঘোষণা করেন কর্তব্যরত চিকিৎসক। তবে পূর্ণিমাকে মৃত ঘোষণার সাথে সাথেই পালিয়ে যায় তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া বাসা মালিকের লোকজন। পরে তাদের কেউ কেউ ঘটনাটিকে আত্মহত্যা আবার কেউ স্ট্রোক করে পূর্ণিমার মৃত্যু হয়েছে বলে অপপ্রচার চালানোর চেষ্টা করে। একই সাথে ঘটনার পর থেকে পূর্ণিমার বাসার মালিক মল্লিকা চাকমাসহ তার পরিবারের অন্যরা পলাতক রয়েছে বলেও অভিযোগ করেছেন পূর্ণিমার স্বজনরা।
সংবাদ সম্মেলনে পূর্ণিমার বাবা সাধন চাকমা বলেন, আমার মেয়ে (পূর্ণিমা চাকমা) আত্মহত্যা করেনি। সে কোনো অবস্থাতেই আত্মহত্যা করার মেয়ে না। অন্য কোনোভাবেও সে মারা যায়নি, কারণ সে সম্পূর্ণ সুস্থ ছিল। ঘটনার আগের দিনও মেয়ের সঙ্গে আমার ফোনে কথাবার্তা হয়েছে। আমার মেয়েকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে। আমি মেয়ের হত্যার বিচার চাই। আমার একমাত্র দাবি খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তি।
তিনি বলেন, আমার মেয়ের স্বপ্ন ছিল একজন চিকিৎসক হয়ে মানুষের সেবা করা। সে জন্য সেই দুর্গম এলাকা থেকে এসে রাঙামাটি সরকারি মহিলা কলেজে ভর্তি হয়ে পড়ালেখা করছিল সে। আমাদের গ্রাম থেকে রাঙামাটি শহরে যাওয়া-আসায় সময় লাগে চার দিন। এসব কষ্ট সহ্য করে আমার মেয়ে শহরে এসে পড়ালেখা করছিল। অথচ খুনিরা আমার মেয়ের স্বপ্ন শেষ করে দিল।
এ দিকে, ঘটনার প্রতিবাদের পাশাপাশি সুষ্ঠু বিচারের দাবিতে সোমবার সকালে রাঙামাটি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে দুই ঘণ্টাব্যাপী মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়। পূর্ণিমার পরিবার-স্বজনসহ রাঙামাটি সরকারি মহিলা কলেজ, লেকার্স পাবলিক কলেজ, রাঙামাটি পাবলিক কলেজ, সরকারি কলেজসহ বিভিন্ন কলেজের অসংখ্য শিক্ষার্থী এতে অংশ নেন। এ সময় বাসা মালিক মল্লিকা চাকমাসহ তার পরিবারের লোকজন পূর্ণিমাকে নিষ্ঠুরভাবে গলাটিপে হত্যা করেছে বলেও দাবি করেন তারা।
মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, পূর্ণিমাকে হত্যার ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে আত্মহত্যা বলে চালোনোর অপচেষ্টা করা হচ্ছে। এ ছাড়াও নানাভাবে ঘটনাটি দফারফার চেষ্টা করছে খুনিরা। পূর্ণিমার বাবাকে ১ লাখ টাকার অধিক ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রস্তাবও দিচ্ছে মল্লিকার পরিবার। পূর্ণিমা যদি আত্মহত্যা করে থাকে তাহলে টাকা দিয়ে কেন ঘটনা দফারফার চেষ্টা করছে খুনিরা?
এ সময় পূর্ণিমার মামাতো ভাই ও কাপ্তাই সুইডিশ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্র পলাশ চাকমা বলেন, পূর্ণিমা কোনোভাবেই আত্মহত্যা করেনি। সে ওই রকম মেয়ে না। পূর্ণিমাকে হত্যা করা হয়েছে। এখন আসল ঘটনা ধামাচাপা দিতে নানাভাবে অপতৎপরতা চালানো হচ্ছে। পূর্ণিমার বাবাকে ক্ষতিপূরণ দিতে চাইছে বাড়ির মালিক। টাকা দিয়ে কী পূর্ণিমাকে ফিরে পাওয়া যাবে? তাই আমাদের দাবি খুনিদের ফাঁসি। আমরা খুব শিগগির পূর্ণিমা হত্যাকাণ্ডে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছি।
পূর্ণিমার অপর স্বজন ক্ষুদিরাম চাকমা বলেন, যেদিন পূর্ণিমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, সেদিন ঘটনার খবর পেয়ে তাৎক্ষণিক আমি হাসপাতালে ছুটে যাই। গিয়ে দেখি পূর্ণিমার নিথর দেহ একলা পড়ে আছে। পাশে তখন আমি ছাড়া কেউ ছিল না। তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলেও পূর্ণিমার মৃতদেহ ফেলে পালিয়ে গেছে বাসার মালিক মল্লিকা চাকমা ও তার পরিবারের লোকজন। লাশের গায়ে আত্মহত্যার কোনো আলামতও ছিল না। শুধু গলায় সামনে জঘন্য আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে। বাসার মালিকের পক্ষে সিলিং ফ্যানে ওড়না জড়িয়ে পূর্ণিমা আত্মহত্যা করেছে বলা হলেও তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। কারণ গলায় ফাঁসের কোনো গোলাকার চিহ্ন নেই। তাছাড়া বাসায় যে রুমে পূর্ণিমা আত্মহত্যা করেছে বলা হয়েছে, সেখানে গিয়ে দেখা যায়, সিলিং ফ্যান লাগানো আছে অনেক উঁচুতে। পূর্ণিমা নিজে কীভাবে সিলিং ফ্যানে গলায় ওড়না পেঁচিয়েছে, তার কোনো রকম আলামতও নেই। তাই আমরা নিশ্চিত যে, নিষ্পাপ পূর্ণিমাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। তাছাড়া তারা যদি নির্দোষ হতো তাহলে কেন পালিয়ে গেল? আমরা পূর্ণিমা হত্যার বিচার চাই।
মানববন্ধনে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন দুমদুম্যা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান রাজিয়া চাকমা, স্থানীয় মুরুব্বি মহারঞ্জন চাকমা, রাঙামাটি সরকারি মহিলা কলেজের ছাত্রী সাধনা চাকমা, লেকার্স পাবলিক কলেজের শিক্ষার্থী বিনু চাকমা, বিএম ইনস্টিটিউটের ছাত্র অর্পণ চাকমা, তরুণ চাকমা প্রমুখ।
এ দিকে, ভাড়া বাসায় পূর্ণিমার সাথে থাকা দশম শ্রেণির ছাত্রী মোহিনী চাকমা জানান, ঘটনার দিন আমি বাসায় ছিলাম না। পরে পূর্ণিমার মৃত্যুর খবর পেয়ে একেবারে হতভম্ব হয়ে পড়ি।
অন্যদিকে, পূর্ণিমার কয়েকজন সহপাঠী জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন ধরে মালিকের কিছু সমস্যার কারণে পূর্ণিমা বাসা পাল্টানোর কথা বলেছিল। কিন্তু এভাবে তার হঠাৎ মৃত্যু কখনো মেনে নেওয়া যায় না। আমরা ঘটনার তদন্তসাপেক্ষে সুষ্ঠু বিচার দাবি করছি।
এ দিকে, ঘটনার বিষয়ে অভিযুক্ত মল্লিকা ও তার পরিবারের লোকজনের সাথে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টার পরও তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
আরও পড়ুন : পলাশে জাতীয় যুব দিবস পালিত
এ বিষয়ে রাঙামাটি কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. কবির হোসেন জানান, লাশের ময়না তদন্তের পর থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে। এ ঘটনায় থানায় এখনও কেউ বাদী হয়ে মামলা দেয়নি। কেউ বাদী হয়ে মামলা দিলে তদন্তের ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানিয়েছেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।
ওডি/নিলয়
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড