• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৮ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

কলেজের অধ্যক্ষের লাগামহীন দুর্নীতি

  সুমন খান, লালমনিরহাট

১১ অক্টোবর ২০২১, ১৪:২৮
লালমনিরহাট
কলেজ (ছবি : অধিকার)

লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার উত্তর বাংলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ এএসএম মনওয়ারুল ইসলামের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে দায়িত্ব পালনসহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। তার বিরুদ্ধে ওই সব অভিযোগের সত্যতাও পেয়েছেন মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতর গঠিত তদন্ত কমিটি।

দুর্নীতি দমন কমিশনের নির্দেশের আলোকে এ তদন্ত করেন মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতরের একটি তদন্ত কমিটি। এএসএম মনওয়ারুল ইসলাম অধ্যক্ষের পদ ছেড়ে এখন প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও বর্তমান উপাধ্যক্ষ ও অন্য জ্যেষ্ঠ শিক্ষককে পাশ কাটিয়ে একেএম মনছুরুল ইসলামকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব প্রদান করেন।

এ ছাড়া সাবেক অধ্যক্ষ এএসএম মনওয়ারুল ইসলাম পূর্বের আয় ব্যয়ের হিসাব এখনো বুঝে দেয়নি এমন দাবি ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ একেএম মনছুরুল ইসলামের। তবে সাবেক অধ্যক্ষ মনওয়ারুলের দাবি তিনি নিয়মতান্ত্রিকভাবে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ একেএম মনছুরুল ইসলামের কাছে সকল দায়িত্ব বুঝে দিয়েছেন।

আর জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার দাবি, সাবেক অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে ওই তদন্ত প্রতিবেদন মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতরে প্রেরণ করা হয়েছে। তবে কয়েকজন শিক্ষকের দাবি দীর্ঘ দিনেও ওই তদন্ত প্রতিবেদনের আলোকে রহস্যজনক কারণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতর থেকে প্রাপ্ত সূত্রে জানা গেছে, ২০০৪ সালের ১২ এপ্রিল ওই উপজেলার করিমউদ্দিন পাবলিক কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক এএসএম মনওয়ারুল ইসলাম কাকিনা উত্তর বাংলা কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২০১৯ সালের ১০ এপ্রিল তার বয়স ৬০ বছর পূর্ণ হওয়ায় চাকরি মেয়াদকাল শেষ হয়। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (স্কুল ও কলেজ) জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা ২০১৮র মতে শিক্ষক-কর্মচারীর বয়স ৬০ বছর পূর্ণ হলে কোন অবস্থায় পুননিয়োগ কিংবা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের সুযোগ নেই। কিন্তু কলেজ পরিচালনা কমিটি’র সিদ্ধান্ত ও সুপারিশ মোতাবেক জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন সপেক্ষে আরও এক বছর অধ্যক্ষ পদে দায়িত্ব পালন করেন এএসএম মনওয়ারুল ইসলাম।

গত ২০১৯ সালের ২৩ জুলাই মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতরের সহকারী পরিচালন (কলেজ-৩) ফারহানা আক্তার তিন কর্ম দিবসের মধ্যে ওই প্রতিষ্ঠানের উপাধ্যক্ষ অথবা জ্যেষ্ঠ শিক্ষকের কাছে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব প্রদানের আদেশ দেন। কিন্তু এএসএম মনওয়ারুল ইসলাম সেই আদেশ পালন না করে ওই আদেশের স্থগিত চেয়ে মহামান্য হাইকোর্টের আশ্রয় গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে এএসএম মনওয়ারুল ইসলাম ছয় মাসের স্থগিতাদেশ লাভ করেন। ওই স্থগিতাদেশর সময় শেষ হওয়ার পর এএসএম মনওয়ারুল ইসলামকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে ৮ মাস ২১ দিনের জন্য চুক্তিভিত্তিক আবারও নিয়োগ দেয় কলেজ পরিচালনা কমিটির সুপারিশে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।

এ নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের কাছে অভিযোগ হলে দুর্নীতি দমন কমিশনের নির্দেশের আলোকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতর এএসএম মনওয়ারুল ইসলামের বিরুদ্ধে অবৈধ ভাবে দায়িত্ব পালনসহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত করেন। ওই তদন্ত প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র, জনবল কাঠামো ২০১৮ এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতরের নির্দেশনা অনুসরণ না করে এএসএম মনওয়ারুল ইসলাম অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করে ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিশৃঙ্খল সৃষ্টি করেছেন। এ নিয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতরের তদন্ত চলাকালীন সময় চলতি বছরের এক জানুয়ারি হতে ওই কলেজের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও সহকারী অধ্যাপক একেএম মনছুরুল ইসলামকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব প্রদান করেন কলেজ পরিচালনা কমিটি। একেএম মনছুরুল ইসলামকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব প্রদান করা হলেও তাকে অধ্যক্ষের দায়িত্ব বুঝে দেয়া হয়নি।

ওই তদন্ত প্রতিবেদনে মতামত হিসেবে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতরের তদন্ত কমিটির পক্ষে রংপুর অঞ্চলের উপ-পরিচালক মো. উমর ফারুক উল্লেখ করেন, সাবেক অধ্যক্ষ এএসএম মনওয়ারুল ইসলামের নিয়োগ বিধিসম্মত হয়নি। এমতাবস্থায় তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। চলমান দায়িত্বপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে দায়িত্ব প্রদানের বিষয়টিতেও নীতিমালা অনুসরণ করা হয়নি। কারণ সেখানে বর্তমান উপাধ্যক্ষ ও অন্য জ্যেষ্ঠ শিক্ষককে পাশ কাটিয়ে একেএম মনছুরুল ইসলামকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব প্রদান করেন। যা বিধিসম্মত হয়নি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র, জনবল কাঠামো ২০১৮ এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতরের নির্দেশনা অনুসরণ না করে এএসএম মনওয়ারুল ইসলামের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের মতামত দেন ওই তদন্ত কমিটি।

এ দিকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগের মেয়াদ শেষ হলে উত্তর বাংলা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্প পরিচালক হিসেবে সাবেক অধ্যক্ষ এএসএম মনওয়ারুল ইসলামকে দায়িত্ব দেয়া হয়। এএসএম মনওয়ারুল ইসলাম উত্তর বাংলা কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব থেকে সরে গেলেও উত্তর বাংলা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্প পরিচালক হিসেবে উত্তর বাংলা কলেজের অধিকাংশ বিষয়ে তিনি হস্তক্ষেপ করেন এমন অভিযোগ উঠেছে।

তদন্ত প্রতিবেদনটি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতরের রংপুর অঞ্চলের উপ-পরিচালক মো. উমর ফারুক গত ২৫ জানুয়ারি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালকের কাছে প্রেরণ করলেও দীর্ঘদিনেও সাবেক অধ্যক্ষ এএসএম মনওয়ারুল ইসলামের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি এমন অভিযোগ উঠেছে।

এছাড়া ওই কলেজের মনোবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক জাকারিয়া হাবিব মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের তদন্ত কমিটির কাছে দাবি করেন ২২ জন শিক্ষককে ভারতের পশ্চিম বঙ্গের রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গ্রহণের জন্য পাঠানো হলেও এ ক্ষেত্রে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নেয়া হয়নি। রজত জয়ন্তীর নামে ৭০ লাখ টাকা নিয়ম বহির্ভূতভাবে ব্যয় করেন তৎকালীন অধ্যক্ষ এএসএম মনওয়ারুল ইসলাম। সিইআই কর্তৃক ৯৮ লাখ টাকার প্রজেক্ট আসলে তা কলেজ ফান্ডে জমা না করে এবং সরকারকে এ বিষয়ে অবহিত করা হয়নি এমন দাবি প্রভাষক জাকারিয়া হাবিব’র।

এ বিষয়ে উত্তর বাংলা কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ একেএম মনছুরুল ইসলাম বলেন, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে আমি ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে চলতি দায়িত্বে আছে। তবে সাবেক অধ্যক্ষ এএসএম মনওয়ারুল ইসলাম পূর্বের আয় ব্যয়ের হিসাব এখনো বুঝিয়ে দেয়নি। নতুন অধ্যক্ষ নিয়োগ হলে তাকে সব দায়িত্ব বুঝিয়ে দিবেন।

উত্তর বাংলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ এএসএম মনওয়ারুল ইসলাম বলেন, নিয়মতান্ত্রিক ভাবে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ একেএম মনছুরুল ইসলামের কাছে সকল দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছি। আমার সময়কালে বারবার শ্রেষ্ঠ কলেজ হিসেবে উত্তর বাংলা কলেজ নির্বাচিত হয়েছে। এখন এ জেলায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষে যখন উত্তর বাংলা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘প্রকল্প পরিচালক’ হিসেবে কাজ করছি। আমি যখন কলেজ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এসেছি, ঠিক তখনি একটি মহল নোংরামী করছে। কলেজের প্রতিষ্ঠাতা দেশে এলে নতুন অধ্যক্ষ নিয়োগ করে তার উপস্থিতিতে নতুন অধ্যক্ষের কাছে সব হিসাব বুঝিয়ে দেওয়া হবে। যারা এ জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় হোক এটা চায় না কেবল তারাই আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে।

কাকিনা উত্তর বাংলা কলেজের পরিচালনা কমিটি’র সভাপতি নজরুল ইসলাম মতি সাবেক অধ্যক্ষ এএসএম মনওয়ারুল ইসলামের বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হয়নি। তবে তার দাবি কিছু সময়ের জন্য একেএম মনছুরুল ইসলামকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে তিনি আর কথা বলতে রাজি হয়নি।

মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতরের রংপুর অঞ্চলের উপ-পরিচালক মো. উমর ফারুক বলেন, উত্তর বাংলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ এএসএম মনওয়ারুল ইসলামের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগগুলো তদন্ত করে তদন্ত প্রতিবেদন অনেক আগেই মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতরে প্রেরণ করা হয়েছে। এখন শিক্ষা অধিদফতর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবেন।

ওডি/এমএ

আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড